মার্চ মাস! কথা বলার মাস; কথা লেখার মাস!!

প্রকাশের সময় : 2022-03-09 14:47:20 | প্রকাশক : Administration
মার্চ মাস! কথা বলার মাস; কথা লেখার মাস!!

সরদার মোঃ শাহীন

 

মেজাজ হলো সময় আর বিষয়বস্তুর একটি সম্মিলিত খেলার ফসল। খেলাটি সময় আর বিষয়বস্তু মিলেমিশে সর্বদা খেলে। এখানে মেজাজের নিজের কোন ভূমিকা নেই। ভূমিকা কেবল সময় আর বিষয়বস্তুর। এই দুইয়ের যে কারোরই মেজাজের উপর ভীষণ নিয়ন্ত্রণ। এর বাইরে মেজাজ সকল সময় থাকে শান্ত নদীর স্রোতের মত। দেখে কারো বোঝার উপায় থাকে না, এটা নদীর স্রোত, নাকি হালকা বাতাসে পুকুরের টলটলা পানির এদিক ওদিক সামান্য যাওয়া আসা মাত্র।   

পুকুরের পানির মতই আমার মনটাও শান্ত ছিল। বলছিলাম গত বছর মার্চের কথা। গত বছর ৭ই মার্চকে বিএনপি প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করবে বলে ঘটা করে জানানোর পরে মন এবং মেজাজ দুটোই আমার শান্ত পুকুরের পানির মত শান্ত ছিল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুভ লক্ষণের অভূতপূর্ব শুভ বাতাস বইতে শুরু করেছে ভেবেই মন এবং মেজাজের এই শান্ততা। রাষ্ট্রস্বত্বার মৌলিক বিষয়গুলোতে বিএনপি আওয়ামীলীগের প্রচন্ড রকমের মতপার্থক্য বাংলাদেশের রাজনীতিকে কতটা অশান্ত করেছে তা বোধ করি অবুঝ শিশুকেও বুঝিয়ে বলতে হবে না।

কেবল বুঝিয়ে বলতে হবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে। তারা একটু বুঝতে পারলে বেঁচেই যেতাম আমরা। আপামর এই আমজনতা। কিন্তু তারা মোটেই বোঝেন না। বুঝলে কি ফখরুল সাহেব এত ঘটা করে এত কিছু বলে কয়ে গত বছর ৭ই মার্চ উদযাপনের নামে এমন বিতর্কিত কথা আবার বলতে পারতেন? কী বিএনপি, কী আওয়ামীলীগ! এদেশে রাজনীতিবিদদের বলার সুযোগ থাকলে বেহুশের মতই বলেন। গতবারও বলতে বলতে বিএনপির নেতা ঠাস করে বলে দিলেন, এক ভাষণে কি আর দেশ স্বাধীন হয়?

আসলে তিনি তার দলের মনের গহীনে থাকা কথাটির পুনরাবৃত্তি করেছিলেন মাত্র। এটা বুঝতে হলে ১৯৭৬ সালের ৭ই মার্চের দিনটিকে বিবেচনা করতে হবে। বঙ্গবন্ধুবিহীন প্রথম ৭ই মার্চ। বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলার ৬ মাস পরের মার্চ। ২০২২ এর মার্চে এসে এটা অনুধাবন করা খুবই কঠিন। সেদিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় জেনারেল জিয়া। একাধারে সেনাপ্রধান আর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। তার নির্দেশে সারা বাংলায় ৭ই মার্চ পালন নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। এমনকি মুজিব শব্দটিও।

জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় ছিয়াত্তরের ৭ মার্চ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই আয়োজন করা হয় বিশাল এক ইসলামী জলসার। তখন দেশে সব রকম সভা- সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও এই জলসা মোটেও বাধাগ্রস্ত হয়নি। কারণ এর আয়োজকরা সবাই জামায়াতে ইসলামীর সক্রিয় সদস্য। জলসায় সভাপতিত্ব করেন দেলোওয়ার হোসাইন সাঈদী। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রেখেছিলেন জিয়ার উপ- প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এয়ার ভাইস মার্শাল এমজি তোয়াব।

ইত্তেফাকের ৮ মার্চ, ১৯৭৬ সংখ্যায় জ্বলজ্বল করে ছাপা হলো, সভাকে আলোকিত করে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন পাকিস্তানী এবং লিবীয় রাষ্ট্রদূতরা। সভাপতি সাঈদী তার বক্তৃতায় ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। দাবির অন্যতম ছিল বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ ঘোষণা, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন আর বেদাতি শহীদ মিনার ধ্বংস করা।

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাবের এক লেখায় বিষয়টি আরো পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আমি তার কিছু অংশ তুলে ধরলাম কেবল। বলা যায় তুলতে বাধ্য হলাম। ফখরুল সাহেবদের ভন্ডামীতেই বাধ্য হলাম। সেই ৭৬ থেকেই তারা শুরু করেছেন। আজও থামছে না। যুক্তি দিয়েই যাচ্ছেন। যুক্তির জান টেনেহেচড়ে হলেও ৭ই মার্চের ভাষণটিকে হালকা করে ছাড়বেন। কেননা ৭ই মার্চ থাকলে দেশের রাজনীতিতে তাদের রাজনীতির অস্তিত্বই থাকে না। উম্মোচিত হয় তাদের ভন্ডতার মুখোশ।

এতদিন এইসব ভন্ডদের মুখেই শুনতাম তাদের নেতা, মানে জিয়াউর রহমানের মাত্র দেড় মিনিটের রেডিও ঘোষণাতেই দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আর নেতা হয়ে গেছেন ঘোষক। বড় চমৎকার দাবী। এখন তারাই আবার বলছেন, শেখ মুজিবের মাত্র ১৮ মিনিটের একটা ভাষণেই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে, বিষয়টি কি এতই সোজা! মানেটা কী দাঁড়ালো? দাঁড়ালো এই যে, ৭ই মার্চের বিশ্বখ্যাত ভাষণটির সামান্য গুরুত্ব আগেও তাদের ছিল না, আর এখনও নেই। ভবিষ্যতেও থাকবে না।

এটাই বাংলাদেশের রাজনীতি; রাজনীতির অন্ধতা। এটাই জাতিকে রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধাহীন করে তুলছে। আর বাংলাদেশকে করছে রাজনীতি শূন্য। মজার ব্যাপার হলো, রাজনীতিশূন্য এই বাংলাদেশ এবারও তাদের জগাখিচুরীমার্কা ৭ই মার্চ পালন করতে দেখবে। না দেখে উপায়ই বা কি। তাদের তো অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যা আছে। প্রয়াত সুরঞ্জিত বাবু একবার খুব মজা করে সমস্যাটিকে চিহ্নিত করেছিলেন ঠিক এভাবে; এক চিমটে ভাসানী ন্যাপ, এক চিমটে রাজাকার আর এক চিমটে মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ঘুটাঘুটা একটা ‘ওরস্যালাইনের দল’ বিএনপি!

অষ্ট্রেলীয় প্রবাসী প্রথিতযশা সাংবাদিক ফজলুল বারী এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী করাচি নগরী জিয়াউর রহমানের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পিতার কর্মক্ষেত্রের সূত্রে সেখানেই তিনি পড়ালেখা করেছেন। জিয়ার মা-বাবা দুজনের কবরও করাচিতে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে রাষ্ট্রপতি জিয়া কখনো মা-বাবার কবর জিয়ারতে করাচি যাননি। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তান সফরে গেছেন। কিন্তু বিষয়টি চিহ্নিত হয়ে যাবার ভয়ে কোনোদিন শশুর-শাশুড়ির কবর জিয়ারত করতে যাননি! পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিক হিসাবে জিয়া-খালেদার দুজনেরই বদনাম। আর বদনাম না বাড়াতে এমন নিকটজন মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ির কবরও কোনোদিন জিয়ারতে যাননি জিয়া- খালেদা জিয়া!

কবর জিয়ারত করতে তারা যাননি বটে, কিন্তু পাকিস্তানপন্থীর বদনাম ঘুচাতে পারেননি। জিয়া তো নতুন গানই রচনা করিয়েছিলেন। জাতীয় সংগীত হিসেবে সেই গান চালাবার অনেক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিত মৃত্যুঘটনা তাঁকে জীবদ্দশায় সফল হতে দেয়নি। এদিকে জাতীয় সংগীতকে মাঝেমধ্যেই কারণে অকারণে অবজ্ঞা করে আলোচনায় এসেছেন খালেদা জিয়া। অন্তত দুই দুটি রাষ্ট্রীয় প্রোগ্রামে জাতীয় সংগীতকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার নজীর তিনি স্থাপন করেছেন তাঁর ক্ষমতায় থাকাকালীন। ২০০৪ সালের ১১ এপ্রিল। বিটিভি ওয়ার্ল্ডের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। ম্যাডাম জিয়া উদ্বোধক। বিটিভির প্রথম স্যাটেলাইট চ্যানেল। তিন পর্বের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কোনো অংশেই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়নি। কিন্তু জিয়ার বিএনপি সংগীত প্রথম বাংলাদেশ, শেষ বাংলাদেশ ঠিকই প্রচার হয়েছে।

একই বছর ‘এ.পি.ইউর’ সম্মেলন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক সম্মেলন। সরকারী অনুষ্ঠানে সরকারের সবাই উপস্থিত। স্বয়ং প্রধানন্ত্রীও উপস্থিত। লাইভে যাচ্ছে অনুষ্ঠানটি। সবকিছুই ঠিকঠাক মত চলছিল। হঠাৎ ছন্দপতন হলো। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত একলাইন বাজার পর ক্যাসেটের ফিতা জড়িয়ে গেল। গান আর বাজে না। অবস্থা বেগতিক দেখে যুবদল নেতা আলাল এদিক ওদিক তাকিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। এবং বলা নেই, কওয়া নেই; তার হেড়ে গলায় বিকৃত সুরে জাতীয় সংগীত গাওয়া শুরু করলেন। যেন একেবারই না গাইলে কেমন কেমন দেখায়; তাই গাইলেন।

এটাই স্বাধীন বাংলার দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাস। জাতীয় সংগীতকে ছলেবলে কৌশলে অবমাননা করার লজ্জাস্কর ইতিহাস। জাতীয় সংগীতকে বাদ দেবার কসরতের ইতিহাস। এটাই স্বাধীন দেশের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুকে নিষিদ্ধ করে সম্পূর্ণরূপে মুছে দেবার ইতিহাস। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে চিরতরে স্তব্দ করে দেবার ইতিহাস। বলা যায় পুরো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেবার ইতিহাস।

এসবের মধ্যেই ৭ই মার্চ বারবার ফিরে আসে বাংলাদেশে। গর্ব ভরেই বুক চেতিয়ে ফিরে আসে। যেমনি বুক ফুলিয়ে আসে, তেমনি উন্নত শিরে চলেও যায়। কিন্তু ঐসব বিকৃত মস্তিস্কের অসুস্থ অর্বাচীনদের এতে কিচ্ছু যায় আসে না! তারা সর্বদা বুদ হয়ে থাকে তাদের অন্ধত্বে!! আর দিন দিন নিপতিত হয় অন্ধকার থেকে ঘোর অমানিশার অন্ধকারের দিকে!!!       

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com