ভূমি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন
প্রকাশের সময় : 2022-01-26 11:30:18 | প্রকাশক : Administration
মানুষের জীবন ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। এমনকি একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নও নির্ভর করে ভূমির উপযুক্ত ব্যবহারের ওপর। ভূমি মানুষের জন্মগত অধিকার হলেও ভূমির ওপর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থাপনা কখনই স্বচ্ছ ছিল না। অন্যদিকে ভূমির ব্যবস্থাপনা সুদীর্ঘকাল ধরে এতদঞ্চলের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের মুখ্য ভিত্তি হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে এবং এর ইতিহাসও বেশ প্রাচীন। ভূমি ব্যবস্থাপনার ইতিহাস মূলত আদিযুগ, হিন্দু আমল, মুসলিম আমল, ব্রিটিশ আমল এবং বর্তমান আমল (পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমল) পর্যন্ত বিস্তৃত।
ভূমি ব্যবস্থাপনা মূলত ভূমির ক্রয়-বিক্রয়, সঠিক জরিপ, জমা-খারিজ-নামজারি, খাজনা বা ভূমি উন্নয়ন কর আদায়, খাস, পরিত্যক্ত জমি লিজ প্রদান, জলমহাল হাট-বাজারের ইজারা প্রদান, উত্তরাধিকার সূত্রে জমি হস্তান্তর, খায়-খালাসি বন্ধক, জমির বিপরীতে ঋণ গ্রহণ ইত্যাদি। আর এজন্য জনগণকে প্রতিনিয়ত ইউনিয়ন ভূমি অফিস এবং উপজেলা ভূমি অফিস তথা এসিল্যান্ড অফিসে যেতে হয়। তাই দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো অত্যন্ত গভীরভাবে ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত।
বস্তুত, বাংলাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনা একটা জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলে আসছে। বহুদিন ধরে লক্ষ করা হচ্ছে, এ সেক্টরকে কেন্দ্র করে অনিয়ম-দুর্নীতি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মামলা-মোকদ্দমার সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছিল। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন ৬৭ শতাংশ মামলার সূত্রপাত জমির মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে। ভূমির এ জটিল প্রক্রিয়া ও অবস্থার কথা বিবেচনায় নিয়ে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের ভূমিসেবা আধুনিকায়ন ও জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ই-নামজারি সফটওয়্যার তৈরি করা হয়।
বর্তমানে ৪৮৮ উপজেলা সার্কেলে ভূমি অফিসে ই-নামজারি সিস্টেম চালু করা হয়েছে এবং ক্রমেই ই-নামজারির সুবিধাভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভূমি ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে জনগণের সেবাপ্রাপ্তি সহজীকরণের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও অঙ্গীকার নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় ও ভূমি সংস্কার বোর্ড একযোগে কাজ করছে। বিশেষত জনগণের জন্য ভূমিসংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য অবারিতকরণ, ভোগান্তিহীন ওয়ানস্টপ সেবা প্রদান, ভূমি প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার কার্যক্রমে অধিকতর স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, জবাবদিহিতা ও সময়াবদ্ধ কাঠামোর আওতায় আনার পাশাপাশি ভূমিসংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমা, বিরোধ ও বিভিন্নমুখী জটিলতা ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা এগুলোর অন্যতম।
এছাড়া পর্যায়ক্রমে দেশের ৫০৭টি উপজেলা সার্কেল এবং ৩ হাজার ৪৫৭টি পৌর-ইউনিয়ন ভূমি অফিসে আইটি নেটওয়ার্কিং স্থাপনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষত প্রশাসনিক ও ভূমিসংশ্লি−ষ্ট সব সেবা উপজেলা এবং ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে তৃণমূল পর্যায়ে স্বল্প সময়ে ও সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে এ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। জমি বিষয়ক জটিলতা ও মামলা-মোকদ্দমা থেকে নিষ্কৃতি এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ইতিবাচক ক্ষমতায়নসহ তাদেরকে প্রতারণার হাত থেকে মুক্তি প্রদানের লক্ষ্যে এ কার্যক্রম সর্বমহলে প্রশংসিত হচ্ছে।
মূলত ভূমি অফিসে আজও যে বিষয়গুলো মানুষের সেবাপ্রাপ্তিতে বিলম্বের বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তার অন্যতম হল নামজারি ও রেকর্ড হালনাগাদ করা। আর এটার ওপর ভিত্তি করে জমির স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর দেশে প্রায় ২৫ লাখ নামজারি মামলা হয়। দীর্ঘদিনের জঞ্জাল অপসারণ করে সেবা প্রদান করার ক্ষেত্রে কিছুটা বিলম্ব হওয়া স্বাভাবিক। তবে আশার কথা, এখন নামজারির সামগ্রিক প্রক্রিয়াটি ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনার ফলে নামজারির সব মামলা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে।
উপজেলা ভূমি অফিস ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কর্মচারীরা ই-নামজারির পদ্ধতির মাধ্যমে এখন সহজে, দ্রুততম সময়ে ও নির্ভুলভাবে অনলাইন নামজারি কার্যক্রম (অনলাইনে আবেদন গ্রহণ, ট্র্যাকিং ও প্রসেসিং, অনলাইন পেমেন্ট, স্বয়ংক্রিয় অর্ডারশিট-নোটিফিকেশন-খতিয়ান প্রস্তুত, ডিসিআর প্রদান ও স্বয়ংক্রিয় রেজিস্টার প্রস্তুত) সম্পন্ন করতে পারছেন। সেবাপ্রত্যাশী নাগরিকরা ঘরে বসে কিংবা যে কোনো ডিজিটাল সেন্টার থেকে নামজারির আবেদন জমা দেয়ার পাশাপাশি আবেদনের সর্বশেষ অবস্থা জানতে পারেন।
এছাড়া ভূমি জরিপ ক্ষেত্রেও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে আরএস (রিভিশন সেটেলমেন্ট) জরিপের খতিয়ানের কপি যে কোনো স্থান থেকে মাত্র ৫ মিনিটে অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে। যার প্রায় ৩২ হাজার মৌজার জরিপে প্রকাশিত ১ কোটি ৪৬ লাখ আরএস (১৯৬৫ সাল থেকে চলমান জরিপে প্রস্তুত করা খতিয়ান) খতিয়ানের তথ্য অনলাইনে পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
জরিপ কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পর চূড়ান্তভাবে গেজেটে প্রকাশিত খতিয়ানও অনলাইনে আপলোড করা হচ্ছে। খতিয়ান নিয়ে সাধারণ মানুষের হয়রানি ক্রমেই দূর হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে জমির মালিককে খতিয়ানের কপি পেতে ভূমি অফিসে বা ডিসি অফিসে এত দৌড়াতে হবে না। একইভাবে ভূমির নামজারির ক্ষেত্রে জনগণ যেন কোনো ভোগান্তি ও অযথা হয়রানির শিকার না হয়, সে কারণে ই-নামজারি ব্যবস্থাকে দেশের সব পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়ার নিরলস প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
বর্তমানে ভূমি প্রশাসন শুধু ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বরং ভূমির মালিকানা নিশ্চিতসহ জনগণের দ্বারপ্রান্তে সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য একটি দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। পরিশেষে বলা যায়, যেসব নির্ণায়কের মাপকাঠিতে ভূমি ব্যবস্থাপনায় যুগোপযোগী ও আধুনিককায়নের ধারা প্রচলন করা সম্ভব হয়েছে ওইসব নির্ণায়ককে সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশের সর্বাধিক বৃহত্তর সেক্টর হিসেবে পরিচিত ভূমিসেবার ক্ষেত্রগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে আরও উন্নত ও সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন।
সে ক্ষেত্রে ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনের কোনো বিকল্প নেই। কেবল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বহুমুখী ব্যবহার করে ইউনিয়ন, উপজেলা এবং জেলা সদর দফতরগুলো ভূমি সম্পর্কিত ওয়ানস্টপ সার্ভিস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে। - সূত্র: অনলাইন