বাংলাদেশ যে কারণে শ্রীলঙ্কা হবে না
প্রকাশের সময় : 2022-05-11 15:25:25 | প্রকাশক : Administration
এম নজরুল ইসলাম: শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর অনেকেই এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে।
শ্রীলঙ্কার বিষয়টি আমাদের চেয়ে একটু ভিন্ন। সেটা আমাদের বোঝা দরকার। একসময় শ্রীলঙ্কা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অগ্রসরমাণ দেশ। এই দেশের অর্থনীতিতে হঠাৎ ধ্বস নেমে গেল। দেশটির অর্থনীতির প্রধান দুটি খাত পর্যটন ও কৃষি। করোনার কারণে পর্যটন থমকে আছে। কৃষিতে ভুল সিদ্ধান্তের কারণে তাদের বড় ধরনের লোকসান দিতে হয়েছে। উন্নয়নের জন্য দেশটি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল। এখন তারা সেই ঋণ শোধ করতে পারছে না। বিশাল অঙ্কের ঋণ, তার সঙ্গে মহামারির খাঁড়ার পর ইউক্রেইন যুদ্ধ একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে সোয়া ২ কোটি মানুষের দেশ শ্রীলঙ্কাকে। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এতটাই কমেছে যে তা দিয়ে এক মাসের আমদানি ব্যয়ও মেটানো যাবে না। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ কমেছে।
২০১৯ সালে পর্যটন খাত থেকে দেশটির আয় ছিল ৪০০ কোটি ডলার। মহামারির খাঁড়ায় পরের বছর তা ৯০ শতাংশ কমে যায়। মহামারি চলায় এখনো সুদিন ফেরেনি এই খাতে। অবশ্য শ্রীলঙ্কার সরকারি ঋণ মহামারির আগে থেকেই অসহনীয় পর্যায়ে ছিল। অনুমান করা হয়েছিল, এই ঋণ ২০১৯ সালের জিডিপির ৯৪ শতাংশ থেকে ২০২১ সালে ১১৯ শতাংশ পর্যন্ত হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের অবস্থা কি শ্রীলঙ্কার মতো হবে বা হতে যাচ্ছে? তেমন কোনো আশঙ্কা কি আদৌ আছে? সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক তাদের নিয়মিত প্রকাশনা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০২২ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এডিবির বাংলাদেশ প্রধান অ্যাডিমন গিন্টিং বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ঋণের ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনা নেই। তবে আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও ঋণ ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।’
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে এডিবি। সংস্থার কান্ট্রি ডিরেক্টর মনে করেন, ‘বিদেশি ঋণ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেক ভালো। শ্রীলঙ্কার সেখানে বড় দুর্বলতা ছিল। এ ছাড়া যুদ্ধের পর শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো-খারাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি যা আরো নাজুক করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে ভালো করেছে। কোভিড থেকেও দ্রুত পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে বাংলাদেশ।’
এডিবির পূর্বাভাস প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে ৭ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়াবে। সংস্থার মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের ‘সঠিক পথেই’ আছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে বাংলাদেশ সরকার ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে।
অবশ্য বিশ্বব্যাংকের হিসাবে এবার বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার বাড়ার ক্ষেত্রে তেল ও আমদানি খাতে মূল্যবৃদ্ধি এবং রপ্তানি আয় কমাকে মূল ঝুঁকি হিসেবে দেখানো হয়েছে এডিবির প্রতিবেদনে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে।
কৃষি ও শিল্প খাতের ধারাবাহিক বিকাশ বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে। আর তা প্রতিফলিত হয়েছে রপ্তানি বৃদ্ধিতে। গত ১০-১২ বছরে বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি একই সঙ্গে বেগবান হয়েছে এবং এর ঝুঁকি সহনক্ষমতা বেড়েছে।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সুফল সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সাফল্য। অতিধনীদের সংখ্যা এবং আয়বৈষম্য কিছুটা বাড়লেও ভোগবৈষম্য নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য দ্রুত কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। পদ্মা সেতু, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ মেগা অবকাঠামো প্রকল্পগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন করা গেলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিকাশ আরো গতিময় হবে।
তবে আশঙ্কা যে একেবারে নেই তা নয়। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, গত দুই বছরে বাংলাদেশ অনেক বেশি ঋণ করে ফেলেছে এবং এখনো করছে। কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে এই ঋণগুলো আসছে। তারা মনে করছেন, এসব প্রকল্পের কোনোটা হয়তো যথেষ্ট পর্যালোচনা করে নেওয়া হয়নি। আবার কোনোটা নেওয়া হয়েছে দরকার আছে বলেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এত বড় বড় প্রকল্পে বাংলাদেশকে ঋণ দিচ্ছে কেন? এর কারণ হচ্ছে, ঋণ পরিশোধ করার ভালো সক্ষমতা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। ঋণদাতারা খুব ভালো করে দেখে একটা দেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কতটুকু। বিশ্বের যেসব দেশ ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতার দিক থেকে ওপরের দিকে, বাংলাদেশ তাদের একটি। সে জন্য বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ঋণ দিতে আগ্রহী।
গত এক যুগে বাংলাদেশকে আজকের এই উজ্জ্বল অবস্থানে যিনি নিয়ে এসেছেন, তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর মেধাবী নেতৃত্বে গত এক যুগে বাংলাদেশ নাটকীয় অগ্রগতি অর্জনে সমর্থ হয়েছে। জিডিপির আকার বৃদ্ধি দ্রুততর হয়েছে। বাহাত্তরের আট বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি এখন ৪১৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। বেগবান রয়েছে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধির ধারা। তাই বিনিয়োগ জিডিপির অনুপাত ক্রমশ বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিনিয়োগ-জিডিপির অনুপাত ছিল ২৬ দশমিক ৩, আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৬-এ।
অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল আশাবাদী। তারা মনে করছে, শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বই বাংলাদেশকে কখনো শ্রীলঙ্কা হতে দেবে না। কারণ কল্যাণমুখী নেতৃত্বের চেয়ে বড় রক্ষাকবচ দ্বিতীয়টি নেই। (সংকলিত) - সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক