বিষয়টি এতই তুচ্ছ যে দেখার কেউ নেই!!!
প্রকাশের সময় : 2018-08-29 21:06:30 | প্রকাশক : Admin
ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ জেলাসদর থেকে খুব বেশী দূরে নয় স্কুলটির অবস্থান। কোমলমতি শিশুদের স্কুল। জ্ঞান অর্জনের জন্যে জীবনের প্রথম তীর্থস্থান বলা যায়। বেসরকারী নয়, খোদ সরকারী বিদ্যাপিঠ। রাস্তার পাশের হলুদ রঙে রাঙানো বড় আকারে মাইলস্টোনে নামটি কালো কালিতে জ্বলজ্বল করছে। “৩৮ নং মানুষমারা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়”। নীচে দিক নির্দেশনামূলক এ্যারো চিহ্ন আঁকা। চিহ্নের শেষে লেখা, নীলফামারী। বোঝা যাচ্ছে সামনে আর কিছুদূর গেলেই নীলফামারী। প্রবল জনপ্রিয় আমাদের সংস্কৃতিমনা সংস্কৃতিমন্ত্রী নূর সাহেবের নীলফামারী জেলা শহর।
অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। সমাজ তথা সমাজের সকল অসংগতি দূর করার জন্যে মানুষটি সারাটি জীবন থিয়েটার করে কাটিয়ে দিলেন। এখনও সময় পেলেই থিয়েটারে যান, মঞ্চে উঠেন; কিংবা ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান। টিভিতে প্রোগ্রাম করেন। মন্ত্রীত্বের শত ব্যস্ততার পরেও তিনি ঠিকই সময় বের করে নেন। ক্লান্ত হন না। সমাজ বদলের সংগ্রামে ক্লান্তি তাঁকে থামাতে পারে না। সমাজের অসভ্যতাকে চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দিতে সদা জাগ্রত তিনি। অথচ খোদ তাঁর জেলাতেই একটি শিশু বিদ্যালয়ের নাম “মানুষমারা” বিদ্যালয়!
আরো যে নেই তাও বা বুঝব কিভাবে! নীলফামারীতে না হোক, অন্যজেলায় যেহেতু ঘোড়ামারা এবং ভেড়ামারা আছে, তাহলে নীলফামারীতে ছাগলমারা, গরুমারা কিংবা বিলাইমারা থাকলেও থাকতে পারে। কথাটা দুঃখের সাথেই বললাম। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে যেভাবে এত্তসব অদ্ভুত এবং বিশ্রী নামের ছড়াছড়ি, সেখানে থাকারই কথা। সময়ের বিবর্তনে বঙ্গদেশের বিভিন্ন জায়গার এই সব বিশ্রী নামকরণ। কিন্তু বাঙালী শিক্ষিত এবং সভ্য হওয়ার পরেও কিভাবে সেসব নাম এখনো টিকে আছে সেটা প্রশ্ন। আমার ছোট্ট শোনিমের প্রশ্ন। আবার সেসব নামকে যুক্ত করে কিভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়, সেটা প্রশ্ন নয়; জিজ্ঞাসা। আমার কঠিন জিজ্ঞাসা!
সমাজের মাথাদের কাছেই জিজ্ঞাসা। গেল বছরও জিজ্ঞাসা করেছিলাম। “চুমাচুমি”, “ভালবাসা” কিংবা “সোনাখাড়া” প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়ে গেল বছর এই কলামেই বিস্তারিত লিখে জানতে চেয়েছিলাম এসবের পরিবর্তন দরকার কিনা। রুচিতে বেঁধেছিল, তবুও রাখঢাক না করে নোংরা শব্দগুলো ভাষায় প্রকাশ করেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম। সাড়াও পেয়েছিলাম বেশ। তবে মাথাদের কাছ থেকে নয়, শুধু পাঠকদের কাছ থেকে। এবার এই সম্ভাবনাও কম। কারণ ওসব নোংরা শব্দের তুলনায় “মানুষমারা” নামটি অনেক শালীন। তাই আজকের লেখায় সামাজের মাথা তো ভাল, পাঠকদের কাছ থেকেও তেমন সাড়া পাবো না, সেটা বলাই বাহুল্য।
আবার আমাদের এই অত্যন্ত অজনপ্রিয় সাপ্তাহিকী মাননীয় মন্ত্রী বাহাদুরের নজরে পড়বে সেটাও অভাবনীয়। দৈনিকে লিখলেই নজরে পড়ে না, কাজ হয় না; আর কাজ হবে সাপ্তাহিকে লিখলে? এমনটা আশাও করিনা। তবে নূর সাহেব ভিন্ন জিনিস। পত্রিকায় লিখে তাঁর নজরে আনতে হবে কেন? নিজ জেলার খবর তো তাঁর নিজেরই জানার কথা। তিনি সংস্কৃতি মন্ত্রী, আবার জেলারও মন্ত্রী; যথেষ্ঠ ক্ষমতা রাখেন এই বিষয়গুলো দেখভাল করার। এসব তাঁর মন্ত্রণালয়েরই দেখার কথা। সারাজীবন থিয়েটার করে কী লাভ, যদি মন্ত্রী হয়ে, নিজ হাতে সমাজ পরিবর্তনের সুযোগ পেয়েও কাজে না লাগান!
লাগানো দরকার। খুব করে দরকার। সংস্কৃতি এবং কৃষ্টিতে যদি কোন অসংগতি থাকে তবে সেটা জলদি দূর করা দরকার। না হলে সমাজসভ্যতার স্বীকৃতি আসেনা। অথচ স্বীকৃতি আসাটা জরুরী। সভ্য হবার মতই জরুরী। আর কৃষ্টি-সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হলো ভাষা। এটির পূর্ণতা যেমনি দরকার, শুদ্ধতাও দরকার। নাহলে সমাজে বিষয়টির মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। কঠিন এবং মারাত্মক ভাবেই হয়।
তাই বিষয়টি অনুধাবন করা দরকার। মনে রাখা দরকার, দূরত্বের ব্যবধানে এক জেলার বুলি, অন্য জেলার গালি। আপনার প্রিয় শব্দ অন্যের জন্যে অপ্রিয়। ধরা যাক বরিশাল। ওখানে মেয়েদেরকে আদর করে মাগী বলে। অন্য জেলার মেয়েদেরকে শব্দটা বলে দেখেন! ফাটাফাটি হয়ে যাবে। আগুন জ্বলবে। আবার ময়মনসিংহে আদর করে বলে বেডি। বরিশালে বেডী বললে খবর আছে। বিষয়টি আসলেই এমন। বাংলাদেশের বিশেষ জেলায় লজ্জামাখা একটি মজাদার মাছ আছে। নাম শুনেছেন কি কেউ কখনো?
শুনে না থাকলে খবর নিয়ে দেখেন। আমি শুনেছিলাম সেই ছেলেবেলায়। বন্ধু সোহেলের মায়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম। এক বিকেলে বাসার সামনের ঘাটপাড়ে আমাদের দুইজনার দুইমায়ের মধ্যে কথা হচ্ছে। দূপুরের রান্না নিয়ে কথোপকথন। আম্মা বলছেন, আইজগো মাছ রানছি, আফা। নদীর মাছ। ব্রহ্মপুত্র নদীর মাছ। ভালই মজা। খালাম্মা কপালে ভ্রু কুচকে বললেন, কিতা কনগো আফা! আফনে কিতা কন ও শাহীনের মা! ব্রহ্মপুত্রের মাছনি? আমরার নদীত কত্ত মজার মাছ আছোইননি। মনে হইলেই খালি খাইতাম মন চায়। পুটকি মাছের মজা অহনো জিহ্বাত লাইগাই রইছেনি।
আমাদের তো হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দেবার পালা। লজ্জামাখা মুখে আমরা খিটখিট করে হাসছি। আম্মাও হেসে কুটিকুটি। কিন্তু খালাম্মা হাসছেন না। তিনি বলেই চলেছেন। বোঝলাইননি আফা! আর কিতা কইতাম। এই মাছটার স্বাদ.....। আম্মা হাসতে হাসতে তাকে থামিয়ে দিয়ে খাঁটি বরিশালের ভাষায় বললেন, হইছে আফা, থাউক। মুই এলহা হাসি না। দেহেন, গুড়াগাড়ায়ও হাসে। হোগার কতা আর কওয়া লাগবে না। এবার খালাম্মা আরো একসাইটেট হয়ে বললেন, কিতা কইলাইন আফা! হোগা মাছনি? হোগা মাছও আমরার ভারী পছন্দ।
এবার বুঝুন। মাছের বাহারী নামের অবস্থা। অভিধানে এত্ত শব্দ থাকতে মাছের নাম রাখার আর শব্দ খুঁজে পেল না! একেবারে বিপত্তি বাঁধিয়ে দিল। অবশ্য একই শব্দ এলাকা ভেদে ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করায় এই বিপত্তি। একটি চমৎকার সুন্দর জাতি গঠনের জন্যে জনগণকে এসব বিপত্তি থেকে উদ্ধার করা দরকার। দরকার শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে এসবে নজর দেয়া। সব না হোক, অন্তত অশালীন কিংবা অশোভন শব্দগুলো বাদ দেয়া দরকার। না হলে সামাজিকতায় ব্যাড়াছ্যাড়া লাগবে।
ব্যাড়াছ্যাড়া লাগার মূল কারণ ত্রুটিবিচ্যুতি। বাংলা ভাষা নিয়ে আমরা যতই গর্ব করিনা কেন, এর যে ত্র“টিবিচ্যুতি নেই, তা তো নয়। কেবল বাংলা নয়, ইংরেজী সহ প্রায় সব ভাষাতেই ত্র“টিবিচ্যুতি আছে। আছে অসম্পূর্ণতা। যেমন ‘সেল’ একটি শব্দ। সন্দেহ নেই শব্দটি বাংলা শব্দ নয়, ইংরেজী শব্দ। তবে বাংলা ভাষায়ও শব্দটি বহুল প্রচলিত। কিন্তু মুশকিল হলো এর অর্থ নিয়ে। জায়গা ভেদে ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। বায়োলজির ভাষায় সেল মানে শরীরের কোষিকা। আর পদার্থে সেল মানে ব্যাটারী। আবার ইকোনমিক্সে সেল হলো বিক্রি। ইতিহাসে সেল মানে জেলখানা আর ফোনের জগতে সেল মানে মোবাইল।
এমনি ত্রুটিবিচ্যুতিতে ভরা হাজারো উদাহরণ বাংলা ভাষায়ও দেয়া যাবে। তাই বলে “মানুষমারা” জাতীয় বেখাপ্পা এবং শ্রুতিকটু শব্দ দিয়ে বিদ্যালয়ের নাম রাখতে হবে! নামের কি এতই আকাল পড়েছে! নাকি আকাল পড়েছে এসব দেখার লোকের! দেখভালের লোক থাকলে এলাকার নাম “বড়বাল” হয় কি করে? কিংবা স্কুলের নাম ভালবাসা, চুমাচুমি অথবা সোনাখাড়া হয়? এসব নাম শুনলে আমাদেরই তো কানখাড়া হয়, শিক্ষার্থীদের হয় না!
বুঝলাম হয় না। কিন্তু নূর সাহেবের তো হবার কথা। তিনি তো থিয়েটারের লোক। জীবনভর মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে সমাজের সকল অসংগতি দেখিয়ে দিয়েছেন। মানুষকে সজাগ করেছেন, সচেতন করেছেন। আজ উল্টো তাঁকেই আঙুল দিয়ে সব অসংগতি দেখাতে হয়! চোখ মেলে দেখার জন্যে আমাদের মত সাধারণকেও লিখতে হয়! অবশ্য কিচ্ছু করার নেই! এটাই নিয়তি, এটাই পৃথিবী। কারণ সাধারণভাবে চোখ পৃথিবীর সব কিছু দেখতে পায়। কিন্তু চোখের মধ্যে যখন কিছু ঢোকে সেটা দেখতে পায় না। নূর সাহেব হয়ত এজন্যেই দেখেন না। নিজের সীমানার মধ্যে এসব অসংগতি ঢুকে আছে বলেই হয়ত দেখার সুযোগ হয় না; দেখতে পান না!!!