সুদান; ইতিহাস সমৃদ্ধ দেশ
প্রকাশের সময় : 2022-04-06 12:25:22 | প্রকাশক : Administration
জেসিউর রহমান শামীম: সুদান আফ্রিকা মহাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি রাষ্ট্র। দেশটির উত্তরে মিসর, পূর্বে লোহিত সাগর, ইরিত্রিয়া ও ইথিওপিয়া, দক্ষিণে দক্ষিণ সুদান, দক্ষিণ-পশ্চিমে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, পশ্চিমে চাঁদ এবং উত্তর-পশ্চিমে লিবিয়া। আফ্রিকার তৃতীয় বৃহত্তম দেশ এটি। নীল নদ সুদানকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে।
সুদান একসময় ছিল কুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। কুশের পর নুবিয়ান সাম্রাজ্য শুরু হয়। তাদের সময়ই আরব মুসলমানরা সুদানে আসতে শুরু করেন। ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে আরব বেদুইনরা সুদানে বসবাস করছে। সুদানের শেষ খ্রিস্টান সাম্রাজ্য ছিল অ্যালেঅডিয়াদের। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে এর সমাপ্তি ঘটে।
এর পরই মুসলিমদের শাসন শুরু হয় এবং এই শাসন ছিল দীর্ঘকাল। ১৮৯৯ সালে এলাকাটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। তবে স্বাধীনতার পর থেকেই সুদান অস্থিতিশীল।
প্রায় ৬০ হাজার বছর আগেও সুদানে মানব বসতির প্রমাণ পাওয়া যায় প্রত্বতাত্তিক নিদর্শন থেকে। আট হাজার বছর আগে এ অঞ্চলে স্থায়ীভাবে মানববসতি শুরু হয়।
সুদান স্বশাসনের অধিকার পায় ১৯৫৩ সালে। আর স্বাধীনতা আসে ১৯৫৬ সালে। তবে স্বাধীনতার পর থেকেই সুদান অস্থিতিশীল। ২০১১ সালে দেশ ভেঙ্গে বের হয়ে যায় দক্ষিণ সুদান। এর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে শুরু করে। কারণ তেলের খনিগুলোর বেশিরভাগই দক্ষিণ সুদানে অবস্থিত।
সাব সাহারায় অবস্থিত সুদানের রাজধানী খার্তুম অন্য ৫ টি প্রদেশের চেয়ে একেবারেই আলাদা। খার্তুম আবার খার্তুম প্রদেশেরও রাজধানী। উন্নত এই শহরকে চারদিক থেকে নীল নদ ঘিরে রেখেছে। একদিকে সাদা নদ অন্যদিকে নীল নদ। এক নদের পানি সাদা। অন্য নদের পানি নীল। দুই নদের মিলন স্থানে তৈরি হয়েছে টি দ্বীপ। এই দ্বীপ সুদানের মতো না। এখানে সবুজ গাছপালা রয়েছে। নানা রকমের ফসল ফলে। গোটা দ্বীপটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ঘুরতে কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। দুই তীরে হাজার হাজার পাম্প বসানো। নদের পানি থেকেই গোটা খার্তুমের পানির চাহিদা মেটানো হয়। সরকারী ব্যবস্থাপনায় পানি সরবরাহ চলে। কেউ চাইলেই নদের পানি ব্যবহার করতে পারবেন না।
এই নদই একমাত্র পানির উৎস। সুদান সরকার দেশটির কোথাও নলকূপ স্থাপনের অনুমতি দেয়নি। কারণ তেল সমৃদ্ধ এই দেশে যে কোন জায়গায় তেল পাওয়া যেতে পারে বলে সরকার নলকূপ স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। ওমর আল বশির সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার কারও সাহস নেই। কারণ প্রতিদিন সুদান আর্মি (গছ আর্মি) ও পুলিশ এগুলো দেখাশুনা করে। জনগণও আইনের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল। তারা সরকারের আইন অমান্য করে না। নৌকায় নদ পরিদর্শন করতে সবাইকে লাইফ জ্যাকেট পড়তে হয়। কারণ এটা সরকারের আইন। সব জায়গায় একই রকম অবস্থা। সড়কেও তাদের কঠিন আইন। কেউ সিগন্যাল ভাঙলে তার কঠিন শাস্তি। শহরের ভেতর আট লেন, চার লেনের বিশাল বিশাল সড়ক। প্রতিটি সড়কই সিগন্যাল নির্ভর। কোন ট্রাফিকের দেখা পাওয়া যায় না। যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে সঙ্গে সঙ্গে ট্রাফিক চলে আসে।
খার্তুম সুদানের রাজধানী, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ইথিওপিয়া থেকে প্রবাহিত নদটিতে সাদা পানি। আফ্রিকা মহাদেশে অন্তত ৬ টি দেশে প্রবাহিত হচ্ছে এই নীল নদ। এটি বিশ্বের দীর্ঘতম নদ। নীল নদের দুটি উপনদ রয়েছে। একটি শ্বেত নীল নদ ও নীলাভ নীল নদ। এর মধ্যে শ্বেত নীল নদ দীর্ঘতর। শ্বেত নীল নদ আফ্রিকার মধ্যভাগের হৃদ অঞ্চল হতে উৎপন্ন হয়েছে। এর সর্বদক্ষিণের উৎস হলো দক্ষিণ উগান্ডাতে। এই নদ তাঞ্জানিয়া, লেক ভিক্টোরিয়া, উগান্ডা ও দক্ষিণ সুদানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। নীলাভ নীল নদ ইথিওপিয়ার তানা হ্রদ থেকে উৎপন্ন হয়ে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে সুদানে প্রবেশ করেছে। দুটি উপনদ সুদানের রাজধানী খার্তুমে মিলিত হয়েছে। মিসরের সভ্যতা প্রাচীনকাল থেকেই নীলের ওপর নির্ভরশীল।
খার্তুম শহরটি নীল নদের দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে। শহরটি অবস্থিত যেখানে দুই নদের মিলনস্থানকে বলা হয় ‘আল মরগান’। নীলনদ দ্বারা বিভক্ত খার্তুম। খার্তুমের জনসংখ্যা পাঁচ মিলিয়ন। খার্তুমের উত্তর ‘আল খার্তুম বাহরি’ও ‘উম্মে দুরমান’ সেতুদ্বয় পশ্চিম খার্তুমকে সংযুক্ত করেছে। দৃষ্টিনন্দন দুটি সেতুই দেখতে মনে হবে ঝুলন্ত।
সুদান পৃথিবীর সবচেয়ে অন্তর্দ্ব›দ্ববহুল দেশগুলোর একটি। এর উত্তরাঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর। এই এলাকায় অধিকাংশ মানুষই মুসলিম। দক্ষিণাঞ্চলের অনগ্রসর এলাকার অধিবাসীর অধিকাংশ অমুসলিম। সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিভাজন ও মতবিরোধের ফলে সুদানে আধুনিককালের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ বিরাজ করছে। সুদানের জাদুঘরে চার হাজার বছর আগের মানুষের পায়ের একটি মমি রয়েছে। প্রায় আট হাজার বছর আগে এ অঞ্চলে স্থায়ীভাবে মানব বসতি শুরু হয়। তারা পশুপালন করত, শস্য ফলাতো ও মাছ ধরত। এখনও এসব কাজ করেই মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে।
সুদানের অর্থনীতির উচ্চ প্রবৃদ্ধি থাকার পরেও দেশটিতে অর্থনীতিতে সমস্যা লেগেই আছে। পেট্রোলিয়াম ছাড়াও প্রাকৃতিক গ্যাস, স্বর্ণ, সিলভার, ক্রোমি, এ্যাসবেস্টস, ম্যাঙ্গানিজ, জিপসাম, জিঙ্ক, লোহা, সীসা, ইউরেনিয়াম, কপার, কোবাল্ট, গ্রানাইট, নিকেল ও তামাসহ গুরুত্বপূর্ণ খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ সুদান। এত সম্পদের কারণেই সুদানে এত সমস্যা। তবে দেশটির অর্থনীতির অন্যতম খাত হচ্ছে কৃষি। দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় আয়ের ৩৯ শতাংশের যোগান আসে কৃষি থেকে। কিন্তু সেচের ক্ষেত্রে এখনও সুদানিরা বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। ধারাবাহিক অস্থিতিশীলতার কারণে কৃষিপণ্যের দাম এখনও খুব বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সত্তে¡ও সুদানের অর্থনীতি বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বিকাশমান।