মন্দিরের দেশ: নেপাল
প্রকাশের সময় : 2022-05-11 15:27:14 | প্রকাশক : Administration
জেসিউর রহমান শামীম: নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এক অপরুপ লীলাভূমি নেপাল। মন্দিরের শহর কাঠমুন্ডু আর অন্নপূর্ণার কোলঘেঁষা দেশটির মধ্যাঞ্চলীয় শহর পোখারাকে মনে হয় যেন এক টুকরো স্বর্গরাজ্য। প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও রোমাঞ্চে মিশে থাকা নেপাল তার মোহনীয় সৌন্দর্য্যে মুগ্ধকরে রেখেছে অগণিত ভ্রমণ প্রেমিকদের। একটু অন্য রকম ভ্রমণের স্বাদ নেয়ার জন্য নেপাল একটি আদর্শ গন্তব্য। হিমালয় পর্বতমালার কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা দক্ষিণ এশীয় দেশ এটি। দেশটি ভূভাগ দ্বারা আবদ্ধ। নেপাল নামটির উৎপত্তি সম্বন্ধে তেমন সঠিক কিছু জানা যায় না। অনেকের ধারণা - নে (পবিত্র) এবং পাল (গুহা) থেকে নেপাল শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। নেপালে রয়েছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেষ্ট। এর উত্তরে চীন এবং দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারত অবস্থিত। নেপাল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ। এটি চতুর্দিক থেকেই স্থল দ্বারা আবৃত। নেপালের রাজধানীর নাম কাঠমুন্ডু। এ শহরে নেপালের অন্যান্য শহরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি মানুষের বাস।
ইতিহাসের কিছু কিংবদন্তীদের মতে "গোপালক পরিবার" প্রায় ৪৯১ বছর ধরে নেপালের অধিবাসীদের শাসন করেছিল। ধরা হয় যে এরপর মহাপলভ বংশ বা "মহিষপালক সাম্রাজ্য" নেপাল শাসন করেছিল এবং যে সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ভুল সিং নামে এক রাজপুত।
সরকারিভাবে দেশটি 'যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী নেপাল' নামে পরিচিত। দেশটির নিজস্ব পতাকা রয়েছে। তবে অন্যান্য অনেক দেশের মতো এই দেশটির পতাকা আয়তাকার নয়, পতাকাটি ত্রিভুজাকৃতি। নেপাল এর আয়তন প্রায় ১৪৭,১৮১ বর্গ কিলোমিটার (৫৬,৮২৭ বর্গ মাইল) জুড়ে ।
উঁচুনিচু পথ আর পাহাড়ের কোলঘেঁষা আঁকাবাঁকা রাস্তা ঘিরে নেপালের রাজধানী কাঠমুন্ডু। এই শহরটিতে প্রায় দেড় মিলিয়ন মানুষের বসবাস। অন্যান্য নগর অঞ্চলে প্রায় ৩ মিলিয়ন লোকের বাস।
ধারণা করা হয় প্রায় নেপালের আদি বাসিন্দারা ছিল তিব্বতী-বার্মীয় জনগোষ্ঠী। আনুমানিক ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে ইন্দো ইরানীয় বা আর্য জাতিগোষ্ঠী এই অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল। সে সময় এই অঞ্চল ছোটো ছোটো রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এই অঞ্চলটি উত্তর ভারতের মৌর্য সম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়। এরপর খ্রিষ্টীয় ৪র্থ শতাব্দীতে এটি গুপ্ত সম্রাজ্যের একটি পুতুল রাষ্ট্রে পরিণত হয়। পঞ্চম শতাব্দীর শেষ হতে শুরু করে পরবর্তী বেশ কিছুটা সময় লিচ্ছবি শাসকের অধীনে ছিল। লিচ্ছবি সাম্রাজ্যের পতনের পর, ৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে নেওয়ারিদের রাজত্ব শুরু হয়। একাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে নেপালের দক্ষিণাংশ দক্ষিণ ভারতের চালুক্য সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। চালুক্যদের রাজত্বকালে নেপালের ধর্মে ব্যাপক পরিবর্তন আসে কারণ সব রাজাই হিন্দু ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
গোর্খারাজ পৃথ্বীনারায়ণ শাহ কয়েক দশক ধরে যুদ্ধের পর কাঠমুন্ডু উপত্যকা দখল করে ছোটবড় রাজ্যে বিভক্ত নেপালকে একটি রাষ্ট্রীয় সংহতি দান করেন। নেপালের ইতিহাসে এই সময় থেকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এই কারণে পৃথ্বীনারায়ণ শাহকে আজকের নেপালের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
কাঠমুন্ডু নামটি এসেছে একটি মন্দিরের নাম- কাষ্ঠমন্ডপ থেকে, এই মন্দিরটি অবস্থিত দরবার স্কয়ারে। কাঠমুন্ডু নামকরণের পেছনে এই মন্দিরের একটা ভূমিকা আছে। তারা শহরকে বলে মহানগর যার অর্থ ‘মহৎ শহর’। প্রাচীন বৌদ্ধ স্তোত্রগুলোতে কাষ্ঠমন্ডপ মহানগরের নাম পাওয়া যায়। এই শহরটির আরেক নাম কান্তিপুর। কান্তি এবং পুর শব্দ দুটির উৎপত্তি সংস্কৃত থেকে। কান্তি অর্থ “সৌন্দর্য্য” বা, “আলোকিত” এবং পুর অর্থ “স্থান”। কাঠমুন্ডুকে কখনো কখনো আলোর শহর নামেও অভিহিত করা হয়। এখানে রয়েছে মন্দির, মঠ ও আশ্রম। সবচেয়ে বড় শহর কাঠমুন্ডুর অন্যতম প্রতীক সম্ভুনাথ মন্দির।
নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর পোখারা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫ হাজার ফুট ওপরে পাহাড়ের কোলঘেঁষা আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় সেখানে। পোখারার সারাংকোট থেকে সূর্যোদয় এক মনোরম দৃশ্য। সাথে অন্নপূর্ণার দর্শন। প্রায়ই ভূমিকম্প হয় নেপালে। তবে তা দ্রুত কাটিয়ে আবারও গতিশীল হয়ে ওঠে নেপাল। দেশটির আয়ের প্রধান উৎস ট্যুরিজম। সারাংকোটে পাহাড়ের চূড়ায় গেলে দেখা মিলবে পাখির মতো আকাশে উড়ে বেড়ানো শত শত প্যারাগ্লাইডার। হিমালয়ের অদূরে এই শহর ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।
নেপালের প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা নেপালি। তবে অন্যান্য কিছু ভাষায় প্রচলিত রয়েছে। এর মাঝে রয়েছে নেপাল ভাষা, উর্দু এবং অন্তত চারটি ইশারা ভাষা।
নেপালের ৮০%-এরও অধিক লোক হিন্দু ধর্মাবলম্বী। নেপালে অন্যান্য দেশ অপেক্ষা অধিক অনুপাতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী রয়েছে। প্রায় ১০% লোক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং ৫% লোক ইসলাম ধর্মের অনুসারী।
নেপালে ফুটবল এবং ক্রিকেট বেশ জনপ্রিয়। নেপালি দল এখনও কোনো অলিম্পিক বা প্যারাঅলিম্পিক মেডেল জয় করেনি। তারা বারোটি গ্রীষ্মকালীন খেলা, চারটি প্যারাঅলিম্পিক এবং চারটি শীতকালীন অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করেছে। শহরের পাশে বিকেল হলেই খেলাধুলোয় মেতে ওঠেন প্রবীন নাগরিকরা। যদিও ২০১৭ সাল পর্যন্ত নেপালের জাতীয় খেলা ডাংগুলি ছিল। বর্তমানে ভলিবল এখানকার জাতীয় খেলা। নেপাল এখন পর্যন্ত কোনো দেশের সাথে যুদ্ধ করেনি। তাই তো নেপাল সব থেকে শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। নেপালে জাতি, ধর্ম বা বর্ণ বিবাদে কখনো কারো মৃত্যু হয়নি।
নেপালে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৪০% মানুষ গরিব। এ জন্য এদেশের মানুষ বাধ্য হয়ে নিজের কিডনি বেচে দিতে দ্বিধা করেন না। পৃথিবীর সব থেকে বিপদজ্জনক এয়ারপোর্ট নেপালেই অবস্থিত।