করোনা দিনের ডায়েরি...
প্রকাশের সময় : 2022-04-06 12:20:21 | প্রকাশক : Administration
৪০ তম পর্ব
সরদার মোঃ শাহীন
সাইফুলকে যখন প্রথম দেখি, তখন ওর বয়স আর কতই বা হবে! বড়জোড় তিন কিংবা চার!! বাবা ইউপি মেম্বার রহমত ভাইয়ের হাত ধরে মাঝেমধ্যে ধলা বাজারে আসতো। ফর্সা ফুটফুটে ভারী মিষ্টি চেহারার ছেলেটি। বাজারে আসতো বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে। দুটো চকলেট এবং মিষ্টির দোকানে বসে একটা হলুদ চমচম; ব্যাস! লক্ষ্য হাসিল। মহা খুশী ছোট্ট সাইফুল।
আমার চেয়ে কম করে হলেও দশ বারো বছরের ছোট হবে। ছোট্ট সেই মানুষটা একদিন সিমেক ফাউন্ডেশনের বড় কেউ হয়ে যাবে তা সেই ছোট্টবেলায় আমি বুঝিনি; ভাবিনি। ভাবার কথাও না। সবকিছু আগেভাগে ভাবা যায় না। কে ভেবেছিল, ছোট্ট সেই মানুষটি আমার অনেক পরে এই পৃথিবীতে এসে আমার আগেই চলে যাবে! আর তার কবরে দিতে হবে ধূলোমাখা মাটি!! কে ভেবেছিল, গেল নয় বছর যে মানুষটা আমাকে বিদায় দিতে গফরগাঁও স্টেশনে শতবার গেছে, তাকে চির বিদায় দিতে আমাকেই যেতে হবে!!!
যাবার আগে সে অনেক কীর্তি করে গেছে। রেখে গেছে সে সব স্মৃতি। ছুঁয়ে গেছে সবার মন। ফুঁটিয়ে গেছে নিজ এলাকায় শত শত ফুল। বৃত্তি দিয়ে, বৃত্তিমূলক নানা প্রশিক্ষণ দিয়ে কোন্ বাগানের ফুল সে ফোটায়নি! গেল নয় বছরে সিমেক ফাউন্ডেশনে কম করে হলেও এক হাজার আনুষ্ঠানিক মিটিং অর্গানাইজ করেছে। অর্ধেক ঢাকায় আর অর্ধেক ধলায়। কতজন পারে পশ্চাৎপদ এলাকাবাসীর শিক্ষার উন্নয়নে বিনা পারিশ্রমিকে এত বড় ত্যাগ স্বীকার করতে!
যে এলাকার তথাকথিত নিয়ন্ত্রক হর্তাকর্তাদের জীবনে স্বীয় মলমূত্র ত্যাগ করা ছাড়া সমাজের কারো জন্যে সামান্য কিছু ত্যাগের নজির নেই, সেই এলাকায় সাইফুল একজন ব্যতিক্রম। পুরোপুরি ব্যতিক্রম একজন ত্যাগী সমাজ সেবক। একজন সাচ্চা বিরল সমাজ কর্মী। দুর্মুখদের কোন কথা গায়ে মাখেনি কখনো, কারো কথায় থেমে যায়নি; মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত লেগেছিল সমাজ কর্মে। লেগেছিল সিমেক ফাউন্ডেশনের সাথে। সাইফুল জন্মেছিল সমাজপতির ছেলে হিসেবে। আর মরেও গেল একজন সমাজকর্মী হিসেবে। আজন্ম সে সমাজকর্মী। মৃত্যুদিনে অনেকক্ষণ ধলা বাজারে ছিলাম। বাজার ঘাটে সবার মুখে একই কথা; কষ্টেভরা বড় আফসোসের কথা - এর মত ছেলে হয় না! একজন বিনয়ী ছেলে। কাউকে কষ্ট দিতে দেখেনি কোনদিন। ছোটদের আদর করেছে যেমন, বড়দের শাসন মেনে নিয়েছে তেমন। মাথা নীচু রেখে চোখ পিটপিট করে হেসে হেসে শাসন মেনে নিত। সেদিন সারা ধলা বাজারে একজনও পাইনি এমন ছেলেটির বিদায়ে যে কষ্ট পায়নি। কেউই মানতে পারছিল না এমন ছেলেটার অকালে চলে যাওয়া।
মানতে পারছি না আমিও। কিভাবে মানবো! ফাউন্ডেশনের সাংগঠনিক সেক্রেটারী সাইদুর রহমান সাইফুল প্রথম দিন থেকেই আমাদের স্বেচ্ছাসেবক সহকর্মী। প্রথমদিন থেকে কেবল সাইফুলই নয়। আরো অনেকজনই ছিল। পরে এসে অনেকে শরিক হয়েছে। কিন্তু টিকতে পারেনি সবাই। তারা শরিক হয়েছিল আবছা উদ্দেশ্য নিয়ে। চলেও গেছে আবছা কারণেই। সাইফুল থেকে গেছে।
শুধু থেকে যাওয়া নয়, টিকেও গেছে। পাকাপোক্ত ভাবেই টিকে গেছে। টিকেছে জীবনে; টিকেছে মরণেও। আর দেখিয়ে দিয়ে গেছে সততা, নিষ্ঠা আর একাগ্রতা কাকে বলে। দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে বটে। কিন্তু সিমেক থেকে ওর বিদায় নেই। সিমেকে সাইফুল অনন্তকাল বেঁচে থাকবে। বেঁচে থাকবে ওর কর্মে। বেঁচে থাকবে সিমেকের আঙিনায়; ‘সাইফুল চত্বরে’। যে চত্বরে সাধারণ মানুষ মন খুলে কথা বলবে। প্রতিবাদের কথা বলবে। ভয়হীন চিত্তে কথা বলবে অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে।
ভয়হীন, লোভহীন সাইফুলের সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকাটা সমাজের সামান্য ক’জন মানুষকে অস্থির করেছে। একেবারেই হাতেগোনা ক’জন মানুষ। তারা খামোখা অস্থির না হলেও পারতেন। মানলাম তারা ব্যক্তিগত কাজকর্ম ফেলেই জানাজায় এসেছেন। কতক্ষণই বা লাগতো! যে সাইফুল বিনা পারিশ্রমিকে তার জীবনের শেষ নয় বছর দিয়েছে এলাকার ঘরে ঘরে কম্পিউটারের আলো, সবাইকে কম্পিউটার শিখিয়ে ধলাকে “ডিজিটাল ধলা” বানিয়েছে; সেই সাইফুলকে অস্থির হওয়া জনাকয়েক নয় ঘন্টা না হোক, অন্তত নয়টা মিনিট তো দিতে পারতেন!
দেননি। বরং অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তারা। এবং ক’জনে মিলে একজনকে ভুলিয়ে জানাজা ভন্ডুল করার চেষ্টা করেছিলেন। কাজ হয়নি। জানাজার আয়োজকরা তাদের পাতা ফাঁদে পা দেয়নি। পা দিয়েছে কেবল ব্যাপারী বাড়ীর শফিকুল ভাই। বেচারা শফিকুল ভাই। ভোলাভালা টাইপের মানুষ। না বুঝে মুখ খোলে জনতার ভীড়ে চিৎকার করেছেন। তাকে দিয়ে মুখ খোলানোর কাজটি করেছেন পাশের জন। খুব যে পরিকল্পিতভাবে করেছেন সেটাও নয়। হুট করেই করিয়েছেন। অর্থবিত্তে বেশ ভাল থাকা এই পাশেরজনাটি খামাখা কাজটি করিয়েছেন। তার সহ্যক্ষমতা আর একটু থাকলেই ভাল হতো। জানাজা তো শুরু হতেই যাচ্ছিল। মাত্র আর কয়েক মিনিট। সেটুকুর জন্যে অপেক্ষা করলেই ভাল হতো। হুট করে বেসামাল না হয়ে তিনি নিজেকে আর একটু সামলে রাখলে পারতেন। পারলে, ‘সামাল' হিসেবে তার নিজের নামের মর্যাদাটা থাকতো।
হয়ত সাইফুলের উপরে থাকা হালকা মানের কিছুটা মনোকষ্ট তিনি সামাল দিতে পারেন নাই। কিন্তু সাইফুল তো তাকে ইচ্ছে করে কষ্ট দেয়নি। দিতে চায়নি। সাইফুল কেবল ফাউন্ডেশনের পক্ষে কাজ করেছে। নিজের সততা ধরে রেখেছে। ফাউন্ডেশনের নগদ টাকায় কেনা এক নম্বর ইট সামালের ইটখলা থেকে না আসায় সব ইট সে ফেরত পাঠিয়েছে। দু’নম্বর ইট গ্রহন করে সে ফাউন্ডেশন তথা এলাকাবাসীর সাথে দু’নম্বরী করেনি।
পুরো জীবনে আমাদের সাইফুল দু’নম্বরী করেনি। না করেছে নিজ পরিবারে, না ফাউন্ডেশন পরিবারে। না সমাজে। সাইফুলের জীবন সার্থক। মায়ের কাছে সেরা সন্তান, স্ত্রীর কাছে সেরা মানুষ আর ভাইদের কাছে শ্রেষ্ঠ ভাই হয়েই কবরে গেছে। আর কী লাগে সাইফুলের! কিচ্ছু লাগে না। আল্লাহ চাহে তো এসব গুণই সাইফুলকে কবরে শান্তিতে রাখবে। বেহেস্তের হাসিমাখা শান্তি।
সাইফুল জীবদ্দশায় সব সময় নিজে হেসেছে, অন্যকে নিজ ব্যবহার দিয়ে হাসিয়েছে। যেখানে গেছে, হাসি দিয়ে গেছে; হাসি রেখে গেছে। কাউকে কাঁদায়নি কোনদিন। কাঁদাতে জানতোই না। তাইতো ওর অকাল মরণে সবাই কেঁদেছে। কেঁদেছে কাছের জনেরা, কেঁদেছে দূরের জনেরা। কেঁদেছে প্রকৃতি। নিরবে কেঁদেছে! আমাদের সবার কান্নার মাঝেই ঢেউয়ের মতন ভেসে গেছে আমার সাইফুল!! চাঁদের আলোর দেশে চলে গেছে!!! চলবে...