ঐতিহাসিক ৭ মার্চ: যেদিন স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের হলো
প্রকাশের সময় : 2022-03-09 14:44:52 | প্রকাশক : Administration
সঞ্জীব রায়: উদগ্রীব লাখো জনতার সামনে দাঁড়ালেন রাজনীতির মহান কবি। রেসকোর্স ময়দানের মহামঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি রচনা করলেন সেই অমর কবিতাখানি। যে কবিতার প্রতিটি লাইনে ধ্বণিত হলো বাঙালির প্রাণের দাবি, প্রতিটি স্তবক যেনো প্রাণের স্পন্দন। আবেগ আর অধিকারভরা কণ্ঠে, বীরদর্পে প্রিয় কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হলো বাঙালির প্রাণের ভাষা-স্বাধীনতা। সেদিন থেকেই স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।
হ্যা, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ এর কথা বলছি। সেদিনই তো এই বাংলার আপামর জনতাকে বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। স্বাধীনতা শব্দটিকে আমাদের প্রাণবীণার মূলসুরে পরিণত করেছিলেন। রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়েই বাঙালির জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে ওঠে স্বাধীনতা। যে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জাতির বীর সন্তানেরা শত্রুর বন্দুক, বুলেট, গ্রেনেডকে তুচ্ছজ্ঞান করে এগিয়ে গিয়েছিল মহাবিজয়ের পথে সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ডঙ্কা বেজেছিল ৭ মার্চে।
সেদিন বঙ্গবন্ধু কী বলবেন তা নিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা অনেক উৎকণ্ঠায় ছিলেন। অনেকেই সেদিনের জনসমাবেশে যাবার আগে নেতাকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু নেতা মনে মনে ঠিকই ভেবে রেখেছিলেন এই বাংলার আপামর মানুষকে তিনি কী দিকনির্দেশনা দিবেন। ভেবে রেখেছিলেন কী হুশিয়ারী দেবেন শাসকবাহিনীকে। উনিশ মিনিটের সেই ভাষণ কাগজে লিখে নিয়ে জাননি তিনি। কিন্তু সাবলীলতায়, সুস্পষ্ট ভাষায়, অতি স্বাচ্ছন্দে তিনি বাংলার মানুষকে দিয়েছেন নতুন দিনের দিশা। বলেছেন দুঃখভারাক্রান্ত মনের কথা, বলেছেন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বেঈমানী আর নিপীড়নের কথা, বলেছেন বাঙালি জাতির ধৈর্য আর বলীদানের কথা। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে উঠে এসেছে পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনীতির পরিক্রমা, ৫২’র ভাষা আন্দোলনে রক্তদানের কথা, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভের পরও ক্ষমতা না পাবার বেদনা, ৫৮’র আইয়ুব খানের সমারিক শাসন, ৬৬’র ছয় দফা পরবর্তী নিপীড়ন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আইয়ুব খানের পতন আর ইয়াহিয়ার আগমন। এসব পটভ‚মির বিবরণ দিয়ে তিনি একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যায় উপনীত হয়েছেন যে কেনো বাঙালি ধৈর্যধারণের চ‚ড়ান্ত সীমানায় এসে পৌছেছে। আলোচনার কোন পথই যে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী খোলা রাখেনি, সে কথাও তুলে ধরেন তিনি। আপামর জনতাকে যার যা আছে তাই নিয়ে যেমন প্রস্তুত থাকতে বলেন আবার শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন-বিক্ষোভ চালিয়ে যেতে বলেন। কঠোর শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আন্দোলনকারীদের যেমন পরামর্শ দেন আবার ঐক্য ও সম্প্রীতি বজায় রাখার কথাও মনে করিয়ে দেন। বলেন, বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলমান সবাইকে নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। পাকিস্তানি সেনাদের ভাই সম্বোধন করে ব্যারাকে ফিরে যাবার অনুরোধও যেমন করেন আবার গুলি চালালে যে ভালো হবে না তা বলে হুশিয়ারীও দিতে ভুল করেননি সেদিন। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ভ্রাতৃত্ব থাকবে না বলে সাবধান করে দেন পশ্চিমা পাক-শাসকদের।
গণমানুষের নেতা হিসেবে সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই”। দেশের মানুষের অধিকার, মর্যাদা আর ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তার জন্য জীবনের তোয়াক্কা না করে, ক্ষমতার ধার না ধেরে সেদিন তিনি বেছে নিয়েছিলেন বিপ্লবের পথ। যে পথে হয় মৃত্যু না হয় বিজয়। আপোসের কোন সুযোগ নেই। সেই সাহস আর বিপ্লবী চেতনায় উজ্জীবিত ছিলেন বলেই সেদিন কবি উচ্চারণ করেছিলেন, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো”; বুকে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল বলেই উচ্চকিত কণ্ঠে বলেছিলেন, “আর দাবায়ে রাখতে পারবা না”। বাঙালি জাতিকে আর কখনোই কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি। শত চেষ্টাতেও আর কখনো পারবে না। সেই থেকে বাঙালি যুদ্ধজয়ের ইতিহাস রচনাসহ প্রতিটি সংগ্রামে, সংকটে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েই ছিনিয়ে এনেছে সাফল্য, এনেছে বিজয়। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেরিয়েছে, জানান দিয়েছে নিজেদের অস্তিত্ব, প্রমাণ করেছে নিজেদের সামর্থ। মেধায়-মননে, আধুনিকতায়-উন্নয়নে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়।
বাঙালি জাতির শুধু গৌরবেরই নয় বরং অহংকার করার মতো যা কিছু আছে তার মধ্যে অনন্য হলো বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ। বলা বাহুল্য যে জাতির পিতার এই ভাষণকে ইউনেস্কো স্বীকৃত দিয়েছে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে। এটি যে বিশ্ব প্রামাণ্য এবং বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত, মুক্তিকামী সব মানুষের মুক্তির মন্ত্র তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। বিশ্বেও বহু ভাষায় এটি অনুদিত হয়েছে। মর্যাদার সাথে জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বখ্যাত সব ভাষণ নিয়ে রচিত বিখ্যাত ইতিহাসবিদ জ্যাকব ফিল্ড এর বই “উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্যা স্পিচ দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্টোরি” তে। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত দ্যা নিউজউইক ম্যাগাজিন বঙ্গবন্ধুকে আখ্যায়িত করেন “পোয়েট অব পলিটিক্স” বা “রাজনীতির কবি” হিসেবে। কেনই বা নয়? সেদিন রেসকোর্সে গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে, জনসমুদ্রে জোয়ার জাগিয়ে বজ্রকণ্ঠে কবি শুনিয়েছিলেন তাঁর অমর-কবিতাখানি:
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।