শিল্পবিপ্লবের সুফল নিতে প্রয়োজন দক্ষ মানুষ
প্রকাশের সময় : 2022-01-12 15:59:09 | প্রকাশক : Administration
সঞ্জীব রায়: বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে চায়। সেই লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক কর্মপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, চলছে কাজও। পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশ এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল নিতে শুরু করেছে। নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, ২০২১ সালেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মূল বৈশিষ্ট হলো প্রযুক্তির সর্বোচ্চ উদ্ভাবনের মাধ্যমে ডিজিটাল, বাস্তবিক ও জৈবিক জীবনের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনা। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানুষের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিঁখুত ও নির্ভুল কাজ করা সম্ভব এই যুগে।
ডিজিটাল যুগের হাত ধরেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের শুরু যা ঘটতে শুরু করে বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে। এর আগের অর্থাৎ তৃতীয় শিল্পবিপ্লব বলা হতো ইলেকট্রনিক্স ও আইটি (ইনফরমেশন টেকনোলজি) ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনের যুগকে, যার সূচনাও হয় গত শতকে। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সেই বিপ্লবে বড় ভূমিকা রাখে। আর তার আগের শতকে ১৮৭০ এর দিকে শুরু হয় দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব। যার মূল বৈশিষ্ট ছিল বিদ্যুৎ ব্যবহারের মাধ্যমে কলকারখানায় বিপুল আকারের শিল্প উৎপাদন। এ সময় প্রথম প্রোডাকশন লাইন ব্যবস্থার সূচনা হয়। আর প্রথম শিল্পবিপ্লব হয় আঠারো শতকে বাষ্পীয় ইঞ্জিন চালুর মাধ্যমে। মেশিনারিজ বা যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আধুনিক শিল্পব্যবস্থা চালু হয় এ সময়।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুবিধাগুলোর মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে জীবনযাত্রাকে সহজ করা ও উৎপাদন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দেয়া যাবে। বিশেষ করে মানুষের জীবনের সব ধরনের প্রয়োজন বুঝবে এমন প্রোগ্রাম তৈরি এবং উন্নতমানের রোবটকে মানবসমাজের সদস্যের মতো করেই গড়ে তোলা হবে। রোবটগুলো শুধু মেশিন হবে না বরং বুঝবে মানুষের প্রয়োজন, যোগাযোগ করবে এবং মানুষের পৃথিবীর জন্য নিজ তাগিদে কাজ করবে। গাড়ি চালানোর জন্য মানুষের প্রয়োজন হবে না। শিল্প-কলকারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রতিটি ধাপে মানুষকে মেশিন চালাতে হবে না বরং স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহারে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতেই হবে উৎপাদন কাজ। তাহলে কী কাজ হারাবেন শ্রমিকেরা? হ্যাঁ, এই শিল্পবিপ্লব যেমন অনেক মানুষকে করবে বেকার, আবার সুযোগ সৃষ্টি করবে নতুন ধারার কর্মসংস্থানের। যেহেতু এই শিল্পবিপ্লবের যুগটি জ্ঞানভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও ডিজিটাল দক্ষতার যুগ, তাই এর সুফল নিতে দক্ষ মানুষ তৈরির কোন বিকল্প নেই। আসছে বছরগুলোতে কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বৈষম্য তৈরি হবে কম দক্ষতাসম্পন্নদের স্পল্প আয় আর উচ্চ দক্ষতাসম্পন্নদের উন্নত আয়ের মধ্যে।
বাংলাদেশ এরই মধ্যে ৩৯ টি হাইটেক পার্ক করা হয়েছে। আসবে ৫ জি, তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল, এবং প্রান্তিক বাংলাদেশ হবে পুরোপুরি ডিজিটাল। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অভিযাত্রায় শামিল হতে আমরা অবকাঠামোগভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি। এখন প্রয়োজন সঠিক নীতিমালা, বিশ্লেষণ, দক্ষ মানবসম্পদ আর বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্ব। ডিজিটাল এই যুগে দেশে বসে আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থার সাথে যুক্ত থাকার জন্য অনলাইন বাণিজ্য ও আমদানী-রপ্তানীকে আরো বেশি জনমূখী করতে হবে। ভার্চ্যুয়াল রিয়্যালিটি, ইন্টারনেট অব থিংগ্স এবং আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সবচেয়ে বড় উদ্যোগ নিতে হবে শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে। শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি ধাপে এমন পাঠ্যক্রম ও চর্চা নিয়ে আসতে হবে যা এদেশের আগামী প্রজন্মকে এই যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত করতে পারে। একইসাথে শিল্প-কলকারখানায় কী ধরনের দক্ষতা ও জ্ঞানের প্রয়োজন সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য তথ্যের ঘাটতি উন্নয়নের একটি বড় অন্তরায়।
আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সবচেয়ে জরুরি হলো সঠিক ও প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ এবং তার নির্মোহ বিশ্লেষণ। তারপর পরিকল্পনা মাফিক আমাদের শ্রম নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থাকে প্রযুক্তি ও জ্ঞাননির্ভর করার কাজে হাত দেয়া। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সার্বিক উৎপাদন ব্যবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঠিক প্রয়োগ সম্ভব হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য যেমন দক্ষ মানুষ গড়ার কোন বিকল্প নেই। তেমনি এই বাস্তবতা আমাদের জীবন ও অর্থনীতিতে যে সম্ভাব্য সংকটগুলো হাজির করবে তার জন্যেও প্রস্তুতি নিতে হবে। উন্নত প্রযুক্তির সাথে মানুষ, প্রকৃতি, জীবন ও সমাজের একটি ইতিবাচক যোগসূত্র সৃষ্টির মধ্য দিয়েই বাংলাদেশকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল নিতে হবে।