গার্লফ্রেন্ডের জন্য ১৪ বছর!
প্রকাশের সময় : 2022-05-28 09:30:49 | প্রকাশক : Administration
মিনহাজুল আবেদীন: বৃদ্ধ অটোচালকের চমৎকার ইংরেজি শুনে বেশ অবাকই হয়েছিলেন নিকিতা। চোখেমুখে একটা বিস্ময়ের ভাব দেখে অটোচালক তরুণী যাত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ভাবছেন, এতো ভালো ইংরেজি একজন অটোচালক কি করে বলছে, তা-ই তো!’ নিকিতা আইয়ার। বেঙ্গালরের চাকরিজীবী তরুণী। দিন কয়েক আগের ঘটনা। সেদিন সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য উবারের গাড়িতে উঠেছিলেন নিকিতা। কিন্তু যানজটে আটকে পড়েন। এদিকে অফিসের সময় হয়ে আসছিল। ফলে টেনশন বাড়ছিল নিকিতার। রাস্তায় চিন্তিত এক তরুণীকে দেখে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন এক বৃদ্ধ অটোচালক, ‘কোথায় যাবেন?’ অটোচালকের প্রশ্নের উত্তরে নিকিতা জানান, দ্রুত অফিস পৌঁছনো দরকার। এমনিতেই বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে।
এর পরের বিষয়টির জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না নিকিতা। তার উত্তর শুনে বৃদ্ধ অটোচালক সাবলীল ইংরেজিতে বললেন, ‘প্লিজ কাম ইন ম্যাম, ইউ ক্যান পে হোয়াট ইউ ওয়ান্ট!’ এক জন অটোচালকের মুখে এত সুন্দর ঝরঝরে ইংরেজি শুনে অবাক নিকিতা।
অটোচালক! তার সাবলীল ইংরেজি শুনে মনের মধ্যে তোলপাড় করছিল নিকিতার। কৌতুহল নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পারেননি নিকিতা। কৌতুহল নিরসনে সরাসরি অটোচালককে তার প্রশ্ন, ‘আচ্ছা, আপনি এতো ঝরঝরে ইংরেজি বলেন কিভাবে?’
দু’জনের কথোপকথনের যাত্রা শুরু এখান থেকেই। অটোচালক এবার নিজের জীবনটাই যেন মেলে ধরলেন নিকিতার সামনে। যতো তার কাহিনী শুনছিলেন, নিকিতার অবাক হওয়ার বহর যেনো ততোই বাড়ছিলো।
অটোচালক বলতে শুরু করলেন, তার নাম পাতাবি রমন। এমএ, এমএড। ইংরেজিতে অধ্যাপনা করেছেন মুম্বাইয়ের একটি নামী কলেজে। এ পর্যন্ত বলে একটু থেমেছিলেন তিনি। নিকিতা সবে প্রশ্ন করতে যাবে, ঠিক তার আগেই অটোচালক তাকে পাল্টা প্রশ্ন করে আরও একবার যেন অস্বস্তিতে ফেললেন।
এবারো পাতাবি রমন বললেন, “জানি, আপনার পরের প্রশ্নটা কি হতে চলেছে। নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করবেন কেন আমি অটো চালাচ্ছি, তাই না?” নিকিতা শুধু ঘাড়টা নাড়ালেন এবং বুঝিয়ে দিলেন যে, ঠিক এই প্রশ্নটাই করতে চাইছিলেন তিনি। যেটা আপনি যথারীতি আগেই বুঝতে পেরেছেন!
ফের অটোচালক বলতে শুরু করলেন ‘কর্ণাটকে কাজ পাইনি। তাই চলে গিয়েছিলাম মুম্বাইয়ে। সেখানে একটি কলেজে লেকচারারের চাকরি পাই।’এর পরই তার গলায় আক্ষেপের এবং একটা চাপা ক্ষোভের সুর টের পেলেন নিকিতা।
অটোচালক আবার বলতে শুরু করেন. ‘কর্ণাটকের কলেজগুলিতে যখন চাকরির জন্য আবেদন করি, প্রত্যেক জায়গায় জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আমি কোন জাতের। বলেছিলাম আমার নাম পাতাবি রমন। এ কথা শুনে ওরা আমাকে বলেছিলেন, ঠিক আছে আপনাকে পরে জানাব।’
কলেজগুলো থেকে এ ধরনের উত্তর পেয়ে বিরক্ত আর হতাশায় কর্ণাটক ছেড়ে বাণিজ্যনগরী মুম্বাইয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন রমন। নিজের রাজ্য মুখ ফিরিয়ে নিলেও মুম্বাই কিন্তু মুখ ফেরায়নি। এখানেই একটি নামী কলেজে অধ্যাপনার কাজ পান তিনি। ২০ বছর ধরে অধ্যাপনা করে অবসরের পর আবার বেঙ্গালুরুতে ফিরে আসেন রমন।
তিনি বলেন, ‘শিক্ষকদের বেতন ভাল ছিল না। খুব বেশি হলে ১০-১৫ হাজার টাকা। যেহেতু বেসরকারি কলেজে কাজ করতাম, তাই পেনশনও নেই। কিন্তু পেট তো চালাতে হবে।’এবার একটু রসিকতার ছলেই বললেন, ‘বাড়িতে আবার আমার গার্লফ্রেন্ড আছে। অটো চালিয়ে দিনে ৭০০-১৫০০ টাকা আয় করি। ওতেই আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডের দিব্যি চলে যায়।’গার্লফ্রেন্ডের কথা শুনে নিকিতা হেসে ওঠায়, রমন বলেন, ‘আসলে স্ত্রীকে আমি গার্লফ্রেন্ড বলেই ডাকি।’
আপনার সন্তান? এ প্রশ্ন শুনে রমন সহাস্যে বলেন, “আমাদের একটি ছেলে। ও আমাদের ঘর ভাড়া দিয়ে দেয়। সাহায্যও করে। কিন্তু আমরা সন্তানের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে চাই না। ওরা ওদের মতো জীবন কাটাক। আমরা আমাদের মতো।”
নিকিতা লিখেছেন, ‘মিস্টার রমনের সম্পর্কে যতই প্রশংসা করা যায়, শব্দ যেনো ততোই কম পড়ে যায়। এমন একটা মানুষের সঙ্গে আলাপ হলো, জীবন সম্পর্কে যার কোনো অভিযোগ নেই, কোনো অনুতাপও নেই। এমন মানুষগুলোর কাছ থেকে যেনো অনেক কিছু শেখার আছে।’- সংগৃহীত