প্রশাসন, পলিটিশিয়ান; পাবলিক এবং পেরেশানী!!

প্রকাশের সময় : 2022-08-17 16:18:25 | প্রকাশক : Administration
প্রশাসন, পলিটিশিয়ান; পাবলিক এবং পেরেশানী!!

সরদার মোঃ শাহীন

 

আসাদা সানকে নিয়ে মাওয়ায় পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ দেখতে গিয়েছিলাম বছর চারেক আগে। মাওয়ার এই প্রান্তে পদ্মায় তখন বেশ কয়েকটা পিলার দাঁড়িয়ে গেছে। আর দিনকে দিন দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল আমাদের মনের বিশ্বাস। যদিও দেশীয় অবিশ্বাসীদের পাল্লা তখনও বেশ ভারী। এদের সন্দেহ আর যায় না। কিছুতেই যায় না। অবশ্য এদের সন্দেহ কোন কালেই যাবার নয়। সব কালেই ছিল। বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের শেষদিন পর্যন্ত এদের সন্দেহ ছিল।

তবে আসাদা সানের ছিল না। পদ্মাসেতু নিয়ে আসাদা সানের কোন সন্দেহ ছিল না। বাংলাদেশের সক্ষমতার উপর তাঁর বিশ্বাস ছিল। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে তাঁর যথেষ্ঠ ধারণা ছিল। অর্থনৈতিক সূচকের প্রত্যেকটা ধাপ তাঁর ছিল ঠোঁটস্থ। পাশাপাশি ছিল বাংলাদেশে বিনিয়োগের চমৎকার পরিবেশ। শ্রমবাজার চড়া হওয়ায় চায়নার বাজারে জাপানীজদের টিকে থাকা যখন দিনকে দিন অসম্ভব হয়ে উঠছিল, জাপান সরকার চাচ্ছিল তৃতীয় কোন দেশ, যেখানে নিশ্চিন্তে বিনিয়োগ করা যায়। করা যায় অপেক্ষাকৃত সস্তাশ্রমের শিল্প কারখানা। আমাদের দেশে এমনি চমৎকার অবস্থা বিরাজ করায় ওদের পছন্দের তালিকার এক নম্বর ছিল বাংলাদেশ।

এটা শেখ হাসিনার অর্জন। বিশাল অর্জন। বঙ্গবন্ধুর অর্জন যেমনি বাংলার স্বাধীনতা, তেমনি শেখ হাসিনার অর্জন দেশটির প্রতি বিদেশীদের আস্থা। বিনিয়োগের জায়গা হিসেবে বাংলাদেশ সেই আস্থা ইতিমধ্যেই বেশ জোরে সোরে অর্জন করে নিয়েছে। পদ্মাসেতু উদ্বোধন সেই অর্জনের আরো একটি স্বীকৃতি। আমাদের উচিত বিনাবাক্য ব্যয়ে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো। অবশ্য স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় যে জাতি তার স্থপতিকেই হত্যা করতে পারে, সে জাতির কাছে একটা পদ্মা সেতুর জন্য কৃতজ্ঞতা আশা করা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।

প্রচন্ড পাষন্ডতার সাথে কী নির্মম আর নৃশংসভাবেই না ওরা স্বপরিবারে মানুষটিকে হত্যা করলো! বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকান্ডের পর বাঙালি জাতির ভাগ্যে অর্জন বলতে তেমন কিছুই ছিল না। সেই যে তিনি আমাদেরকে স্বাধীনতা এনে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই স্বাধীনতার সুফল ভোগ করে তাঁকে নির্মমভাবে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেয়া ছাড়া আমাদের প্রশাসন কিংবা পলিটিশিয়ানরা আর কিছুই দিতে পারেনি।

পেরেছে শুধু খুনীদের সাথে হাত মেলাতে। আর স্তুতিবাক্যে ভরিয়ে দিয়েছে খুনীদের প্রশংসার পংক্তিমালা। এভাবেই দিয়ে গেছে স্বাধীনতা এনে দেয়ার প্রতিদান। আর জাতিকে উপহার হিসেবে দিয়েছে দু’দুটি সামরিক শাসন। উপহারের বাক্স খুলে জাতি পেয়েছে দু’জন ফৌজি মানবকে। যাদেরকে মহামানব বানাবার জন্যে এমন কোন উদ্যোগ নেই যে তারা নেয়নি। এভাবে দেশের প্রশাসন এবং পলিটিশিয়ানরা দলবেঁধে একজনকে করেছে তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা। আর অন্যজনকে পল্লীবন্ধু।

দু’জনই ক্ষমতায় এসেছিলেন খুনখারাবীর মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হরণ করে। অথচ এসেই চারপাশে জড়ো করলেন প্রশাসন আর পলিটিশিয়ানদের। এবং সবক দেয়া শুরু করলেন গণতন্ত্রের। কী কথার বাহার তাদের! তারা গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেবেন। দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়বেন। আর দেবেন উন্নয়ন। উন্নয়নের পাহাড়ে ভরে দেবেন দেশখানি। টানা পনের বছর ক্ষমতায় থেকে এই দু’জন মহামানব শেষতক ঘোড়ার ডিম পারা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেননি। না পেরেছেন দুর্নীতির ‘দ’বদলাতে। না পেরেছেন উন্নয়নের ‘উ’ছড়াতে।

ফলত দেশের প্রশাসন ও পলিটিশিয়ানদের নির্লজ্জ সহযোগিতায় আমজনতা তথা পাবলিক ছিল পেরেশানীতে। সন্দেহ নেই, পেরেশানীতে এখনও আছে। তবে অগ্রগতিও আছে। শেখ হাসিনার দীর্ঘ তের বছরের শাসনামলে গণতন্ত্র আর দুর্নীতি নিয়ে অনেক ডিবেট হতে পারে কিন্তু উন্নয়ন নিয়ে একটি নেগেটিভ কথা বলারও সুযোগ নেই। এটা তো সত্যি, আগের মহামানবদ্বয় তিনটির একটিও দিতে পারেননি। কিন্তু শেখ হসিনা অন্তত একটি দিতে পেরেছেন। উন্নয়ন দিয়েছেন এবং খুব ভালভাবেই দিয়েছেন। তাঁর এই দেয়ার কারণেই জাতি পেয়েছে পদ্মাসেতু। বাবা দিয়েছিলেন স্বাধীনতা, মেয়ে দিলেন পদ্মাসেতু!

সেতুটি উদ্বোধন হলো ২৫শে জুন। আসাদা সান এলেন ২৯শে জুন বাংলাদেশে। বড় আশা নিয়ে আসলেন। জাপানী বিনিয়োগকারী আসাদা সান দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের  জন্যে আসলেন। চায়নাতে করা ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত। চায়না থেকে খুব তাড়াতাড়ি সরে না আসলেই নয়। তাঁর ধারণা পায়রা বন্দর এবং মংলা পোর্ট ঢাকার খুব কাছে চলে আসবে পদ্মা সেতুর বদৌলতে। এবং বরিশাল তথা পায়রা বন্দরের আশেপাশে প্রচুর শিল্প গড়ে উঠবে। শিল্প গড়ে উঠবে মংলা এবং তার আশপাশের এলাকাতেও। তিনি ভাল একটা জায়গা দেখে তাঁর কারখানা শিফট করতে পারবেন বাংলাদেশে। হয়ত এজন্যেই করোনা পরবর্তী দীর্ঘ প্রায় তিনবছর পরে ঢাকা এসে প্রথমেই বরিশাল যাবার ইচ্ছে ব্যক্ত করলেন। একসঙ্গে দুই কাজ করবেন তিনি। রথও দেখবেন আবার কলাও বেঁচবেন। তাঁর কাঙ্খিত কারখানার লোকেশন দেখবেন পাশাপাশি আমার বাবা মা এবং সদ্য প্রয়াত শাশুড়ি মায়ের কবরও জিয়ারত করবেন।

ঢাকায় আসার পর একদিন বিরতি দিয়েই সাত সকালে যাত্রা করেছি। একজন জাপানীজ বিনিয়োগকারীকে নিয়ে বরিশালের উদ্দেশ্যে যাত্রা। ঢাকা অভ্যন্তরীণ টারমিনালে গাড়ি থেকে নামতে যাবো, অমনি শুরু হলো বিপত্তি। ওনাকে নিয়ে গাড়ীটা দাঁড়াতে পারেনি, উনি এক পা মাটিতে রাখতে পারেননি; অমনি ধমক। ওয়েলকাম ধমক। ফাইভস্টার হোটেলে পৌঁছলেই যেমনি এক চুমুক ওয়েলকাম ড্রিংক খেতে হয়, ঠিক তেমনি খেলেন ওয়েলকাম ধমক। সাদা পোশাকের একজন তাঁকে খেঁকিয়ে উঠলেন; তাড়াতাড়ি নামেন। নামতে এত সময় লাগে নাকি!

আসলে নামতে তিনি সামান্যতম দেরী করেননি। তারপরও ধমকটি খেলেন। তাঁর নামার আগেই আমি নেমেছিলাম বিধায় বিনয়ের সাথে জানতে চাইলাম, এত আদরের রহস্য কি? সমস্যা কি? ধমক দিচ্ছেন কেন? লোকটি আমার দিকে তাকালেন না। যেন তাকাবার সময়ই তার নেই। অন্যদিকে তাকিয়েই বললেন, দেখেন না, স্যার আসতেছে। এখানে কোন গাড়ি দাঁড়ানো যাবে না। তার কথার সুরে পুরো ড্যামকেয়ার ভাব।

আচ্ছা! স্যারটা কে একটু বলবেন কি! আমি বললাম। এসবের উত্তর দেয়ার সময় নেই তার। ‘মন্ত্রী আসতেছেন’বলেই তিনি হনহনিয়ে পেছনের গাড়িটির কাছে গেলেন। আমাকে কথা বলার সুযোগই দিলেন না। কেননা পেছনের গাড়িটির যাত্রীকে ধমক দেবার সুযোগটি তিনি হাতছাড়া করতে চাচ্ছিলেন না কিছুতেই। লাউঞ্জে বসে থাকা অবস্থায় মন্ত্রী মহোদয়কে আসতে দেখলাম। চাটগাঁয়ের মন্ত্রী। সাথে হাঁটছেন ভাবসাব নিয়ে বাইরে থাকা সেই লোকটি। মন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা হবেন বড়জোড়।

আজ সাত সকালে এয়ারপোর্টে এসে শুধু আসাদা সানকে নয়, আরো কতজনকে ধমক দিয়েছেন কে জানে! তবে সেদিন ধমক দেয়ার লোকের অভাব ছিল না এয়ারপোর্টে। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে ঢাকায় ফিরেছি। বিকেলটা বড় চমৎকার ছিল। আকাশ ছিল পরিস্কার। গরমটা তেমনি না থাকলেও পুরো এরাইভ্যাল ছিল গমগমে এবং থমথমে। এরাইভ্যাল থেকে বেরিয়ে মুক্ত আকাশে হাঁফ ছেড়ে আসাদা সান মোবাইলে ছবি নিলেন। আকাশের ছবি।

আর অমনি ধমক। হাতে অস্ত্রধারী পোশাকী একজনের ধমক। তার সাফ কথা এখানে ছবি তোলা যাবে না। আর দাঁড়ানোও যাবে না। বেশ কর্কশ ভাষায় তাঁকে সরে যেতে বলায় এবার ক্ষেপে গেল আমার শোনিমের মা। কাহিনী কি? এমন করছেন কেন? আপনার সমস্যা কি? বলেই চেপে ধরলো বন্দুকওয়ালাকে।

-ভিআইপি আসছেন। এখানে থাকা যাবে না।

- তা বুঝলাম। কিন্তু তাই বলে ধমক দেবেন? যেই সাহেব আসছেন তিনি ভিআইপি! আর যাকে ধমক দিলেন তিনি ভিআইপি না? বিশ্বব্যাপী ডলারের এই ক্রাইসিসের দিনে তিনি এসেছেন দেশে ডলার বিনিয়োগ করতে আর আপনি অসভ্যের মত তাঁকে ধমক দিলেন? বলি, তাঁর চেয়ে বড় ভিআইপিটা কে এইদেশে? আপনারা কবে সভ্য হবেন? কবে?

বাংলাদেশের পুলিশ প্রধানকে অভ্যর্থনা জানাতে আসা সিকিউরিটির লোকটি মাথা নীচু করে রইলেন। একই দিনে সকাল এবং বিকেলে পরপর দু’জন হাইপ্রোফাইলের লোকজনের কাছ থেকে ধমক খেয়ে আসাদা সান বড় কষ্টভরা মন নিয়ে জাপান ফিরে গেলেন আরো কয়েকদিন পর। আমাদেরকে বুঝতে দিলেন না। বড় নীরবেই ফিরে গেলেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোনদিন জানতেই পারবেন না, ভিআইপিদের জ্বালায় এভাবে নিত্যদিন ধমক খেয়ে খেয়ে কত বিনিয়োগকারী বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান। দেশে নিত্যদিন বিনিয়োগকারী আসে, নিত্যদিন চলেও যায়। যদিও তথাকথিত ভিআইপিদের এতে কিচ্ছু যায় আসে না। 

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com