মুসলিম ঐতিহ্যের দেশ: বেলারুশ
প্রকাশের সময় : 2022-06-08 16:36:00 | প্রকাশক : Administration
জেসিউর রহমান শামীম: মধ্য পূর্ব ইউরোপের একটি স্থলবেষ্টিত প্রজাতন্ত্র বেলারুশ। এটি পূর্ব ইউরোপের একটি দেশ। ১৯৯১ সালে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। দেশটি স্বাধীন হওয়ার পূর্বে বেলোরুশিয়া বা সাদা রাশিয়া নামে পরিচিত ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত তিনটি স্লাভিক প্রজাতন্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিল (বৃহত্তর দুটি রাশিয়া এবং ইউক্রেন)। দেশটির উত্তরে ও পূর্বে রাশিয়া, দক্ষিণে ইউক্রেন, পশ্চিমে পোল্যান্ড, এবং উত্তর-পশ্চিমে বাল্টিক প্রজাতন্ত্র লিথুনিয়া ও লাটভিয়া।
বেলারুশ মূলত অরণ্য প্রধান দেশ। দেশটি হ্রদ ও জলাভূমিতে পূর্ণ একটি সমতল ভূমি। আয়তনে, এটি প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনের আকারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। বেলারুশের আয়তন ৮০ হাজার ১ শত ৫৪ বর্গ মাইল বা ২ লক্ষ ৭ হাজার ৬ শত বর্গ কিঃমিঃ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে, বেলারুশ নিজেকে একটি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে, শুধুমাত্র ১৯১৮ সালের মার্চের ঘোষণার পরপরই রেড আর্মির দখলে ছিল দেশটি।
১৯১৮-১৯২১ সালের পোলিশ-সোভিয়েত যুদ্ধ বেলারুশের ভাগ্য নির্ধারণের যুদ্ধ বলা যায়। পশ্চিম বেলারুশ পোল্যান্ডের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল; বৃহত্তর পূর্ব অংশটি বেলোরুশিয়ান এসএসআর গঠন করে পোল্যান্ড রাশিয়া, প্রুশিয়া এবং অস্ট্রিয়ার মধ্যে বিভক্ত হওয়ার পরে, বেলারুশ রাশিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে ওঠে।
বেলারুশে প্রায় ৯৯ লাখ লোকের বাস। যার ৮০ শতাংশ-ই জাতিগতভাবে বেলারুশীয়। অন্যান্য জাতির মধ্যে পোলিশ, রুশ ও ইউক্রেনীয় উল্লেখযোগ্য। তিন-চতুর্থাংশ জনগণ শহর অঞ্চলে বাস করেন। দেশের মধ্যভাগে অবস্থিত মিনস্ক দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ শুধু রাজধানী মিনস্কেই বাস করে। বেলারুশ পরিচালিত হয় রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রজাতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায়। বেলারুশ ও রুশ এখানকার দাপ্তরিক ভাষা। ১৯৯৫ সালের গণভোটের মাধ্যমে রুশ ও বেলারুশ ভাষা দেশের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বেলারুশে সরকার নিয়ন্ত্রিত ভারী শিল্পকারখানাগুলো অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। তবে কৃষিও একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত।
বেলারুশিয়ানদের প্রায় অর্ধেকই নিজেদেরকে ধর্মহীন বা নাস্তিক বলে মনে করে। খ্রিস্টধর্ম দেশটির প্রধান ধর্ম। যদিও এটি সরকারি ধর্ম না। বেলারুশে এটি একটি বিশেষ মর্যাদা বজায় রাখে। মোট জনসংখ্যার প্রায় সবাই- খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। মুসলমানের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। তবে সংখ্যায় কম হলেও এই জনপদে ইসলামের ইতিহাস ছয়শ বছরের পুরনো। বর্তমানে বেলারুশে ৩০ হাজার মুসলিমের বসবাস। অবশ্য এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাতাররা এখানকার প্রধান মুসলিম গোষ্ঠী। তাতার মুসলমানরা মূলত ক্রিমিয়া ও ভোলগার মরুভূমি অঞ্চল থেকে এখানে এসেছিলেন। বংশগতভাবে তাতার হলেও তারা নিজেদের ‘বেলারুশ মুসলিম’হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ইভজের কেন্দ্রীয় মসজিদটি এখানকার মুসলমানদের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। বেলারুশ ভাষাতেই তাতাররা কথা বলতেন। প্রতিবেশী দেশ আজারবাইজান, উজবেকিস্তান, তুরস্ক, তুর্কমেনিস্তান থেকে অনেক মুসলিম অভিবাসী বেলারুশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এখানকার অধিকাংশ মসজিদই বিশ শতকের শেষের দিকে তৈরিকৃত।
সাবেক সোভিয়েত সরকারের অধীনে বেলারুশ কার্যত সর্বজনীন সাক্ষরতা অর্জন করেছিল। ৭থেকে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ বাধ্যতামূলক। উচ্চ শিক্ষার বেশ অনেক গুলো বিখ্যাত চিকিৎসা, শিক্ষাগত, প্রযুক্তিগত এবং কৃষি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বেলারুশের মিনস্কে অবস্থিত ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস (১৯২৯) দেশের প্রধান বৈজ্ঞানিক সংস্থা।
রুশ সাম্রাজ্যের অধীনে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত বেলারুশের মুসলিমরা স্বাধীন জীবনযাপন করতেন। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের পর বেলারুশেও কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। নিষিদ্ধ হয় সব ধরনের ধর্মীয় কার্যক্রম। ফলে মুসলমানদের মসজিদ-মাদ্রাসাও বন্ধ হয়ে যায়। প্রকাশ্যে ধর্মচর্চার অধিকার হারায় তারা। মুসলিম-স্থাপনা ও সড়কের নাম পাল্টে দেওয়া হয়।
দীর্ঘ সাত দশক পর, ১৯৮৬ সালে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। ধর্মীয় বিষয়ে উদারনীতি গ্রহণ করা হয়। মুসলমানরা ফিরে পায় ধর্মীয় স্বাধীনতা। কংগ্রেসে পাস হয় সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন। ফিরিয়ে দেওয়া হয় অনেক পুরনো মসজিদ। বেলারুশের অধিকাংশ মসজিদই কাঠের তৈরি। খুবই সাদামাটা কাঠামোতে মসজিদগুলো নির্মাণ করা হয়। তেমন কোনো সাজসজ্জা ও ডিজাইন-অলংকরণ নেই বললেই চলে। পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা নামাজঘর এবং পাঠকক্ষসহ মোট তিনটি কক্ষ থাকে এখানে। স্থানীয় অর্থোডক্স চার্চের ‘বেল টাওয়ার’ এর আদলে তৈরি মিনারও দেখা যায় মসজিদগুলোতে।
এখানকার মুসলিমরা সাধারণত সবুজ বাগানের মাঝখানে তাদের থাকার ঘরটি নির্মাণ করে। বাগানে টমেটোর চাষ করা হয়। এখানে টমেটোর ফলন বেশ ভালোই হয়। রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে এসে সস্তা দামে টমেটো কিনে নিয়ে যায়। সাধারণ বেলারুশিয়ানদের সঙ্গে মুসলিমদের বিয়ে এখানে হরহামেশাই ঘটছে। নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষায় তারা সচেতনতার সাক্ষর রাখছে। বেলারুশ মুসলিমদের ধর্মীয়নেতা ও প্রধান মুফতি আলি ফুরোনোফেতিশ ।