করোনা দিনের ডায়েরি...
প্রকাশের সময় : 2022-03-23 10:06:36 | প্রকাশক : Administration
৩৯ তম পর্ব
সরদার মোঃ শাহীন
যে কাজ জীবনেও করিনি, সেই কাজ করোনাকালে করেছি। করোনার কঠিনকালে নিয়মিত ডায়েরী লিখেছি। ঘরবন্দি জীবনে এর কোন বিকল্পও ছিল না। কাজ নেই, কর্ম নেই; ভুলেও ঘরের বাইরে যাবার সুযোগ নেই। ল্যাপটপ আর মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকা ছাড়া কোন গতিও নেই। অগত্যা দুটি কাজ করতাম। করোনা নিয়ে অনলাইনে যেখানে যত লেখা ছাপা হতো, সব গোগ্রাসে পড়তাম। বলা চলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম। আর লিখতাম। অবিরাম লিখতাম। লিখতাম, “করোনা দিনের ডায়েরি”।
তবে লিখতে লিখতে এটা যে একটা বই হয়ে যাবে, সেটা বুঝিনি। বোঝার কথাও না। কে জানতো করোনা এত্তদিন থাকবে! ভাবতেই বা পেরেছে কে! ভেবেছিলাম টেনেটুনে বড়জোড় মাস তিনেক টিকবে। তারপর যেই দুনিয়া সেই দুনিয়া। আবার আগের রূপে ফিরবে। করোনা যেহেতু ফ্লু। তাই ঠান্ডাটা বিদায় নেবে, আর সাথে বিদায় নেবে করোনা। কিন্তু করোনা যে এত না না করতে জানে, তা জানতাম না। সেই করোনা যে এতদিন টিকবে তা বুঝতে পারিনি মোটেও।
এসব বুঝতে না পারলেও করোনার ভয়াবহতা ছড়িয়ে দেয়া কিংবা যত না প্যানিক হবার কথা তারচেয়েও প্যানিককে বড় করে দেখানো যে, শ্রেফ একটা ধান্দাবাজি কিংবা জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক নোংরা রাজনীতি, সেটা একেবারে প্রথম দিন থেকেই বুঝেছিলাম। কেবল বুঝিনি; আমার সকল লেখায় বারংবার সেটা পরিষ্কারও করেছি। আশাবাদী মানুষ সেজে নিত্যদিন আশায় পথ চেয়েছি আর সবাইকে শুনিয়েছি আশার কথা।
লক্ষ্য করছিলাম, আমার আশপাশের দেশীয় মানুষেরা আশার কথা শোনার চেয়ে আতঙ্কের কথা শুনতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। তাই আশার কথা শুনিয়ে কাজের কাজ কিছুই হয়নি তেমন। বেশি শিক্ষিতরা আমার কথাকে পাত্তাই দেয়নি। একটা বললে দশটা শুনিয়ে পান্ডিত্য জাহির করেছে। বোঝাবার চেষ্টা করেছে, করোনায় বাংলাদেশ অলরেডী ৫০% ফুট্টুশ। বাকী ৫০% ফুট্টুশ হতে আর ৫০ দিনও বাকী নেই।
এদিকে মাঝারো মানের শিক্ষিতরা আমার কথা শুনতো। মুখ হা করে শুনতো। কিন্তু বিশ্বাস করতো না একটুও। হা’র পরিধিই বলে দিত, বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে আমার কথা বিশ্বাস করতো সবচেয়ে কম শিক্ষিতজনেরা। যা বলতাম তাই বিশ্বাস করতো। আসলে এটাও ঠিক বিশ্বাস ছিল না। ছিল দুইপক্ষের মনের মিল। নিজেদের মনের বিশ্বাসের সাথে আমার কথাগুলো মিলে যেত বলেই বিশ্বাস করতো। এবং কঠিন বিশ্বাসের ভান করেই বলতো, একদম খাঁটি কথা বলছেন ভাই। কিসের করোনা, কিসের কি! এগুলা হুদাই। হুদাই মাইন্ষে চিল্লায়।
একদিকে মানুষের চিল্লাপাল্লা, অন্যদিকে পান্ডিত্যপূর্ণ সন্দেহ। এভাবে সন্দেহ করতে করতে সন্দেহ বেচারা ভ্যাকসিন পর্যন্ত পৌঁছালো। মিডিয়াতে রীতিমত বিলাপ শুরু হয়ে গেল; যে ভ্যাকসিন বের হতে কয়েক বছর লাগে, তা কি করে কয়েক মাসে বের হবে! বললেই হলো! মানুষ কি এখনো বোকা আছে? ভাওতাবাজির তো একটা সীমা থাকা দরকার। দেখুন অবস্থা! সীমাহীন মূর্খতা নিয়ে পুরো বিশ্বের মেডিকেল সোসাইটিকেই দেশীয় আতেলরা ভাওতাবাজ বলে দিল।
অথচ অদৃশ্যমান করোনা গোটা বিশ্বকে জিম্মি করে ফেলার পর, বিশ্বজুড়ে এই বিজ্ঞানীরা আদাজল খেয়ে নামেন তা থেকে মুক্তির জন্যে। যেমন করেই হোক করোনার টিকা আবিষ্কার করতেই হবে। সাধারণত একটি টিকার আবিষ্কারে ৭/৮ বছর সময় লাগে। কিন্তু জরুরি বিবেচনায় সারাবিশ্বের সকল মহলের প্রচেষ্টায় করোনার টিকা ৭/৮ মাসেই প্রয়োগের পর্যায়ে চলে এলো। দেশে দেশে টিকা আবিষ্কার হলো।
শুরু হলো নতুন সন্দেহ। নতুন জিজ্ঞাসা। টিকা আসবে তো? কবে আসবে টিকা! আস্লে আমরা পাবো তো? পেলে, কবে পাবো! যখন সকল প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বড় বড় এবং অনেক অনেক ধনী রাষ্ট্রের চেয়েও অনেক আগে করোনা ভ্যাকসিন বাংলাদেশে পৌঁছে গেল, তখন শুরু হলো ভিন্ন রকমের খেলা। টিকা নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেয়ার খেলা। প্রক্রিয়াটি শুরু হলো ঠেলাঠেলির খেলা নামে। কার পরে কে টিকা নেবে সেই নিয়ে ঠেলাঠেলি। এতে কাজও হলো বেশ। সন্দেহ বিস্তার লাভ করলো এবং সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়লো।
এই সন্দেহ করার মানসিকতাটা তারা উসকে দিয়েছিলেন একেবারে শুরুতেই। জানুয়ারী ২৪ কিংবা ২৫ এর কথা। ঢাকায় সবে ভারতের উপহার হিসেবে ২০ লক্ষ ডোজের করোনা টিকা এসেছে। ভাবলাম এবার অন্তত সন্দেহবাতিকদের সন্দেহ যাবে। কিসের কি? আমার ভাবনায় কি আর তারা চলেন! তারা চলেন তাদের ভাবনায়। প্যাঁচ লাগানো ভাবনায়। এবং প্যাঁচ লাগিয়েও দিলেন। কাজটির শুরু করলেন স্বয়ং ডাঃ জাফরুল্লাহ। তিনি বললেন, ভারতের মোদি এখনও টিকা নিলেন না; নিতে রাজী হলেন না আমাদের প্রধানমন্ত্রীও। এটিই তো সন্দেহের। কিন্তু তো একটা আছেই।
ব্যাস! পুরো জাতি এই কিন্তুর মধ্যে পড়ে গেল। ভ্যাকসিন নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়ে গেল। ভ্যাকসিন আসার আগে সমালোচনাকারীরা ভ্যাকসিন আনার মুরোদ সরকারের আছে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। আর সরকার যখন অন্য অনেক দেশের তুলনায় অনেক আগেই ভ্যাকসিন ম্যানেজ করে ফেলল, তখন নতুন ফিতনা বাঁধিয়ে দিলেন। সোজা কথায়, আমজনতার মনে প্যাঁচ ঢুকিয়ে দিয়ে ভ্যাকসিন নিয়ে আস্থাহীনতা তৈরি করলেন। আস্থাহীনতার বিষয়টি মানুষের ‘মগজে’ ঢুকিয়ে দিলেন।
মগজে ঢোকানোর কাজটায় নেতৃত্ব দেয়া এই মানুষটি একসময় এরশাদ সাহেবের বিশিষ্ট দোসর হয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। পরের ইতিহাস সবার জানা। জাফরুল্লাহ কমিশনের প্যাঁচ লাগানো খেলায় বাংলাদেশের সকল সরকারী বেসরকারী ডাক্তারগণ তিন মাস প্র্যাকটিস বন্ধ করে দিয়েছিলেন। হাসপাতাল হয়ে উঠেছিল মৃত্যুপুরী। বিনা চিকিৎসায় একের এক পর লাশ পড়তে লাগলো। আকাশ ভারী হয়ে উঠলো চিকিৎসা না পাওয়া মানুষদের আর্তচিৎকারে।
স্বাস্থ্যনীতির জাফরীয় স্টাইলে জাতি শেষমেষ কি পেয়েছিল এতদিনে তা মনে নেই। কিন্তু তিনি পেয়েছিলেন বিঘাকে বিঘা খাস জমি, বেশ কিছু জীবনরক্ষাকারী জটিল ঔষধের একচেটিয়া ব্যবসা করার লাইসেন্স। সে সব দিয়েই দাঁড়িয়েছে আজকের গণস্বাস্থ্য নামের তার নিজের কর্তৃত্বের বিশাল প্রতিষ্ঠান। সেই লাইসেন্স দিয়ে আজো বাণিজ্য করে যাচ্ছেন তিনি। এরশাদ সাহেবের দেয়া ঐ লাইসেন্সের কারণে তিনি ছাড়া আর কেউ এসব ঔষধ আজো বানাতে পারেন না।
সেই তাঁর মত একজন স্বার্থবাদী মানুষের মুখে বাংলার জনগণের স্বার্থে বড় বড় কথা বলা কতটা মানায় সেটা কোটি টাকার প্রশ্ন। করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে এবারেও কোটি কোটি টাকার একচেটিয়া বাণিজ্য করার খায়েশ তাঁর ছিল। উদ্যোগও ছিল। মিডিয়াতে জোর সরব ছিলেন প্রথম থেকেই। অনেকটা করোনা হিরো বনে গিয়েছিলেন। প্রতিদিনই কিছু না কিছু তথ্য নিয়ে হাজির হতেন। আর বলতেন আবোল তাবোল কথা।
ঢাহা মিথ্যে কথা বলেছিলেন কিট নিয়ে। বলেছিলেন তাদের আবিষ্কৃত কিট দিয়ে করোনা ভাইরাস ডিটেক্ট করা যায়। মূলত ওটা ছিল করোনা এন্টিবডি টেস্টকিট। মানে, আগে কারো কখনো করোনা হয়ে থাকলে এন্টিবডি দেখে বুঝতে পারা যে তার করোনা হয়েছিল। আর সবে আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তির দেহে যেহেতু এন্টিবডি থাকে না, তাই তাদের কিট দিয়ে টেস্ট করা আর না করা একই কথা।
বিষয়টি বুঝতে একটু সময় লেগেছিল। পিজির টেস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। পিজির টেস্টে তিনি ধরা খেয়ে একেবারে চুপসে যান। আর জাতি বেঁচে যায় তাঁর কিট দিয়ে টেস্ট করা থেকে। এই তিনি ভ্যাকসিন বানালে কী হতো আল্লাহপাক জানেন। তবে সুযোগ না পাবার বেদনায় ভ্যাকসিন নিয়ে তিনি বা তাঁরা অপপ্রচার ও উস্কানিমূলক কথা বলবেন এটাই তো স্বাভাবিক!
তবে বাস্তবতা ভিন্ন। টিকা নিয়ে বাংলাদেশ বর্তমানে সত্যিকার অর্থেই উৎসব করার অধিকার রাখে। অনেক শিল্পোন্নত ধনী দেশের চেয়েও বাংলাদেশের টিকার উপস্থিতি অনেক বেশি। মুখে যাই বলেন, এটা সবচেয়ে ভাল বোঝেন জাফরুল্লাহ সাহেব। আর বোঝেন বলেই দেরী না করে প্রকাশ্যে টিকা নিয়ে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা তিনি বেশ ভাল করেই করেছেন।
আর এতদিন যা করেছেন শ্রেফ ভাওতাবাজী। এইসব ভাওতাবাজ দেশবিরোধীদের চিহ্নিত করার সময় হয়েছে। এরা সরকার বিরোধীতার নামে সব সময় দেশবিরোধীতায় নামে। দুটোর মাঝে যে বিস্তর ফারাক আছে এটা তাঁরা মানতে চায় না; বুঝতে চায় না! যে কোন ভাল কাজে আউল লাগাতে তাঁরা সদা প্রস্তুত!! দেশের সর্বনাশের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে তাঁরা সদা জাগ্রত!!! চলবে...