তাছলিমার ১৩’শ টাকা থেকে হয়েছে ৩ লাখ

প্রকাশের সময় : 2022-01-12 16:37:06 | প্রকাশক : Administration
তাছলিমার ১৩’শ টাকা থেকে হয়েছে ৩ লাখ

মানুষের জীবনকে নিয়ে কতই না স্বপ্ন থাকে। কেউ ইঞ্জিনিয়ার হবেন, কেউ ব্যাংকার, কেউ ডাক্তার হবেন আবার কেউ বা হবেন উকিল। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো ছোটবেলা থেকে জীবনকে নিয়ে তারও স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা শেষ করে নিজে কিছু করবেন। শুধু যে নিজে স্বাবলম্বী হবেন, নিজের পায়ে দাঁড়াবেন তা নয়, সেই সাথে গরীব, অসহায় নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করে তাদের পাশে দাঁড়াবেন। সে স্বপ্ন অবশ্য আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। এখন নিজের প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন গরীব, অসহায় নারীরা। শ্রম দিয়ে সুন্দর করে জীবন-যাপন করছেন তারা।

বলছিলাম বগুড়া জেলার নারী উদ্যোক্তা তাছলিমা আক্তার নাসিমার কথা। শুধু মনের জোর আর সদিচ্ছার কারণে একজন শূন্য থেকে শুরু করে নিজের চেষ্টা, অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে কীভাবে নিজের একটা আলাদা পরিচয় তৈরি করা যায় তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত অদম্য সংগ্রামী নারী নাসিমা। আজ তিনি সফল নারী উদ্যোক্তা। এই পথটা সহজ ছিল না। অনেক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সেই গল্প জানতে যেতে হবে আরো অনেক পেছেনে।

রংপুরের মীরবাগের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম তাছলিমা আক্তার নাসিমার। বাবা মীরবাগের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। বাবা ও মা দু’জনেই শিক্ষিত। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে নাসিমা সবার ছোট। তার বাবার স্বপ্ন ছিল তিন বোনকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ও মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। তার সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। বড় ভাই-বোনেরা সবাই শিক্ষিত।

নাসিমার শৈশব ও কৈশোরের স্বর্ণালী দিনগুলো কাটে রংপুরেই। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পড়ালেখা করেন সেখান থেকে। কলেজ জীবন, সব কিছুই ছিল রঙিন। কলেজ ক্যাম্পাস, পড়ালেখা, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দেয়া, মুক্ত পাখির মতো ঘুরে বেড়ানো, সব কিছুই চলছিল স্বাভাবিক নিয়মে। হঠাৎ করেই বদলে গেলো তার জীবনের দৃশ্যপট। তখনও সবেমাত্র পড়ছিলেন উচ্চমাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষে। পারিবারিকভাবে হঠাৎ করে তাকে পাবনার পাত্রের সাথে দেয়া হয় বিয়ে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন। পরে যেতে হয় শ্বশুর বাড়িতে। শুরু হয় নতুন জীবন।

বিয়ের পর সব কিছু তার কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। নিজের পড়ালেখার স্বপ্ন, অন্যদিকে বাবার স্বপ্ন পূরণ সবই বুঝি শেষ হয়ে গেল। কেননা শ্বশুর বাড়ি থেকে লেখাপড়া করা নিষেধ। বাড়ির বউ আবার লেখাপড়া করে নাকি। সব পরিস্থিতির কারণে তার মাথার উপরে যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তখন পাশে কেউ ছিল না। নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল তার। কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না। অন্যদিকে, মনের মধ্যে লালিত স্বপ্ন তাকে বার বার তাগিদ দিতে থাকে। পড়ালেখা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। নিজে থেকে কিছু একটা করে নিজের পরিচিতি তৈরি করতে হবে। সেই সাথে অসহায় কিছু নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

নাসিমা বলেন, অনার্স এডমিশনের আর বেশি দিন নেই। কোন কিছু ভেবে না পেয়ে নিজের মনোবল শক্ত করলাম। একদিন সুযোগ বুঝে আমার স্বামীর দুর্বলতায় আঘাত করলাম। তাকে বললাম আমাকে পড়ালেখা না করালে আমি তোমার সাথে থাকতে পারবো না। আমি চলে যাবো। তখন স্বামী আমাকে একটা শর্ত দিলেন। যদি অনার্সের এডমিশনে চান্স পাই তাহলে পড়াবেন। আর ফেল করলে পড়াবেন না। আমিও তার শর্তে রাজি হয়ে যাই। এডমিশনে প্রথম মেরিটে সামনের সিরিয়ালে আমার নাম আসে। অনার্সে ভর্তি হলাম। শ্বশুর বাড়িতে সকল দায়িত্ব পালন করে নিয়মিত ক্লাস শুরু করি।

অনার্স প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট রেজাল্ট আসে নাসিমার। তৃতীয় বর্ষে এসে হন প্রেগন্যান্ট। তখন শ্বশুর বাড়ির সবাই বাড়ির কাজ কমপ্লিট করে একেবারেই গ্রামে চলে যান। আবারো একা হয়ে গেলেন তিনি। অসুস্থ শরীর নিয়ে তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দেন। এই অসুস্থতার সময় পাশে থাকার কেউ ছিল না। যদিও স্বামী ছিলেন, কিন্তু কাজের চাপে তাকে কোন হেল্প করতে পারতেন না। এমন কঠিন অবস্থাতেও তৃতীয় বর্ষেও ফাস্টক্লাস পান। চতুর্থ বর্ষে এসে কোল আলো করে আসে একমাত্র কন্যা সন্তান। মেয়ের বয়স তখন ৬ মাস। ওই শিশুকে রেখে পরীক্ষা দেন। টানা চার ঘন্টা পরীক্ষা দিয়ে এসে দেখতেন মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে।

কলেজ-ভার্সিটির বন্ধু-বান্ধবের সাথে যোগাযোগ, আড্ডার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করা হলেও তেমন কোন ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নিয়ে ব্যবহার করা হতো না তার। ২০২০ সালের জুলাই মাস। সারাদেশে তখন চলছিল লকডাউন। সবাই ঘরে বসে সব কিছু অনলাইনে কেনাকাটা করে। নাসিমার ভাতিজি এসকে সুরমা তাকে দেশের নারী উদ্যোক্তাদের জনপ্রিয় অনলাইন প্লাটফর্ম উম্যান অ্যান্ড ইকমার্স ফোরাম (উই) গ্রুপের সন্ধান দেন।

সিদ্ধান্ত নেন ই-কমার্স বিজনেস করার। কিন্তু চাইলেই তো আর ই-কমার্স বিজনেস করে সফলতা অর্জন করা সম্ভব না। এর জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, বিজনেসের জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা। উইয়ের প্রধান মেন্টর রাজিব আহমেদের নির্দেশ মতো ডিজিটাল স্কিল ফর বাংলাদেশ (ডিএসবি) গ্রুপে কিছুদিন পড়া লেখা করেন। ই-কমার্স বিজনেস সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন। আবার উইয়ে তিন মাস শুধু এক্টিভ থাকেন। এই গ্রুপে তিনি দিনে ১০ ঘন্টা সময় দেন। তখন পরিবার থেকে নানান ধরনের বাঁধা আসতে শুরু করে। সারাদিন ফোন নিয়ে থাকলে সংসার দেখবে কে, চোখের সমস্যা হবে, এসব ই-কমার্স বিজনেস করার দরকার নেই, এসব বাদ দিয়ে চাকরি করো আরো অনেক কথা শুরু করেন সবাই। ফোন চাপলেই এসব কথা তাকে শুনতে হতো। তাই গোপনে গ্রুপে এক্টিভ থাকতেন। রাতে যখন স্বামী ও ছোট্ট মেয়ে ঘুমিয়ে পড়তো তখন তিনি এক্টিভ থেকে পরিচিতি বাড়াতে থাকেন।

নাসিমার ছোটবেলা থেকেই পেন্টিংয়ের প্রতি ভীষণ দুর্বলতা ছিল। পেন্টিং করতে খুব ভালো লাগতো। ২০১০ সালে হ্যান্ডপেইন্ট, ব্লক ও বাটিকের উপর একটি কোর্স করেন। পেইন্টিং ছিল তার নেশা। সেই ভালোলাগাকেই এখন কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু করলে কেমন হয়। তখন সিদ্ধান্ত নেন কাপড় কিনে পেন্টিং করে সেগুলো অনলাইনে বিক্রি করবেন। কিন্তু টাকা? পরিবার থেকে তো কেউ হেল্প করবে না।

হাতে ছিল মাত্র ১৩০০ টাকা। সেটা দিয়েই কাপড় কিনেন। হ্যান্ডপেন্টের ফ্যামিলি ম্যাচিং ড্রেস তৈরি করেন। আর এক কালার হাফ সিল্ক শাড়ি ও এক কালার উলের শাল নিয়ে উই গ্রুপে পোস্ট করেন। সেগুলো বিক্রি হয়ে যায়। মনে খুব আনন্দ লাগে। দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে আবার তৈরি করেন। পোস্ট দেন। তখন অনলাইনে ব্যবসাটাকে পরিচালনা করার জন্য ‘সৌন্দর্যে শতরূপা’ নামে একটা পেজ খুলেন। সেই পেজকে ব্র্যান্ডিং করতে শুরু করেন। মার্কেটিং করে কাস্টমারের কাছে পরিচিতি বাড়ান।

এভাবে দিন-রাত এক করে স্বামী-সংসার সামলে কঠোর পরিশ্রম করে নিজের ব্যবসাটা চালিয়ে নিতে থাকেন। কাজের কোয়ালিটিতে কাস্টমাররাও বেশ সাড়া দিতে থাকেন। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সেই যে শুরু অনলাইনে ব্যবসা আজ তিনি লাখপতি। উদ্যোগের বয়স ৯ মাস। ৩ মাস শুধু এক্টিভ থেকেছেন আর এই ৬ মাসে শুধুমাত্র উইয়ে পণ্য বিক্রি করেছেন ৩ লাখ টাকার। এর মধ্যে রমজান মাসের মধ্যে বিক্রি হয়েছে ১ লাখ আট হাজার টাকা।

অনলাইন ব্যবসা জীবনের প্রাপ্তি হিসেব নাসিমা বলেন, আমার ‘সৌন্দর্যে শতরূপা’পণ্য দেশের প্রায় ৩০ জেলায় পৌঁছে গেছে। শুধু তাই নয়, দেশের গন্ডি পেরিয়ে হাতের তৈরি পণ্য পৌঁছে গেছে বিশ্বের চারটি দেশে। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও সিঙ্গাপুর। আল্লাহর অশেষ রহমতে এখন আমার ব্যবসায় প্রায় ১০-১২ জন কর্মী কাজ করছেন, যার মাধ্যমে বেকার অসহায় নারীদের অর্থনৈতিক কিছুটা সমস্যা সমাধান হচ্ছে। আমার উদ্যোগকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। এর পাশাপাশি অসহায় নারীদের পাশে থাকতে চাই। - সূত্র: অনলাইন

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com