গৃহবধূ থেকে স্মৃতি যেভাবে হলেন রক্তকন্যা
প্রকাশের সময় : 2022-08-03 16:13:50 | প্রকাশক : Administration
আরাফাত আহমেদ রিফাত: ‘জরুরি রক্তের প্রয়োজন’। এ,বি,এবি,ও নেগেটিভ কিংবা পজেটিভ এক ব্যাগ, কখনো দুই-তিন ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। হয়তো কখনো ছোট শিশু কখনো আবার গর্ভবতী নারী কিংবা বৃদ্ধ কেউ। এমন পোস্ট প্রতিদিনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের চোখে পড়ে। এসব পোস্ট নিজের টাইমলাইন থেকে শুরু করে বিভিন্ন গ্রুপেই দেখা যায়।
অনেক সময় সেলিব্রেটিদের ভেরিফায়েড পেজেও দেখা মেলে এমন মানবিক পোস্টের। কখনো এসব পোস্টের উপর নির্ভর করে রক্ত পাওয়া যায়, আবার কখনো কখনো পাওয়া যায় না। তবে অনেকেই আছেন যারা শুধু ফেসবুকে পোস্ট দিয়েই বসে থাকেন না। রক্তের গ্রুপ জানা আছে এমন মানুষদের ফোন করেন, রক্ত দিতে রাজি হলে যত দ্রুত সম্ভব রক্ত সংগ্রহ করে রোগীর প্রাণ বাঁচান।
এমনি একজন রাজবাড়ী জেলার সোনিয়া আক্তার স্মৃতি। ডাকনাম স্মৃতি হলেও সবার কাছে এখন তিনি রক্তকন্যা নামেই পরিচিত। কারণ স্মৃতি গত ১৩ বছরে ২৭ হাজারের অধিক মুমূর্ষ রোগীকে বিনামূল্যে রক্ত সংগ্রহ করে দিয়েছে। বর্তমানে তিনি প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৫ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে দিচ্ছেন বিভিন্ন জায়গায়। তবে এই রক্তকন্যার জীবনের গল্পটা একটু আলাদা। ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখতেন গরীব ও অসহায় মানুষদের সাহায্য করবেন।
কিন্তু ২০০৭ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কিছুদিন পরই তার বিয়ে হয়ে যায়। ফলে তার স্বপ্নগুলোও মাটি চাপা পড়ে যায়। এ পর্যন্ত গল্পটা বাংলাদেশের আর দশটা সাধারণ নারীর মতোই। তবে এরপর স্মৃতির গল্পটা অন্য সব সাধারণ নারীর মতো নয় যারা ভেঙে পড়ে। বরং তার গল্পটা সেই সব গুটিকয়েক নারীদের মতো যারা ঘুরে দাঁড়াতে জানে।
স্বামীর উৎসাহ আর অনুপ্রেরণায় এবং বন্ধুদের সহযোগিতায় তিনি গরীব ও অসহায় মানুষের জন্য কাজ শুরু করেন। হয়ে উঠেন আজকের রক্তকন্যা। স্মৃতি জানালনে তার শুরুর দিকের কাহিনী, স্মৃতির দাদার অপারেশনে দেরি হয় সময়মতো রক্ত না পাওয়ায়। অপারেশনের পর তিনি মারা যান। তখন থেকেই স্মৃতির মনে হতে থাকে সঠিক সময়ে রক্ত সংগ্রহ করতে পারলে হয়তো তার দাদা বেঁচে যেতেন।
এরপর থেকেই রক্ত নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা জাগে তার। ২০১১ সালের দিকে একদিন তিনি রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে গিয়ে ছিলেন। সেখানে দেখেন একজন বাবা তার মেয়ের জন্য হন্যে হয়ে রক্তের সন্ধান করছেন। স্মৃতির রক্তের গ্র“পের সঙ্গে সেই মেয়ের রক্তের গ্র“পের মিল না থাকায় সেদিন তিনি রক্ত দিতে পারেননি। তবে অনেক খোঁজ করে সেই মেয়েটির জন্য রক্ত জোগাড় করেছিলেন স্মৃতি। সেদিন অসুস্থ মেয়েটির বাবার স্বস্তি দেখে রক্ত নিয়ে কাজ শুরু স্মৃতির।
রক্ত সংগ্রহের পাশাপাশি স্মৃতি বেশ কয়েকবার রক্তদান করেছেন। একদল তরুণ-তরুণীকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘রাজবাড়ী ব্লাড ডোনার্স ক্লাব’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। যার মাধ্যমে তিনি প্রতিনিয়ত মুমূর্ষ রোগীদের রক্ত সংগ্রহ করে দিচ্ছেন। এছাড়াও তিনি এই সংগঠন থেকে ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে রক্তদাতা সংগ্রহ, ফ্রি ব্লাড গ্রুপ নির্ণয় এবং রক্তদানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
রক্ত নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি তিনি ও তার সংগঠন করোনার লকডাউন চলাকালীন গরীব ও অসহায় মানুষের মাঝে বিনামূল্যে খাবার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, গ্লাভস, মাস্ক বিতরণ করেন। কাজ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে রোগীর স্বজনদের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে স্মৃতিকে। ব্লাড ব্যাগ, যিনি রক্ত টেনে দেন তার খরচ, ডোনারের যাতায়াত খরচ, ডোনারের জন্য সামান্য জুস বা ফল কেনাসহ এক ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করতে প্রায় ৪০০-৫০০ টাকা খরচ হয়।
রোগীর স্বজনরা সেই টাকা দেওয়ার সময় ভাবেন তারা হয়তো তাদের কাছে ব্লাড বিক্রি করছে। যা খুবই দুঃখজনক। ব্লাড ডোনাররা বেশিরভাগই ছাত্র। যারা অনেক দূর থেকে এসে রক্ত দিয়ে যায় কোনো রকম সংকোচ ছাড়াই। রক্ত দেওয়ার পর যেন শরীর দুর্বল না হয় এজন্য কিছু ফল বা জুস খেতে হয় তাদের।
ছাত্র হওয়ায় দূর দুরান্তে যাওয়া বেশ খরচ সাপেক্ষ। এজন্য তাদের যাতায়াতের ভাড়াটা দেওয়ার চেষ্টা করেন তারা। তবে স্মৃতি আশা করেন ভবিষ্যতে সবাই এসব বিষয় বুঝতে পারবেন। র্বতমানে স্মৃতি দুই সন্তানের জননী এবং তার স্বামী একজন প্রবাসী। সামাজিক কাজে অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন ‘সাহিত্যের খেয়াঘাট পুরস্কার’, ‘প্রিয়বাসিনী বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড’ সহ অনেক সম্মাননা।