অনুকরণীয় তাজউদ্দীন আহমদ

প্রকাশের সময় : 2022-01-26 11:15:12 | প্রকাশক : Administration
অনুকরণীয় তাজউদ্দীন আহমদ

রাজনীতিতে, রাষ্ট্রাচারে এক অনুকরণীয় সততা, নিষ্ঠা, মেধা, প্রজ্ঞা, চিন্তাশীলতার কর্মজীবন হাজির রেখেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তার রাজনৈতিক জীবন, রাষ্ট্রনৈতিক চর্চা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য এক বড় অনুপ্রেরণাও বটে। সে কারণেই তার জন্মদিনে রইল একরাশ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।

তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫) জন্মেছিলেন ২৩ জুলাই ১৯২৫ ঢাকার অদূরে অধুনা গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামে। স্বল্পায়ু ছিলেন তিনি। মাত্র ৫০ বছরে বয়সেই তাকে ঢাকার কেন্দ্রীয় জেলখানায় খুনিরা হত্যা করে। তাজউদ্দীন আহমদের কমবয়সী জীবন মোটা দাগে চারটি অধ্যায়ে বা ধাপে ভাগ করা যায়।

প্রথম ধাপ: ১৯২৫-১৯৪৭: ১৯২৫ সালে জন্মের পর ১৯৪৭ সাল অবধি, এই ২২ বছর ছিল তার বেড়ে উঠা, গড়ে ওঠার প্রথম ধাপ। স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরুতেই রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন নিবিষ্টভাবে। রাজনীতির মাধ্যমেই জনসেবা করবেন, যুগের এই মহীয়ান বাসনা তাকে তাড়িত করেছিল। লক্ষ্যস্থির করে ফেলেছিলেন জীবনের এই প্রারম্ভেই।

মক্তব, বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের মুসলমান-হিন্দু শিক্ষক পরিচালিত স্কুল আর খ্রিস্টান মিশনারি স্কুল ছিল তার বিস্তৃত বিদ্যায়তন। ফলে বহু ধর্মের, বহু ভাবনার এক উদারনৈতিক কসমোপলিটন শিক্ষা তার অন্তরকে ছুঁয়েছিল। এই উদারনৈতিকতা লাগামছাড়া ছিল না, ফলে স্বজাতি ও স্বধর্মের মানুষের সামাজিক, ধর্মীয় বোধ- বিবেচনাকেও গভীরভাবে সম্মান করতে শিখেছিলেন তিনি।

ফলে নীতিনিষ্ঠতা, ন্যায়পরায়ণতা, নিয়মানুবর্তিতা, ন্যায্যতা, সময়ের সদ্ব্যবহার, আর্থিক ও মানসিক সততা, বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, কথার বরখেলাপ না করা, সাধারণ মানুষের প্রতি সম্মান, আমানতের জিম্মাদারি, নিজের কাজ নিজে করা, সরল সাদাসিধে জীবনযাপন প্রভৃতি তাজউদ্দীন আহমদের জীবনের সত্যনিষ্ঠ অনুষঙ্গ ছিল আমৃত্যু। কোনো পরিস্থিতিতেই জীবনের এসব উচ্চায়ত মূলবোধ থেকে পিছু হটেননি কখনোই।

সে কারণেই, জীবনের এই প্রথম ধাপের প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করে জটিল-কুটিল পথ পেরিয়ে জাতীয় রাজনীতির মহত্তম লক্ষ্য বাস্তবায়নের কাজে নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছেন যোগ্যতার সঙ্গে। এর মধ্যে ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের মধ্য দিয়ে স্বজাতির স্বাধীন দেশ পাকিস্তানের জন্মও দেখেছেন। আবার দেশভাগের বিয়োগ, বেদনা, দাঙ্গার মর্মান্তিক স্মৃতি তার রাজনৈতিক জীবন তো বটেই ব্যক্তিজীবনেও বড় অভিজ্ঞতা এনেছে। স্বাধীনতার মর্ম গভীরভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন। বুঝতে পেরেছেন, সে সময়ের ক্ষমতাবান মুসলিম লীগের মধ্যে নিজেকে যুক্ত রেখেই তার ভেতরে অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিবাদী, আধুনিক রাজনৈতিক দল তৈরির চেষ্টাটাই হবে যুক্তিযুক্ত।

রাজনীতি শুরুর দিনগুলোতে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল ধারার মুখ্য উদ্যোক্তা কলকাতার আবুল হাশিম (১৯০৫-১৯৭৪) আর ঢাকার উদারনৈতিক প্রগতিশীল রাজনীতির মুখ্য চরিত্র কামরুদ্দীন আহমদ (১৯১২-১৯৮২) এই দুই জন মানুষের প্রভাব ছিল তাজউদ্দীন আহমদের ওপর।

দ্বিতীয় ধাপ: ১৯৪৭-১৯৭১: ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল জীবনের এই ২৪ বছর ছিল তাজউদ্দীন আহমদের জীবনের দ্বিতীয় ধাপ। এই ধাপই তার রাজনীতির মধ্যগগণ। এ সময়েই তিনি ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন নিবিড়ভাবে। তার সেসময়ের লেখা ডায়েরি প্রকাশিত হলে জানা যায়, ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়কেও স্কলারলি তিনি নথিভুক্ত করছেন নির্মোহভাবে।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ মাসের ১১ তারিখে তাজউদ্দীন আহমদ তার ডায়েরিতে লিখেছেন, 'সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠেছি, সকাল ৭টায় সাধারণ ধর্মঘটের পক্ষে কাজ করতে বেরিয়ে প্রথমে গেলাম ফজলুল হক মুসলিম হলে। তোয়াহা সাহেব ও আমি একসঙ্গে কাজ করছি। রমনা পোস্ট অফিসের কাছে তোয়াহা সাহেব ও অন্য কয়েকজন পুলিশ কর্তৃক আটক হলেন। আমি গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হলাম। একটু পরে তোয়াহা সাহেবকে পুলিশ ছেড়ে দিল।

১২টায় পিকেটিং বন্ধ হলে ১টায় নাঈমউদ্দিন সাহেবের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সভা হলো। বেলা ২টায় সচিবালয় অভিমুখে মিছিল শুরু হলে পুলিশ হাইকোর্ট গেটের কাছে বাধা দিল। আমরা উত্তর গেটের দিকে রওয়ানা হলাম। তখনই পুলিশ লাঠিচার্জ করল। তোয়াহা সাহেবকে মারাত্মক মারধর করল, অন্যরাও মার খেল। কোথাও যেতে পারলাম না। সাড়ে ৩টায় সভার পর সবাই চলে গেল। শেখ মুজিব, শামসুল হক, মাহবুব, অলি আহাদ, শওকত, আনসার ও অন্যান্য ৬৯ জনকে আটক করে জেল হাজতে রাখা হয়েছে। ১৪ জন আহত হয়ে হাসপাতালে। সেন্ট্রাল জেল, কোতোয়ালি ও সূত্রাপুর থানা এবং হাসপাতালে তাদের সঙ্গে দেখা করলাম। ৮টায় হলে এলাম।'

১৯৫৪ সালে তরুণ রাজনীতিক তাজউদ্দীন আহমদ যুক্তফ্রন্টের এমএলএ হয়েছিলেন, পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের মতো ডাকসাইটে নেতাকে বিপুল ভোটে হারিয়ে। ১৯৬৬ তে ছয় দফা আন্দোলন বাস্তবায়নে বড় অনুঘটক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সাথী হিসেবে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্ব, পাকিস্তানি জান্তার সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা ও পূর্ব বাংলার অসহযোগ আন্দোলনে রেখেছেন অভূতপূর্ব নির্মেদ ভূমিকা। এই সময়েই তিনি নিজেকে সর্বক্ষণ আড়ালে রেখে, অনুচ্চ কণ্ঠে, লক্ষ্যস্থিরভাবে এগিয়ে চলেছেন আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে।

তৃতীয় ধাপ: ২৫ মার্চ ১৯৭১ - ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: ১৯৭১ সালের এই নয় মাস তাজউদ্দীন আহমদের জীবনের তৃতীয় ধাপ। এই নয় মাসেই তাজউদ্দীন আহমদ এক অসাধ্য সাধন করেন। ছুঁয়ে যান জীবনের শ্রেষ্ঠতম অর্জনের এক মাইলফলক। পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে, বঙ্গবন্ধুর নামে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধে, প্রবাসে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের প্রতিটি ক্ষণ ছিল ইতিহাসের এক আকর ঘটনা। তার প্রতিটি ছত্রে ছড়িয়ে আছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা, তাজউদ্দীন আহমদ, তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা এবং বাংলাদেশের প্রথম সরকার।

চতুর্থ ধাপ: ১৯৭২-১৯৭৫: বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশে ফিরে আসার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিলে তাজউদ্দীন আহমদ সেই মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। দুই বছর নয় মাস পরে ২৬ অক্টোবর ১৯৭৪ মন্ত্রীত্বের পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। স্বাধীন দেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী হিসেবে দেশ পুনর্গঠনে অন্যতম ভূমিকা রাখেন তিনি। সেসময়ে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদে না থাকলেও দল ও সরকারের কাজ নিয়ে আত্মবিশ্লেষণ করতেও তিনি পিছু পা হননি। নীতির সঙ্গে কখনো আপস করেননি। ফলে দল, সরকার, আন্তর্জাতিক মহলে প্রিয়ভাজন হওয়ার বদলে তিনি অনেকের বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন।

১৯৭৪ সালের ২০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলের সমাপণী অধিবেশনে দলীয় নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে এক সুদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। সেখানে তিনি বলেছিলেন, 'সবাই বলে চোর, চোর, চোর। তবে চুরি করে কে, কে তারা? আমি তো এই পর্যন্ত শুনলাম না বিগত দুবছরে, কোনো কর্মী এসে বলেছে যে, আমার চাচা ওই রিলিফের চাল চুরি করেছে। এমন তো কেউ বলেনি। বরং পল্টন ময়দানে বক্তৃতা করে দাবি করেন, দুর্নীতি ধরে ফেলতে হবে, আর দুর্নীতির অভিযোগে কেউ ধরা পড়লে বাড়িতে এসে বলেন তাজউদ্দীন ভাই আমার খালু ধরা পড়েছে, উনাকে ছেড়ে দেন। আমি বলি যে, আপনি না বক্তৃতা করে এলেন? উত্তর দেন বক্তৃতা করেছি সংগঠনের জন্য, আমার খালুরে বাঁচান। এই হলো বাংলাদেশের অবস্থা। কোথায় সামাজিক বয়কট? দুর্নীতি যারা করে তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক বয়কট করতে হবে।'

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করার পর তাজউদ্দীন আহমদকে তার অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে কুখ্যাত জেল হত্যার শিকার হয়ে তাজউদ্দীন আহমদের জীবনাবসান ঘটে।

তাজউদ্দীন আহমদ অর্থনীতি ও আইনের ছাত্র হলেও বিশ্ব ইতিহাসের পঠন ছিল তার করায়ত্তে। সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে তার সহকর্মীদের অনুপ্রাণিত করতেন এই বলে যে, 'আসুন আমরা এমনভাবে কাজ করি ভবিষ্যতে যখন ঐতিহাসিকেরা বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করবে তখন যেন আমাদের খুঁজে পেতে কষ্ট হয়।'

তিনি নির্দ্বিধায় বলতেন, 'মুছে যাক আমার নাম, তবু বেঁচে থাক বাংলাদেশ।' - সূত্র: অনলাইন

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com