লবণ বিক্রেতা থেকে মেঘনা গ্রুপের মালিক
প্রকাশের সময় : 2022-02-17 09:32:22 | প্রকাশক : Administration
একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার পিছনে একটি গল্প থাকে। তেমনি এক গল্প হলো এটি। অথবা তারও কিছু বেশি। এই গল্প রূপ কথাকে হার মানানো এক অপ্রতিরোধ্য কিশোরের জীবনযুদ্ধে জয়ী হবার গল্প। গ্রামের হিমেল বাতাস গায়ে মেখে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে বেড়ে ওঠা কিশোরের নাম মোস্তফা কামাল।
জন্ম ১৯৫৫ সালে, কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কন্কা পৈত গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে। বাবা ছিলেন সাধারণ সরকারি চাকুরে। একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুটির লেখাপড়ায় হাতেখড়ি গ্রামেরই এক পাঠশালায়। নিজ গ্রামের হাইস্কুলে পাঠশেষে ভর্তি হলেন বাড়ি থেকে সাত মাইল দূরের একটি কলেজে। এতটা
পথ প্রতিদিন হেঁটে যেতে-আসতে প্রায়ই থমকে যেত কিশোর কামালের পা দু-খানা। প্রয়োজন একটি সাইকেলের।
ক্লান্ত শরীরে প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা কষ্টসাধ্য হয়ে যেত। সদ্য অবসরে যাওয়া বাবার পক্ষে তার এই সাইকেলের আবদারটি পূরণ করা সম্ভব হলো না। অনেকটা অভিমান করেই ঘর ছাড়লেন কিশোর মোস্তফা কামাল। তখন কে জানত তাঁর এই অনিশ্চিত যাত্রাই একদিন পরিণত হবে স্বপ্নযাত্রায়!
মোস্তফা কামাল চলে এলেন ঢাকায়। গুলিস্তানের ট্রাফিক ব্যারাকে থাকা তাঁর এক ভাইয়ের কাছে উঠলেন প্রথমে। কিছুদিন এখানে থাকার পর
যাত্রাবাড়ীতে একটা লজিং-এ থাকার ব্যবস্থা করেন। এরই মধ্যে তিনি একটি চাকুরি জোগাড় করে ফেললেন, হাজী মুহাম্মদ হোসেন সাহেবের চক বাজারস্থ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। বেতন মাসে ১৭৫ টাকা। যাত্রাবাড়ী থেকে প্রতিদিন বাসে করে আসতেন গুলিস্তান, খরচ চার আনা।
তারপর গুলিস্তান থেকে হেঁটে কর্মস্থলে পৌঁছাতে হতো, যা ছিল খুবই কষ্টকর। তাই, পুনরায় লজিং-এর ব্যবস্থা করলেন পুরান ঢাকার বেগম বাজারের এক বাসায়। নানান চড়াই-উতরাই-এর মাঝেই চলতে থাকে তাঁর ব্যবসার প্রস্তুতিকাল। শত প্রতিক‚লতার মধ্যেও এই অদম্য মানুষটি ঠিকই তাঁর জীবিকা-যুদ্ধের পাশাপাশি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে সক্ষম হন।
ব্যবসার প্রেরণা কিন্তু পান অনেক আগেই, চাচার কাছ থেকে। গ্রামের সাপ্তাহিক হাটে তাঁর চাচা সুপারির ব্যবসা করতেন। মোস্তফা কামাল বিকালে কিংবা সন্ধ্যায় চাচার সুপারির ব্যবসায় সময় দিতেন। সেখান থেকেই ব্যবসার প্রতি তাঁর ঝোঁক সৃষ্টি হয়। তাঁর সেই ব্যক্তিগত সংগ্রামের সময়টায় শুরু হয় এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। তাঁর এলাকা সীমান্তবর্তী হওয়ায় তিনি মানুষের দুঃসহ কষ্ট নিজের চোখে দেখেছেন।
সে-সময় কেরোসিন, লবণ, মরিচ এসব নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য খুবই দুষ্প্রাপ্য ছিল। বাড়ি থেকে নদী পার হয়ে ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে হোসেনপুর রেলস্টেশন যেতেন। ওখান থেকে পনের-ষোলো কেজি ওজনের কেরোসিনের টিন মাথায় করে নিয়ে যেতেন বিক্রির জন্য। এতে ভালো আয় হতো। শুধু তা-ই নয়, আরো দূরে লাকসাম থেকে লবণ কিনে এনে বিক্রি করতেন।
সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় মাঝে মধ্যেই পাকিস্তানিরা অতর্কিত হামলা চালাত। ফলে পাঞ্জাবি, আলবদর, রাজাকারদের ভয়ে এসব কাজে কেউ যেতে চাইত না। কিন্তু তিনি এই চ্যালেঞ্জটা নিলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন জীবন-জীবিকার সংগ্রামে। কেননা সেই ছোট বেলায়ই যে ব্যবসার স্বপ্ন রোপিত হয়ে গেছে তাঁর কিশোর মনে।
যুদ্ধশেষে ঢাকায় ফিরে এসে চাকরির পাশাপাশি টুকটাক ব্যবসা শুরু করেন। ঘুরতে থাকেন এ-জেলা ও-জেলায়। এরপর পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে ওয়ার্কিং পার্টনারশিপে পুরোদমে ব্যবসা শুরু করেন। আটা-ময়দা থেকে শুরু করে কোহিনূর কেমিক্যাল, নাবিস্কো বিস্কুট এসবের পারমিট যাদের ছিল, তাদের থেকে কিনে মৌলভী বাজারে নিয়ে বিক্রি করলে কিছু মুনাফা হতো।
এরপর মোস্তফা কামাল এবং তাঁর বন্ধু আশিকুর রহমান টেন্ডারে ছয় হাজার টাকা করে দুটি বক্স ওয়াগন মাইক্রোবাস কিনেন। গুলিস্তান থেকে ফার্মগেট হয়ে মিরপুর রোডে মাইক্রোবাস দুটি চালাতেন। কিন্তু সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি হওয়ার কারণে প্রায়ই নষ্ট হয়ে যেত। ফলে এই ব্যবসা কোনোভাবেই লাভজনক হচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে এ ব্যবসা ছেড়ে ফ্লাইং ব্যবসায় নিয়োজিত হন।
মৌলভীবাজারে একজনের সঙ্গে পার্টনারশিপে ব্যবসা শুরু করেন। হাতে পুঁজি না থাকায় ওয়ার্কিং পার্টনার হিসেবে যুক্ত হন। সেখান থেকে কিছু উপার্জন হয়। তারপর ঢাকা থেকে তেল, ডালডা এসব খাদ্যপণ্যের যারা ডিলার ছিল তাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে নিয়মিত বিক্রি করতেন। এরই মাঝে ব্যাংক লোন নিয়ে বিদেশ থেকে কিছু পণ্য আমদানি করেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, দেশের বাইরে থেকে আনা পণ্যের গুণগত মান কিছুটা নিম্নমানের হওয়ায় আটকে যায় বন্দরে।
বিভিন্ন জটিলতা কাটিয়ে একসময় পণ্য পেলেন ঠিকই, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। যা ক্ষতি হবার তা হয়েই গেছে। দুর্ভাগ্যের কাছে হার মানলেন না মোস্তফা কামাল। ঘুরে দাঁড়াবার প্রত্যয়ে নতুন উদ্যম নিয়ে আবার শুরু করলেন ব্যবসা। তখন সহকর্মীদের নিয়ে ছোট ছোট টিনের জারে এক কেজি দুই কেজি করে তেল ফিলিং করতেন। এগুলো ঢাকা শহর, এমনকি গাজীপুরের বিভিন্ন ‘কসকর’ দোকানে বিক্রি করতেন। তিনিসহ চার জন ছিলেন একসঙ্গে এই ব্যবসায়।
এই কাজ করতে করতেই তাঁদের মাথায় একটা ধারণা এলো, এই পণ্যের কাঁচামাল কিনে এনে যদি দেশেই পরিশোধন করে বিক্রি করা যায়, তাহলে এটা কেবল নিজেদের লাভই নয়, দেশেরও সাশ্রয় হবে, কিছু লোকের কর্মসংস্থানও হবে। এ ভাবনা থেকেই শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার মানসে মেঘনা ঘাটে একটু জায়গা ক্রয় করেন।
কিন্তু শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন টাকা, মানে অন্তত একটি ব্যাংক লোন। সেটা আর কপালে জুটল না। পরবর্তী সময়ে যখন তিনি তেলের কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন তখন অবশ্য ব্যাংক লোন জুটেছিল। ব্যাংক লোনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত তহবিল গঠন করে শুরু করেছিলেন এই ব্যবসা। ১৯৮৯ সালে মেঘনা গ্র“প প্রথম যে শিল্পে হাত দেয় তা ছিল ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনারি।
শুরুটা ছিল খুবই ছোট পরিসরে। নারাছুগঞ্জের মেঘনা ঘাট ঘেঁষে গড়ে ওঠা সেই ছোট পরিসর। বৃহৎ হতে খুব বেশি সময় নেয়নি। একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০টির অধিক শিল্প-প্রতিষ্ঠানে। প্রায় ৫০০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই শিল্পাঞ্চলে উৎপাদিত হয় নানা ধরণের পণ্যসামগ্রী। দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারে বড় অংশীদার মেঘনা গ্রুপ।
তাদের পণ্য তালিকায় রয়েছে মিনারেল ওয়াটার, ভোজ্যতেল, আটা, ময়দা, সুজি, চিনি, গুঁড়াদুধ, কনডেন্সড মিল্ক, লবণ, চা, মসলা ইত্যাদি। শুধু ভোগ্যপণ্যের বড় অংশীদার হিসেবেই যে মেঘনা গ্রুপের অবস্থান তা নয়, এর বাইরে অনেক বড় বড় খাত ও ভারী শিল্পে বিনিয়োগকারী বা অংশীদারও এই গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। এর মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট, কাগজ, পণ্যবাহী জাহাজ, শিপ বিল্ডিং, বিদ্যুত উৎপাদন, এভিয়েশন, স্টিল, আর্থিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।
রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড বা লঞ্চঘাট জনবহুল এই সব এলাকায় মানুষের হাতে হাতে ‘ফ্রেশ’-এর পানির বোতল দেখা যায়। বোধহয় আস্থা এবং সাশ্রয় দুই বিবেচনায় এই ব্যাপারটা ঘটে। এত মানুষের হাতে আর কোনো ব্র্যান্ডের পানির বোতল দেখা যায় না। এর বাইরে ‘ফ্রেশ’ আটা-ময়দা বা তেল প্রায় প্রতিটি মুদি দোকানেই পাওয়া যায়। বিক্রিও চোখে পড়ার মতো।
মেঘনা গ্রুপের পণ্যের প্রসার দেশের বাজারে শুধু নয়, ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বাইরেও। মেঘনার ‘ফ্রেশ’ব্র্যান্ডের পণ্য দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায়ও রফতানি হচ্ছে। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য তিনি এক বড় প্রেরণার উৎস। এদেশে যাঁরা এক হাতে, নিজের যোগ্যতাতেই এতদূরে এসেছেন, তাঁদের অন্যতম হলেন মেঘণা গ্রুপের চেয়ারম্যান জনাব মোস্তফা কামাল। - সূত্র: অনলাইন