জীবনে আনন্দ, ফুর্তি, আড্ডা ও নির্মল বিনোদনের ভীষণ প্রয়োজন
প্রকাশের সময় : 2022-01-26 11:16:45 | প্রকাশক : Administration
খুজেস্তা নূর-ই নাহারিন: অফিসে একজন এলেন নতুন একটি বিজনেস প্রপোজাল নিয়ে। কিন্তু আমি এতো ব্যবসা দিয়ে কি করবো, এতো কষ্ট করার প্রয়োজনই বা কি। কেনইবা করবো? আমার একমাত্র কন্যা শ্রেয়ার অর্থাৎ বোনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তাঁর ভাই নিয়েছে। ছেলেটি বিগত ৪ বছর যাবত চাকরি করছে, সাথে মায়ের মতো শেয়ার বিজনেস। যদিও কানাডার পুঁজি বাজার আমাদের দেশের পুঁজিবাজারের মতো এতোটা অরক্ষিত এবং অস্বচ্ছ নয় কিন্তু তবুও ভয় পাই, ছেলেকে নিষেধ করি। কে জানে কখন বিট কয়েন অন্যান্য ভার্চুয়াল কয়েন কিংবা অন্য মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির শেয়ারগুলোর দর পতন শুরু হয়।
ফিনেন্স এবং ইকোনমিকস নিয়ে পড়াশোনা করা ছেলে বলে কানাডা চলে আসো। এখানে এসে মেধাটাকে কাজে লাগাও। চল দু’জন একসাথে নতুন কিছু করি। কিন্তু দেশ থেকে একেবারে চলে যেতে মন চায় না। আব্বা নেই, আম্মা নেই, টিংকু নেই। ছেলে-মেয়ে কানাডা থাকে। শাড়ি, গহনা, জুতা, ঘড়ি কিংবা ব্যাগের কোনো শখও নেই। জীবনের অনেক প্রয়োজন এখন ফুরিয়ে গেছে। কার্টিয়ারের একটি চশমা পরার শখ ছিল খুব, ছেলে ঈধৎঃরবৎ সহ জধু.ইধহ ও গঙঘঞ ইখঅঘঈ এর চশমা কিনে দিয়েছে এবার। প্রথম যখন ডাক্তার চশমা পড়তে বললেন, কি ভীষণ মন খারাপই না হয়েছিল আমার। অথচ সময় সব অনুভূতিগুলোকে পাল্টে ফেলে, মেনে নিতে শেখায়।
একসময় ৪ ইঞ্চি উঁচু জুতা পরার শখ ছিলো, তখন আমি ৫ ফিট ১১ ইঞ্চি লম্বা হয়ে সবার মাথা ছাড়িয়ে যেতাম। বিদেশ গেলেই জুতার দোকানে ঢুকে উঁচু হিলের স্যান্ডেল কিনতাম। টিংকু রেগে যেয়ে বলতো, ‘মেয়েদের এতো লম্বা ভালো লাগে না।’ আমি ওর সমস্যাটা বুঝতাম, কিন্তু আমার তাতে দায় নেই। সময় তার প্রতিশোধ নিয়েছে, সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতার গুড়েবালি। ওজন এখন বিদ্রোহ করে, এক ইঞ্চি হিলও পরতে পারি না আর। আজ চিন্তা করছিলাম বয়সের সাথে সাথে প্রয়োজন ফুরিয়ে যেতে থাকে তবুও কেন টাকার জন্য মানুষের এতো কাঙ্গালিপনা, এতো লোভ আর দুর্নীতি?
পুরো করোনাকাল প্রায় ২ বছর কেবল চারটি সূতির সালোয়ার কামিজ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পড়ে জেনেছি আমার ৫ আলমারি ভর্তি এতো শাড়ির আসলে কোনো প্রয়োজন ছিলো না। টিংকুর ক্যান্সার ধরা পরার সাথে সাথে সমস্ত গহনা ব্যাংকের দুই লকারে আবদ্ধ করে রেখেছিলাম। আজ পর্যন্ত বের করার ইচ্ছে হয়নি, এক যুগ ধরে তারা লকারেই ঘুমিয়ে আছে। এক সময় বাসায় এতো বেশি লোক সমাগম হতো যে ৮টি ডিনার সেট কেনার প্রয়োজন পড়েছিলো। এখন সব অযত্ন অবহেলায় অপ্রয়োজনীয় ঘরের কোণে পড়ে থাকে। জীবনের বেশিরভাগ কেনা কাটাই মূলত অপচয়।
একার জীবনে এতো বেশি আড়ম্বরতার আসলে কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষ এতো টাকা দিয়েইবা কি করে? বড় কোনো অসুখ ছাড়া টাকা খরচ করারও তো জায়গা নেই, যদি না আপনি নিতা আম্বানির মতো সোনা মিশ্রিত পানি পান না করেন। কতোক্ষণ ঘরে থাকেন? কতোক্ষণ দামি পোশাক পড়ে থাকেন? একটি দামি ঘড়ি বা গহনা আসলে কি পরিবর্তন আনে আপনার জীবনে? করোনা কালে জননিষিদ্ধ জীবনে অনলাইন ঘেঁটে একের পর এক শাড়ি কিনেছি। পড়া তো দূরের কথা কোনোটি এই পর্যন্ত খুলেই দেখা হয়নি। অবাক বিষয় হচ্ছে, ইচ্ছেটাই হয়নি।
ছোট হয়ে আসছে জীবন, সেই সাথে খরচ। আমি অতি সাধারণ মানুষ, অল্পতেই খুশি হই, শত নাই এর মাঝেও সুখী হওয়ার ক্ষমতা রাখি। দোয়া করবেন ভবিষ্যতে কোনো বড় খরচের যেন প্রয়োজন না পড়ে। মানুষের জীবনে আনন্দ, ফুর্তি, আড্ডা, নির্মল বিনোদনের প্রয়োজন আছে। যা আপনার বেঁচে থাকার ফুয়েল। এই জন্য চেষ্টা করতে হয়, নিজেকে যতœ আর সমাদর করতেও জানতে হয়। নিজে নিজেকে আনন্দ দিতে জানতে হয়, সম্মান করতে হয়, ভালোও বাসতে হয়। চেষ্টা করতে হয় ভিন্ন উপায়ে জীবনে বৈচিত্র্য আনার। একঘেয়েমি জীবন মানুষকে ভেতর থেকে মেরে ফেলে, দম বন্ধ লাগে। এই গুণগুলো না থাকলে আপনি অপরকে বুঝবেন না, অপরের জন্য কিছু করতেও পারবেন না।
জীবনের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে অপরকে বুঝতে পারা। তাঁর অনুভূতিগুলোর প্রতি সম্মান জানানো। আজ আমি আপনি প্রচণ্ড অসুস্থ থাকতে পারতাম, আগুনে ঝলসে যেতে পারতাম, এক্সিডেন্টে পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতে পারতাম কিংবা ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর লঞ্চ ডুবিতে পানিতে ডুবে যেতে পারতাম। আলহামদুলিল্লাহ্ এখন পর্যন্ত ভালো আছি। আসুন শুকরিয়া জানাই। - ফেসবুক থেকে