নির্বাচন, নির্বাচন আর নির্বাচন!!

প্রকাশের সময় : 2022-02-23 12:32:57 | প্রকাশক : Administration
নির্বাচন, নির্বাচন আর নির্বাচন!!

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীন

 

নির্বাচনের দেশ বাংলাদেশ। ব্রিটিশ শাসনামলে এই ‘নির্বাচন’ নয়, ‘নির্বাসন’ শব্দটি বহুল প্রচলিত এবং ব্যবহৃত শব্দ ছিল। ব্যাপারটি উল্টে গেছে পাকিস্তান আমল থেকে। নির্বাসন নয়, বরং নির্বাচন শব্দটি বাজার পেয়েছে। মানুষের মুখে মুখে এসেছে। উৎসবমুখর এক মহা আমেজ নিয়ে এসেছে। এসেছে সব জায়গায়। কোথায় নির্বাচন নেই! নির্বাচন সর্বত্র বিদ্যমান। কোনদিন নির্বাচন নেই? বছরের সবদিনই নির্বাচন আছে। সারাদেশের কোথায়ও না কোথায়ও আছে।

সারাদেশের সব জায়গায়, সর্বত্র নির্বাচন আছে। আছে নির্বাচনী আমেজও। বাংলাদেশে স্কুলের শিক্ষার্থীদের ক্লাস ক্যাপ্টেন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন; আমেজ নেই এমন একটি নির্বাচনও নেই। সদ্য সমাপ্ত চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনেও আমেজ ছিল। বলা যায় ভাবনার চাইতেও বেশি ছিল সেই আমেজ। আমেজের চাপে কিভাবে শিল্পীদের সামাজিক ইমেজ টুকটুক করে ড্যামেজ হচ্ছিল সেটুকু পর্যন্ত বোঝার অবস্থায় ছিল না শিল্পী সমাজ। বরং মেতে উঠেছিল নির্বাচনী উৎসবে।

যেন কোন সমিতির নির্বাচনে নয়, তারা আছেন জাতীয় নির্বাচনে। পাশ করেই ক্ষমতায় যেয়ে দেশকে উদ্ধার করে ফেলবেন। তাদেরই বা দোষ কি! তারা কেবল নিজেরা নন, বরং তাদেরকে নিয়ে মেতে ছিল সবাই। আলোচনা ছিল সর্বত্র। ঘরে বাইরে, দেশে বিদেশে বিয়ে কিংবা চায়ের আড্ডায় আলোচ্য বিষয় ছিল কেবল একটি; জিতবে এবার কোন প্যানেল! প্যানেল নিয়ে চ্যানেলগুলোও দেশবাসীকে পাগল করে ছেড়েছিল। পাশাপাশি নিজেরাও পাগল হয়েছিল।

পাগল নয় তো কি! লাইভ আর লাইভ। সারাদিন লাইভের ছড়াছড়ি। একটি সমিতির নির্বাচনী প্রচার ক্ষণে ক্ষণে লাইভে দেখলো দেশবাসী। চ্যানেলের হাতে খবরে দেখাবার মত আর কোন আইটেম কি ছিল না? আইটেমের কি এতই অভাব পড়েছিল? বুঝলাম সমিতিটি সাদামাটা এবং সাধারণ নয়; বরং রঙিন এবং অসাধারণ। কিন্তু এই শিল্পী সমিতির সঙ্গে দেশবাসীর আদৌ কি কোন সম্পর্ক আছে? কিংবা তাদের এই নির্বাচন দেশের আর্থসামাজিকতার কোথায়ও কি সামান্য অবদান রাখবে? অথবা এই সমিতির নির্বাচনী ফলাফল দেশবাসী না জানলে, বা নির্বাচিত নেতাদের না চিনলে কোন সমস্যা হবে?

কোন সমস্যাই হবার কথা নয়। দেশের আর্থ সামাজিকতায় সমিতিটির আসলে কোন ভূমিকাও নেই। এমনকি চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নেও কোন ভূমিকা রাখার নজির এই সমিতি আজো দেখাতে পারেনি। খুবই কদাচিত হাতেগোণা দু’চারজন দুঃস্থ শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানো এবং বছরে মহাধুমধামে একটা পিকনিক আয়োজন করা ছাড়া এই সমিতিকে দেশবাসী আর কিছু করতে দেখেছে বলেও এই অধমের মনে পড়ছে না। তারপরও মিডিয়া লেগে গেল। নিউজ আইটেমে এক নাম্বারে রাখা হলো সমিতিটির নির্বাচনী নিউজকে। আসলে কেবল এই সমিতি নয়, শত শত সমিতির নির্বাচন বাংলাদেশটাকে গ্রাস করে ফেলেছে। খবরের কাগজে কিংবা টিভির পর্দায় সে সব নিউজের শিরোনাম হয় না হয়ত। কিন্তু প্রতিদিন দেশের কোথায়ও না কোথায়ও নির্বাচন হয়। উৎসবমুখর পরিবেশেই হয়। সত্যি বলতে, বাংলাদেশের সকল সেক্টরে যেমনি সমিতি ঢুকে গেছে। তেমনি সমিতির নির্বাচনও বাংলাদেশটাকে খেয়ে ফেলেছে। দেশে এখন ভিক্ষুক সমিতির নির্বাচন হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সিনেমা, নাটক, থিয়েটার, রিক্সা মালিক, রিক্সা শ্রমিক, ট্রাক মালিক, ড্রাইভার, দোকানদার, বাজার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংক মালিক, কর্মচারী কর্মকর্তা ইত্যাদি সকল পেশায় নির্বাচন হয়। এমন কোন ক্যাডার নেই যেখানে নির্বাচন নেই।

এমনকি ফ্ল্যাট মালিক সমিতিতেও নির্বাচন হয়। আর ঢাকাস্থ অমুক উপজেলাবাসীর নির্বাচন, তমুক জেলাবাসীর নির্বাচন তো বহু আগের কথা। এসব সমিতির নির্বাচন আর সমিতি দেশে যেমন তেমন, বিদেশে প্রকট আকার ধারণ করেছে। ধরা যাক আমেরিকার কথা। ওখানে বাংলাদেশের সব জেলা, উপজেলাবাসীর সমিতি আছে। কেবল একটা নয়, একেক জেলা বা উপজেলার আবার একাধিক সমিতিও আছে। ক্যাডার ভিত্তিক সমিতি আবার ধর্ম ভিত্তিক সমিতিও আছে। যেমন টরেন্টো নিবাসী বাংলাদেশী মুসলিম প্রকৌশলী পরিষদ এবং বাংলাদেশী হিন্দু প্রকৌশলী পরিষদ।

বাকী রাখেনি কিছুই। রাখবেই বা কেন! এ দেশের মানুষ পাওয়ার প্র্যাকটিসে বিশ্বাস করে। এসবই হচ্ছে পাওয়ারে যাবার সমিতি। কোন রকমে একটা সমিতি করে তার নেতৃত্বে যেতে পারলেই ধরে নেয়, সে পাওয়ারে আছে। সমাজ তথা রাষ্ট্রব্যবস্থা তাকে গোণায় ধরে, সমীহ করে। আসলেই করে। করে বলেই সবাই নেতা হতে চায়। আর সমিতির নেতা হলেই মূল পাওয়ারের কেন্দ্রে পৌঁছানো যায়। এদেশে শ্রমের দাম নেই, শ্রমিকের দাম নেই। কিন্তু শ্রমবিহীন শ্রমিক নেতার দাম আছে। পাহাড় সমান দাম। শ্রমিককে ব্যবহার করে শ্রমিক নেতার পাহাড়সম দাম।

আর ক্ষমতা প্রত্যাশী এমনই পাহাড়সম নেতা হওয়ার জন্যেই এই নির্বাচনের আয়োজন। সাধারণকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে তথাকথিত অসাধারণ বানানোর নির্বাচন। এরা আর কিছু না পারুক, নির্বাচনী খেলাটা ভালই পারে। নির্বাচনী বৈতরনী পার হবার কৌশলটা ভাল করেই জানে। এরাই দেশের মানুষকে বুঝিয়েছে গণতন্ত্র মানেই নির্বাচন। নিজেরাও মনে করে গণতন্ত্র মানেই নির্বাচনী তন্ত্র। নির্বাচন থাকা মানেই গণতন্ত্র থাকা মনে করে। একমাত্র নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্রে আর কিচ্ছু লাগে না।

যে দেশে প্রকৃত গণতন্ত্রের প্র্যাকটিস হাজার বছরেও শুরু হয়নি, সে দেশে তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে নির্বাচনী কর্মকান্ডে আমিও নেমেছিলাম একবার। বিশাল সে আয়োজন। বয়স আমার দশ পেরিয়েছে। ক্লাস সিক্স এ উঠেছি কেবল। ক্লাস ক্যাপ্টেন নির্বাচন হবে। ছাত্রছাত্রী মিলে ভোটার সত্তর জন। ভবিষ্যতে পুরো স্কুলের ক্যাপ্টেন তথা নেতা হবার সমূহ সম্ভাবনা আমার ভাগ্যাকাশে উঁকি দিচ্ছে। আমি নড়েচড়ে বসলাম। একই বেঞ্চে বসা বন্ধুদের সাথে আলাপে বুঝলাম, দাঁড়ালেই আমি পাশ।

তবে পাশ নিয়ে কোন টেনশান না থাকলেও বাঁশ নিয়ে টেনশান ছিল। ভয়াবহ টেনশান। পাশ করলেই ক্লাসের সবাইকে জিলাপী খাওয়াতে হবে। এটা বাঁশ খাওয়ার চাইতেও বেশি কষ্টের ছিল আমার জন্যে। তাই আর দাঁড়াতে পারলাম না। সহপাঠী কিবরিয়াকে ভুলিয়ে ভালিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলাম। কিবরিয়া ধনীর দুলাল। সে দাঁড়াতেই পারে। জিলাপী খাওয়ানোর ক্ষমতা তার আছে। “কয় সের আর জিলাপী খাওয়াইন লাগবো? জিতলে খাওয়াইবাম” বলেই কিবরিয়া দাঁড়িয়ে গেল নির্বাচনে।

কপাল তার সুপ্রসন্ন হলো না। বাঁধ সাধলো একই ক্লাসে পড়া আমারই আপন ভাই। পিঠাপিঠি ভাই। ক্লাসের সহপাঠিনী মেয়েদের বুদ্ধিতে পড়েই দাঁড়িয়ে গেল। আমি তো হতবাক। শরীরে ঘাম ছোটা শুরু হয়েছে। তার পাশ ফেল নিয়ে আমার কোন ভাবনা নেই। ভাবনা কেবল জিলাপী নিয়ে। মা আমার ভাইকে জিলাপী কেনার টাকা দেবে না আমি নিশ্চিত। পাশ করলে সে কেমন করে জিলাপী খাওয়াবে ভাবতে ভাবতেই নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণায় সে উত্তীর্ণ হয়ে গেলো।

কেবল উর্ত্তীণ হলো না। নিরঙ্কুশ ভোটও পেল। তার অর্জন অসামান্য হলেও ভোটাররা বঞ্চিত হলো। জিলাপী খাওয়া থেকে বঞ্চিত হলো। ভাইয়ের পিছু পিছু ঘুরেও কেউই জিলাপীর ব্যবস্থা করতে পারলো না। অবশেষে তারা দলবেঁধে বিপক্ষে গেল। সবার মুখে রব উঠলো, ফকিররে ভোট দিয়া লাভ নাই। কিবরিয়ারে ভোটটা দিলেই ভালা হইতো। জিলাপী খাওন যাইতো।

চল্লিশ বছর পর সেই এলাকায় আজো জিলাপী খাওয়ার রেওয়াজ রয়ে গেছে। ভোটের জিলাপী; ভোটের মিষ্টি। আমার ছেলেবেলার সেই স্কুলের নির্বাচনে আজো মিষ্টি লাগে। শুধু ক্লাস ক্যাপ্টেন নির্বাচন নয়, পরিচালনা পরিষদের নির্বাচনেও লাগে। মহা ধুমধামে হয় মিষ্টির ছড়াছড়ি। বড় বড় রসগোল্লা। ভোটাররা কেন্দ্রে ঢোকবার আগে প্রার্থীদের নির্বাচনী ক্যাম্পে বসে ইচ্ছেমত সে সব খায়। খায় দামী সিগারেট এবং পানও।

দিন বদলের সাথে সাথে ওদের খাওয়ার সময় বদলেছে কেবল। আমাদের সময়ে ভোটের পর মিষ্টি খেত আর এখন খায় ভোটের আগে। কেবল মিষ্টি খায় না। টাকাও খায়। নগদ কচকচে টাকা। মিষ্টি স্বাস্থ্যের জন্যে নিরাপদ নয়। মিষ্টিতে সুগার থাকে। কিন্তু কচকচে নগদ টাকায় সুগার থাকে না। তাই টাকাই নিরাপদ।

আজকালকার নেতারাও ভোটারদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। তাই তারা বুদ্ধি করে ভোটারদের মিষ্টির পরিবর্তে নগদ টাকা দেয়। নগদ টাকা গোপনে দেয়, আবার সামনেও দেয়। লক্ষ্য একটাই। যেমন করেই হোক, পাশ করা লাগবে। নেতা হওয়া লাগবে। হোক না সে অভিনেতা। তবুও নেতা হওয়া লাগবে। নেতারাই যে বড় অভিনেতা তা আজকাল অভিনেতারাও বুঝে গেছে!!!     

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com