মরুভুমির বুকে কাতারের সৌন্দর্য
প্রকাশের সময় : 2022-01-12 16:38:26 | প্রকাশক : Administration
জেসিউর রহমান শামীম: বিশ্ববাসী যে দেশকে কোটিপতির দেশ হিসাবে চেনে, যে দেশের বিলাসিতা ও জীবনযাত্রা সারা বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করেছে সে দেশটি হল কাতার। কাতার মধ্য প্রাচ্যের একটি আরব দেশ। আরব দেশগুলোর মধ্যে কাতারই হলো সবচেয়ে ছোট দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি এখন আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে। বিশ্বের সব শক্তিধর ও প্রভাবশালী দেশকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে ধনী দেশ হওয়ার সম্মান পেল কাতার। যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ফোর্বস বিশ্বের ১৮২টি দেশে সমীক্ষা চালিয়ে ধনবান দেশের যে তালিকা তৈরি করে তাতে প্রথমে রয়েছে এই দেশ। কাতারকে রাষ্ট্রীয় ভাবে ‘দওলাত আল কাতার’ নামে ডাকা হয়।
খনিজ তেল, গ্যাস সমৃদ্ধ আরব উপসাগরের ছোট্ট এই দেশের দক্ষিণে সৌদি আরব আর পশ্চিমে বাহারাইন দ্বীপ। কাতারের আয়ুন ১১ হাজার ৫৮৬ বর্গ কিলোমিটার বা ৪ হাজার ৪৬৮ বর্গ মাইল। এর উপকূলবর্তী এলাকা ৫৬৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, যার ৬০ কিলোমিটার সৌদি আরবের সীমানা ঘেঁষে। অন্যান্য আরব দেশের মত এটিও শুষ্ক মরুর দেশ। এখানে ভূ-পৃষ্ঠস্থ কোন জলাশয় নেই এবং প্রাণী ও উদ্ভিদের সংখ্যাও একেবারে সামান্য। বেশিরভাগ লোক শহরেই বাস করে।
১৯’শ শতকের শেষ ভাগ থেকে আল-থানি গোত্রের লোকেরা কাতার অঞ্চলটিকে একটি আমিরাত হিসাবে শাসন করে আসছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দেশটি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে। ১৯৭১ সালে এটি পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। বিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগ পর্যন্তও এটি একটি তুলনামূলক দরিদ্র দেশ ছিল। ঐ সময় দেশটিতে পেট্রোলিয়ামের মজুদ আবিষ্কৃত হয় এবং এবং এগুলো উত্তোলন শুরু হয়। আর এর পরই দেশটির অর্থনীতি বদলাতে থাকে।
২০১৭ সাল কাতারের মোট জনসংখ্যা প্রায় ২৬ লক্ষ ৪১ হাজার। অবাক করা বিষয় হচ্ছে এই জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশ কাতারের আদি বাসিন্দা। আর বাকি ৮৬ শতাংশ লোকই বিদেশী। তারা বিভিন্ন কাজকর্মের জন্য এখানে বসবাস করে। পৃথিবীর মধ্যে কাতারই এক মাত্র দেশ যেখানে প্রায় ১৫০টি দেশেরও বেশি লোক বসবাস করে। কিন্তু এই মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৩ শতাংশ লোক কোটিপতি। কাতারের সমস্ত লোক কোনো না কোনো কাজে যুক্ত থেকে তাই এখানে বেকার লোক খুজে পাওয়া খুব কষ্ট। সার্বিক বিবেচনায় বেকার সংখ্যা ১ শতাংশের ও নিচে। সেখানে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা খুবই কম। সেখানে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মেয়ে বসবাস করে।
কাতার সরকারের প্রধান আমির। কাতার সরকার একটি পরম রাজতন্ত্র, আল থানি পরিবারের নেতৃত্বে। বর্তমান আমির তামিম বিন হামাদ আল থানি, যিনি ২৫ জুন ২০১৩ তারিখে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। কাতারে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ এবং দেশটির কোনও স্বাধীন আইনসভা নেই। বর্তমান আমিরের বাবা ২০০৫ সালে বিনামূল্যে সংসদীয় নির্বাচন করার প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন, কিন্তু ভোটটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
কাতারে একটি মজলিশ আল শুরা আছে, যা শুধুমাত্র একটি পরামর্শমূলক ভূমিকায় কাজ করে। এটা খসড়া এবং আইন প্রস্তাব করতে পারে, কিন্তু আমির সব আইন চূড়ান্ত অনুমোদন করেন। কাতারের ২০০৩ সালের সংবিধানে মজলিসের ৪৫ টির মধ্যে ৩০ টি নির্বাচন সরাসরি হয়, কিন্তু বর্তমানে তাদের সবাই এমিরেসের নিয়োগকর্তা।
কাতারের রাষ্ট্রীয় ভাষা আরবি। কিন্তু সেখানে ইংরেজি ভাষাও কিছুটা প্রচলিত আছে এবং স্থানীয় উপভাষাটি কাতারী আরবী নামে পরিচিত। কাতারের গুরুত্বপূর্ণ অভিবাসী ভাষাগুলিতে হিন্দি, উর্দু, তামিল, নেপালি, মালয়ালাম, এবং তাগালোগ রয়েছে। কাতারে সবচেয়ে বেশি মুসলিম ধর্মের লোক বসবাস করে। এছাড়াও কিছু হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মের লোকও আছে। কাতারের কোনও হিন্দু বা বৌদ্ধ মন্দির নেই, তবে সরকার খ্রিস্টানরা সরকার কর্তৃক দানকৃত ভূমিগুলিতে গীর্জা তৈরি করতে দেয় । গীর্জা অবিচ্ছিন্ন থাকা আবশ্যক, তবে বিল্ডিং বাইরে বাইরে কোন ঘন্টাধ্বনি ক্রস সঙ্গে । কাতারের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হলো ফুটবল।
মূলত কাতার ইসলামিক রাষ্ট্র হওয়াতে এটি একটি রক্ষনশীল দেশ হিসাবে পরিচিত। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেশটি শিল্প কলায় প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে। তারপরেও কাতার একটি ইসলামিক রাষ্ট হওয়ায় সেখানে কিছু নিয়ম রয়েছে যা সবাইকে মেনে চলতে হয়। যেমন মেয়েদের পশ্চিমা পোষাক পড়া একেবারেই নিষেধ। মদ পান করা এবং কেনা বেচাও সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ। কাতারে দুই ধরনের আইন দেখতে পাওয়া যায়, একটি হলো সাধারণ আইন এবং অপরটি হলো শরিয়া আইন। শরিয়া আইন খুবই কঠিন ভাবে পালন করা হয়। সেখানে কেউ যদি ধর্ম নিয়ে বাজে মন্তব্য করে তবে তাকে সাত বছর পর্যন্ত জেলে থাকতে হতে পারে। কাতারে শিক্ষিতের হার প্রায় ৫৮ শতাংশ। কাতার তেল খনির দেশ হওয়ায় সেখানে পেট্রোল পানির দামে পাওয়া যায়।
কাতারের জলবায়ু শীতের মাসগুলিতে হালকা ও মনোরম এবং গ্রীষ্মের সময় অত্যন্ত গরম এবং শুষ্ক। প্রায় সব বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মার্চে হয়, যার পরিমাণ প্রায় ৫০ মিলিমিটার ।
একবার মাছ ধরার এবং মুক্তা ডাইভিং উপর নির্ভরশীল, এখন কাতার অর্থনীতি পেট্রোলিয়াম পণ্য উপর ভিত্তি করে। কপারের সম্পদ তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের রপ্তানির উপর বড় অংশ। বস্তুত, এই একবার ঘুমন্ত জাতি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, প্রাচ্য নিদর্শন এবং কোটিপতি লোকদের জীবনযাপন দেখার জন্য প্রতি বছর অনেক পর্যটক কাতারে আসেন। এর প্রতি মাথাপিছু জিডিপি $১০২,১০০ (তুলনায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতি মাথাপিছু জিডিপি $ ৫২,৮০০)।