মৃত্যু মাত্র কয়েক মিনিটের পথ! (শেষ পর্ব)
প্রকাশের সময় : 2022-05-28 09:20:31 | প্রকাশক : Administration
সরদার মোঃ শাহীন
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বেশি জায়গা নিয়ে বানানো এই হাসপাতালটি। সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। জায়গাও যেমনি বিশাল, উঁচু ভবনের সংখ্যাও তেমনি অনেক। আবার ভবনের ভিতর আছে ডিপার্টমেন্ট অনুযায়ী বক। বকের পর বক। এক বক থেকে আরেক বকে যেতে ক্লান্তি না এসে পারেই না। এমনিতর বক খোঁজা আর ঘন কালো চুলের মাথায় থাকা গোটা কয়েক সাদা চুল খোঁজা প্রায় একই কথা। কেউ চিনিয়ে না দিলে নতুন করে কারো পক্ষে এসেই সবকিছু বুঝে ওঠা সম্ভব না। চেনাও সম্ভব না।
সিএনজিওয়ালা চেনাজানা লোক। সে ইমার্জেন্সি চেনে বলে আমাদের ঘুরাঘুরি করতে হয়নি। সরাসরি ইমার্জেন্সি গেইটেই নামিয়ে দিয়ে গেছে। স্ট্রেচার পেতেও এখানে কোন অসুবিধা হয়নি। কিন্তু সরাসরি ইমার্জেন্সিতে ঢোকা যায়নি। বললেই তো আর সব জায়গায় ঢোকা যায় না। একটা নিয়ম কানুন আছে না! প্রথমে পেমেন্ট দিয়ে টিকিট কাটতে হবে। আচ্ছা তা না হয় কাটবো। কিন্তু টাকা দিলাম আর সিনেমা হলের মত টিকিট পেয়ে গেলাম বিষয়টা মোটেও সে রকম নয়। তথ্য হাতে থাকুক বা না থাকুক, সবার আগে চৌদ্দগোষ্ঠীর তথ্যসমৃদ্ধ ফরম পূরণ করতেই হবে।
সাথে থাকা লোকজন মোটামুটি সবকিছু জানে বলে এমন জটিলতর ফরম ফিলাপ করতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু সব পেশেন্টের সাথের সব লোকেরাই কি পেশেন্টের খুব কাছের হয়? সব তথ্য জানে? জানে না বলেই এদিকে ওদিকে তাকায়; একে ওকে ফোন করে। এমনি ভাবে ফোন করে সব জানতে জানতে কঠিনতর ইমার্জেন্সি রোগী মরে ভূত হয়ে যায়। তবুও এদের বোধোদয় হয় না। হলে কি আর রাগত স্বরে বলতে পারতো, রোগী মরলে আমাগো কিছু করার নাই। হায়াত যহন দেছে আল্লায়, রাখারও মালিকও আল্লায়। আবার নেয়ার মালিকও আল্লায়।
নেয়ার কথা শুনে আমার কলিজায় কচৎ করে চাপ পরে। যাকে বলে মরণ চাপ। বুকে হাত রেখে চাপটাকে ভাল করে বোঝার চেষ্টা করলাম। কেবল চাপ নয়, দম নেবারও চেষ্টা করছি। করিডোরের দেয়ালের পাশে রাখা স্ট্রেচারের উপরে শুয়ে অসহায়ের মত আমি দম নেবার চেষ্টা করছি। বুঝতে পারছি গলা দিয়ে বাতাস পুরোটা নামে না। অর্ধেক নামে বাকী অর্ধেক ময়লায় আটকা পরে। এতে করে কোনভাবে দম হয়ত নেয়া যায় কিন্তু স্বস্তি পাওয়া যায় না।
ইমার্জেন্সিতে পাওয়ার মত কিচ্ছু নেই। যন্ত্রপাতি তো নেইই; সামান্য অক্সিজেন পর্যন্ত নেই। আবার ডাক্তার, লোকজনও নেই। অগত্যা বড় অসহায়ের মত আমার স্ট্রেচার আবার ঠ্যালা শুরু হলো। এবার ভিন্ন ব্লকে যেতে হবে। যেহেতু সমস্যা গলায়, তাই কেউ একজন বুদ্ধি দিল নাক কান গলায় যেতে। এ বিল্ডিং ওবিল্ডিং ঘুরে ঘুরে নাক কান গলা বিভাগেই নিয়ে গেল আমায়। যাবার পথে একটা সিনেমা সিনেমা ভাব লক্ষ্য করলাম। হাসপাতালের দালাল টাইপের কেউ একজন আমাকে ঠেলে নিয়ে চলেছে। আর পিছে পিছে ছুটছে আমার আপনজনেরা। দিশাহারার মত ছুটছে।
বড় কপাল গুণে নাক কান গলায় একজন ডিউটি ডাক্তার পাওয়া গেল। কিন্তু কেবল তিনিই। তিনি ছাড়া কক্ষে আর কিচ্ছু নেই। বেচারা অসহায়। কি আর করবেন! পাঠালেন পাশের কক্ষে। আধামরা মানুষ রাখার কক্ষ। সব রক্তে মাখা। স্ট্রেচার, ট্রলি, অক্সিজেন মাস্ক; সব রক্তে মাখা। তিনি বেশ ভাব নিয়েই এখানে অপেক্ষা করতে বললেন। বড় ডাক্তার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা। সাথে আশ্বাসও দিলেন। বেলা ১০ টা ১১ টা নাগাদ চলে আসার আশ্বাস।
তবে যেটা দিতে ভুললেন না, সেটা হলো তার পরিচয়। বিশাল বড় মানুষ তিনি; ছাত্রলীগ করেন। ডাক্তার পরিচয়ের চেয়েও ছাত্রলীগের পরিচয়টা বড় করে তুলে ধরলেন। এটা এক ধরনের ইঙ্গিত। গলা উঁচু না করে চুপচাপ সবকিছু মেনে নেবার ইঙ্গিত। মেনেও নিলাম। আজ যেন সবকিছুই মেনে নেবার দিন। ঢাকা থেকে আসা সফরসঙ্গী জাহিদও সাথে নেই। গেছে শহর থেকে একটু দূরে গ্রামের বাড়িতে। এটাও মেনে নিয়েছি। ও পাশে থাকলে কোন চিন্তা ছিল না। ডাক্তার না হলেও ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট বেশ জানে। দক্ষ হাতে সামালও দিতে পারে। আমার কথা শুনে সেই ভোর রাতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে সিএনজি নিয়ে দৌঁড়াচ্ছে। আর চালাচ্ছে ফোন। ফোন দিয়ে দিয়ে বলছে আশেপাশের মার্কেট থেকে নেবুলাইজার মেশিন কিনতে। যেমন করেই হোক ম্যানেজ করতে।
বিশাল এই হাসপাতালে এসবের কিচ্ছু না পাওয়া গেলেও হাসপাতালের ঠিক সামনের ফার্মেসীতে নেবুলাইজার পাওয়া গেল। আর আমি যেন বেঁচে গেলাম। জাহিদের নেয়া এই একটা সিদ্ধান্তেই যেন মহা বাঁচা বেঁচে গেলাম। নেবুলাইজেশনের কারণে গলায় আটকে পরা ময়লা কিছুটা ছেড়েছে। পুরোটা নয়। এতেই শান্তি। আমার সামান্য শান্তি দেখে সবার চেহারায় স্বস্তি ভাব ফিরে এলো। আর যাই হোক মৃত্যু ঝুঁকিটা কিছুটা হলেও কমেছে। এবার অপেক্ষা। ওটিতে বড় ডাক্তার আসার অপেক্ষা।
ভয়াবহ দৃশ্য ওটিতে। বড় ডাক্তার আসেননি। এসেছেন ইর্ন্টানী ডাক্তার। তিনি সাধারণ সার্জারীতে ইন্টার্নী শুরু করেছেন কেবল। নাক কান গলার কিছুই বোঝেন না। বোঝার কথাও না। আমাকে পেয়ে তাই বিপদে পড়ে গেলেন। উপায়ন্তর না পেয়ে হাতের কাছে যা কিছু ছিল তাই দিয়ে গলায় গুতাগুতির চেষ্টা করলেন। আমার তো এবার জান যাবার পালা। মনে হলো এই প্রথম আমার জান কবজ করতে সাক্ষাত যমদূত হাজির হয়েছে।
জাহিদ থাকায় যমদূতের হাত থেকে বেঁচে গেলাম। ওদেরকে আর গুতাগুতির সুযোগ না দিয়ে সোজা বেরিয়ে এলো জাহিদ। ততক্ষণে ক্ষতি যা হবার সবই হলো। গলা দিয়ে রক্ত বের হওয়া শুরু হলো। হালকা রক্ত; তাই ঘাবরাইনি। ডানবাম না তাকিয়ে জাহিদ আমাকে নিয়ে সোজা ফিরে এলো হোটেলে। যা করার এবার সে নিজেই করবে। হটপট চালিয়ে তৎক্ষণাৎ পানি গরম করে চা বানিয়ে দিল আমাকে। পাশে দাঁড়িয়ে ফুঁ দিয়ে ফুঁ দিয়ে একটু একটু খেতে দিল।
পরওয়ারদিগার আল্লাহ পাকের অশেষ রহমত। দু’চুমুক গরম চা গলায় ঢালতে না ঢালতে আটকে থাকা ময়লার একটা বড় অংশ নেমে গেল। কপ্পাস করে নামা যাকে বলে। মনে হলো এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। তিনঘন্টার জটিল যুদ্ধের পর অবশেষে বেঁচে গেলাম। শরীর থেকে পাথরচাপা কষ্টটা নেমে গেল। দীর্ঘ সময়ে যে কষ্ট কমাতে পারলো না এখানকার কোন হাসপাতাল, তা করে দেখালো আমার জাহিদ। ঢাকার মোটামুটি মানের বেসরকারি হাসপাতালের সহকারী মহাব্যবস্থাপক জাহিদ।
অস্বীকার করার উপায় নেই, মূলত দেশের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার মোটামুটি নিশ্চয়তা দিচ্ছে এইসব বেসরকারি হাসপাতাল। অবশ্যই সরকারি হাসপাতাল নয়। অথচ প্রায়শই এসব বেসরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযান চলে। মোবাইল কোর্টের দুর্মুজ অভিযান। একেকটা হাসপাতালে ঢোকে আর করে মোটা টাকা জরিমানা। ভুল পেলেও করে, না পেলেও করে। একবার আমাদের হাসপাতালের ফার্মেসীতে শুধু জুস রাখার দায়ে পাঁচলক্ষ টাকা জরিমানা করেছিল।
অবশ্য সে সব নিয়ে আমাদের কিছু বলতে হয়নি। যা বলার মিডিয়া বলেছে। রাতের টিভি টকশোতে প্রশাসনের লোকজনকে চেপে ধরেছিল মিডিয়া। বেজায় সমালোচনা হয়েছিল বিতর্কিত সেই অভিযানের বিরুদ্ধে। বলা হয়েছিল অভিযান হওয়াটা মোটেও দোষের নয়। বরং সাঁড়াশি অভিযানের দরকার আছে। তবে সে সব অভিযান শুধুমাত্র বেসরকারি হাসপাতালে কেন? কেন সরকারি হাসপাতালগুলোতে নয়?
সরকারি হাসপাতাল তো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মালিকানাধীন হাসপাতাল। তারা যদি প্রশাসনিক ক্ষমতা দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে ঠ্যালার উপরে রাখতে পারে, তাহলে এখানে পারে না কেন? তারা যদি অভিযান চালিয়ে সবাইকে একটা নিয়মের মধ্যে আনতে পারে, তাহলে নিজেদের হাসপাতালে পারে না কেন? সমস্যা কোথায়? সমস্যার মূল কোথায়? সমস্যার মূল উৎপাটন করা যে জনস্বার্থে জরুরী!! মুমূর্ষ মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্যে অতীব জরুরী!!!