পাকিস্তানের পক্ষে গলা ফাটানোর দল রাষ্ট্রদ্রোহী
প্রকাশের সময় : 2021-12-16 08:53:47 | প্রকাশক : Administration
প্রভাষ আমিন: স্বাধীনতাবিরোধী এবং তাদের বংশধরদের ঔদ্ধত্য আজ এতোটা বেড়েছে, তারা স্বাধীন বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে পাকিস্তানের বিজয় কামনা করে, বিজয়ে উল্লাস প্রকাশ করে। তারা পাকিস্তানের জার্সি গায়ে জড়িয়ে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে মাঠে খেলা দেখতে যায়।
টেলিভিশনে গ্যালারিতে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা দেখে প্রথমে আমি বিভ্রান্ত হয়েছি। ভেবেছি বাংলাদেশে থাকা কোনো পাকিস্তানি বা কূটনীতিকদের কেউ হয়তো মাঠে গেছেন খেলা দেখতে। অন্য দেশের খেলা থাকলে এমন দৃশ্য আমরা দেখি। কিন্তু জাতীয় পতাকার আধিক্য দেখে আমার ভুল ভেঙেছে।
পরে ভেবেছি খেলা যেহেতু মিরপুরে, তাই হয়তো বিহারি মানে শারীরিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিরাই হয়তো পুরোনো প্রেম ভুলতে পারেনি। আটকেপড়া পাকিস্তানিদের একটা বড় অংশ থাকে মিরপুর এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যারা জানেন, তারা নিশ্চয়ই এটাও জানেন মিরপুরমুক্ত হয়েছিলো, ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি, বাংলাদেশ বিজয় অর্জনের ৪৬ দিন পর। কিন্তু আমার সে বিভ্রমও কেটে যায়, যখন খেলা শেষে স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের জয়ধ্বনি উচ্চকিত হয়, যখন মানসিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিরা রীতিমতো টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়ে জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশের নাগরিক কিন্তু ভালোবাসেন পাকিস্তানকে। পাকিস্তানের জার্সি পরা এক তরুণ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করেন, জবাব বাংলায় দেবেন না উর্দুতে। উৎফুল্ল্য এই কুলাঙ্গার বলে, বাংলাদেশ বলতে তো কিছু নেই। চাই পাকিস্তান জিতুক। আরেক কুলাঙ্গারের ধারণা, বাংলাদেশ- পাকিস্তান ভাই ভাই। পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়াটাই ভুল হয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া কোনো তরুণ এমন দম্ভোক্তি করতে পারে, এটা অবিশ্বাস্য।
মুক্তিযোদ্ধারা সবসময়ই আমার কাছে সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত। নিজেদের জীবনের মায়া না করে তারা আমাদের একটা স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন। আজ যখন দেখি বাংলাদেশ তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে, আর পাকিস্তান প্রায় ব্যর্থ একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, তখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা আরও বাড়ে। রাজনৈতিক মতভিন্নতা থাকতে পারে, একেকজন একেক দল করতে পারে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের পক্ষে বলার ঔদ্ধত্য তারা কোথায় পায়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বরাবরই স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ দুটি ধারা আছে। নিজের কাছেই প্রশ্ন করি, বাংলাদেশ কবে ভেতরে ভেতরে এতোটা পাল্টে গেলো যে প্রকাশ্যে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া যায়। চার দশক পরে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে কিছুটা গ্লানিমুক্ত করেছেন। কিন্তু তলে তলে তাদের উত্তরসূরিরা বংশবিস্তার করেছে, আজ তারা বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তানের পতাকা বহন করে! মনে হচ্ছে, কোথাও আমরা ভুল করছি। ক্ষমতার কারণে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ছাড় দেওয়া হয়েছে, আপোস করা হয়েছে। তাদের দাবি মেনে পাঠ্যপুস্তক বদলানো হয়েছে। আর এ সুযোগে ভুলভাবে বেড়ে উঠছে নতুন প্রজন্মের একটি অংশ।
পাকিস্তান প্রসঙ্গ এলেই অনেকে খেলার সঙ্গে রাজনীতি না মেশানোর পরামর্শ দেন। অতীত ভুলে সামনে তাকানোর নসিহত করেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময়ও আমরা এমন অনেক নসিহত শুনেছি। এমনকি পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানোর প্রসঙ্গে অনেকে বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকার প্রসঙ্গ টানেন।
আমি জানি খলের কখনো ছলের অভাব হয় না। পাকিস্তানকে সমর্থন করার জন্য যারা এমন যুক্তি টানেন তারাও সেই স্বাধীনতাবিরোধী কুলাঙ্গারদেরই দোসর। ব্রাজিলের পতাকা আর পাকিস্তানের পতাকা এক নয়। বাংলাদেশ আমাদের আবেগের জায়গা, ক্রিকেট আমাদের সেই আবেগে নতুন মাত্রা আনে।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের মুক্তি সংগ্রাম আর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই স্বাধীনতায় মিশে আছে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর কোটি মা-বোনের নির্যাতনের হাহাকার। পাকিস্তান এখনো একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি, শিমলা চুক্তিতে বিচারের কথা বলে নিয়ে যাওয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি, আমাদের পাওনা ফেরত দেয়নি, আটকেপড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেয়নি। তাই পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো আপোস নেই।
স্বাধীন বাংলায় দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের পক্ষে বলার কোনো সুযোগ নেই। মিরপুরে যারা পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে খেলা দেখতে গেছে, পাকিস্তানের পক্ষে গলা ফাটিয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ভুল বলেছে, তারা রাষ্ট্রদ্রোহী। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ফুটেজ দেখে তাদের চিহ্নিত করে তাদের গ্রেপ্তার করা হোক। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হোক।
বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আছে, রাজনীতিতে মত থাকবে, ভিন্নমত থাকবে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের রাজনীতি করার বা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানোর কোনো অধিকার নেই। মিরপুরে পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে যাওয়া কুলাঙ্গারদের জন্যই বোধহয় সপ্তদশ শতকের কবি আব্দুল হাকিম লিখে গেছেন: ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ