আত্মসমর্পণের পর নিয়াজিকে যেভাবে রক্ষা করা হয়েছিল

প্রকাশের সময় : 2021-12-29 11:41:52 | প্রকাশক : Administration
আত্মসমর্পণের পর নিয়াজিকে যেভাবে রক্ষা করা হয়েছিল

একে রায়। তিনি ছিলেন তখনকার পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। একই সঙ্গে ভারত সরকার, বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার, মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনাদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানিরা যখন আত্মসমর্পণ করে, তখন সেখানে একমাত্র বেসামরিক ব্যক্তি হিসেবে তিনি উপস্থিত ছিলেন। একে রায়ের কন্যা তার ডকুমেন্ট থেকে টাইমস অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে সে সময়ের কথা শেয়ার করেছেন।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বেলা ১১টার দিকে কলকাতায় স্থাপিত আমার অস্থায়ী অফিসের টেবিলে থাকা টেলিফোন বেজে উঠলো। লাইনে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। তার কণ্ঠে বিরল এক আনন্দ উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল।

তিনি এমনই এক কণ্ঠে আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি কি ভ্রমণের জন্য প্রস্তুত কিনা। আমার ইতিবাচক জবাব পেয়ে তিনি বললেন, তাহলে একটা নতুন স্যুট পরুন এবং বিকাল ২টায় আমার সঙ্গে দমদমে সাক্ষাৎ করুন।

‘আপনি যা বলছেন, তা পাক্কা?’

‘হ্যাঁ, তাই। বিকাল ৪টা নাগাদ এটা ঘটতে চলেছে।’

‘আমার বিষয়ে দিল্লির ক্লিয়ারেন্স কি?’

‘আপনার সচিবের সঙ্গে কথা বলবেন চিফ’

‘ঠিক আছে। আমি তাহলে ২টার সময় আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করছি।’

একজন ভালো সরকারি কর্মচারী হিসেবে আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব এসকে ব্যানার্জীকে ফোন করলাম। তিনি বললেন ‘এগিয়ে যান।’ আমার অধীনস্ত অফিসারদের নির্দেশনামূলক কয়েকটি কথা বলে পুরনো সিয়ার্স রোইবাক স্যুট পড়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। (আইএফএস সহকর্মী) অরুন্ধতী ঘোষকে বললাম দিল্লিতে আমার স্ত্রীকে একটা ফোন দিতে এবং তাকে বলতে যে, আমি ঢাকা যাচ্ছি। তিনি আমাকে বললেন তাকে উদ্বেগে না রাখাই ভালো হবে।

দমদম থেকে আমরা দ্রুততার সঙ্গে ভারতীয় বিমান বাহিনীর এইচএস-৭৪৮ নিয়ে এভিএম এইচসি দেওয়ানের কমান্ডে উড্ডয়ন করলাম। এই ফ্লাইটটি অস্বাভাবিক ছিল। কারণ, পাকিস্তানের বিমান বিধ্বংসীকারীরা ট্রিগারে হাত রাখা। কয়েকটি গোলা যে ছুড়বে না তারা এর কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। যারা এর আগে কখনো পদ্মা নদী দেখেননি, তারা নারাছুগঞ্জের দক্ষিণে সুবিস্তৃত পদ্মা দেখে বিস্মিত হলেন। আমরা মেঘনা নদীর ওপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে দেখতে পেলাম বাতাসে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। প্রায় এক ঘণ্টা পর আমরা আগরতলায় অবতরণ করলাম। সেখান থেকে একটি অ্যালোটি হেলিকপ্টারে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে উড়াল দিলাম। সেখানে তখনো মিগ-২১ হামলায় সৃষ্ট ক্ষত দেখা যাচ্ছিল রানওয়েতে।

আমাদের প্রথম অভ্যর্থনা জানালেন মেজর জেনারেল (পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল) জেএফআর জ্যাকব, চিফ অব স্টাফ ইস্টার্ন কমান্ড। এনডিসিতে (ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ) আমার কোর্সমেট মেজর জেনারেল গন্ধর্ব নাগরাকে দেখে বেশ খুশি লাগছিল। এরপর এলেন পাকিস্তানি বাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজি। কড়কড়ে একটি ইউনিফর্ম পড়া তিনি। তা থেকে পারফিউমের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা তার গাড়িতে উঠলাম। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো রমনা ময়দানে। সেখানে একটি সাধারণ টেবিল আর অল্প কয়েকটি চেয়ার। অরোরা আত্মসমর্পণের নির্দেশনা সংবলিত ডকুমেন্ট নিয়ে এলেন। কিন্তু একটি সমস্যা দেখা দিলো। তা হলো বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করবেন কে? তিনজন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ এবং জিয়াউর রহমান এমন স্থানে তখন যে, সেখান থেকে সময়মতো তাদেরকে আকাশপথেও আনা যাবে না। তখন মুজিবনগরে গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খোন্দকার ছাড়া আর কাউকে আনার সুযোগ ছিল না। তিনি নবগঠিত বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান। তার জন্য ইউনিফর্ম প্রস্তুত ছিল না। সাদা পোশাকেই আমাদের সঙ্গে উড়ে এসেছেন তিনি।

ময়দানে তখন উপস্থিত আমাদের প্রায় ৩০০ সেনাসদস্য। অন্যদিকে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনার সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। ময়দানে তখন সম্ভবত কয়েক হাজার দর্শক উপস্থিত হয়েছেন। তারা কি দেখতে গিয়েছেন সে বিষয়ে নিশ্চিত নয়।

নিয়াজি ডকুমেন্টে স্বাক্ষর করলেন। তার সাইড-আর্ম নামিয়ে রাখলেন। খুলে ফেললেন সেমব্রাউন, বেল্ট এবং কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এই সেই ব্যক্তি যার সম্পর্কে করাচি থেকে একজন আমেরিকান নারী সাংবাদিক লিখেছেন, ‘যখন টাইগার নিয়াজির ট্যাঙ্ক চলতে শুরু করে, তখন ভারতীয়রা তাদের জীবন নিয়ে পালাবে।’

আকস্মিত জনতার ভিড় থেকে কেউ একজন চিৎকার করে উঠলেন ‘ওইতো শালা নিয়াজি’। সবাই উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। নাগরা, আমি এবং ডজনখানেক অন্যরা নিয়াজির চারদিকে মানবচেইন তৈরি করলাম। নাগরা তাকে একটি জিপে উঠিয়ে দিলো এবং তা ক্যান্টনমেন্টের দিকে ছুটে গেল। নিয়াজিকে সুরক্ষা দিতে হয়েছিল আমাদের। তিনি তখন যুদ্ধবন্দি। আমরা যা করেছি, যদি তা না করতাম, তাহলে উত্তেজিত জনতা তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলতো।

আমি বেগম মুজিবের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য একটি বিরতি দিলাম। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তখন শেখ হাসিনাও। ঘটনার প্রবাহ এতটাই বিস্ময়কর ছিল যে, কোনো বিষয়ে কথা বলা ছিল কঠিন। এটা ছিল আস্বাদন নেয়ার মতো একটি মুহূর্ত। আমরা যখন সেখানে বসা, শুনতে পাচ্ছিলাম মাঝে মাঝেই রাইফেল থেকে গুলি ছোড়া হচ্ছে। সবেমাত্র শেষ হওয়া যুদ্ধে শ্বাস ফেলা এটা।

বিমানবন্দরে ফিরে এসে দেখতে পেলাম- যে হেলিকপ্টার বরাদ্দ হয়েছে তাতে আগারতলায় ফেরার জন্য মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের উপচেপড়া ভিড়। এমন অবস্থায় সফরে বাদ পড়ার ঝুঁকিতে ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন খোন্দকারও। শেষ পর্যন্ত আমরা একটি অ্যালোটি হেলিকপ্টারে কোনোমতে মাথা গোঁজার সুযোগ পেলাম। দ্রুত তখন শীতের সন্ধ্যা নামছিল। তার মধ্যে ধূলোবালিও উড়ে গেল আগরতলার দিকে। - সূত্র: অনলাইন

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com