ক্যান্সারজয়ী ফারজানা
প্রকাশের সময় : 2022-09-28 14:30:54 | প্রকাশক : Administration
মানসুরা হোসাইন: জাপানে ক্যান্সারের চিকিৎসা করিয়ে সেরে উঠেছেন ফারজানা সুলতানা। ‘কখনোই কেশবতী ছিলাম না, তবে মাথায় চুল বেশ ভালোই ছিল। প্রথম কেমোথেরাপি দেওয়ার পর থেকে চুল ঝরতে শুরু করে। মাথার সব চুল পড়ে যাওয়ার পর আয়নায় যাতে নিজেকে দেখতে না হয়, তাই আয়না ঢেকে রাখতাম। বাইরে এমনকি ঘরেও টুপি পরে থাকতাম।
দুই বছর এক মাস বয়সী ছেলে টুপি পরলেই রাগ করত। এখন আবার মাথাভর্তি চুল গজিয়েছে। ভবিষ্যতে আমার শরীরে ক্যান্সার আবার ফিরে আসবে কি না, তা জানি না। তবে এই মুহূর্তে আমি ক্যান্সার থেকে মুক্ত।’এই কথাগুলো ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলা জাপানে বসবাসরত ফারজানা সুলতানার। তাঁর কণ্ঠে আপাতত স্বস্তির বার্তা। গত এক বছরে ফারজানার জীবনে ঘটে গেছে নানা কষ্টের ঘটনা।
সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘বুঝতে পারছিলাম হাত-পা কালো হওয়া থেকে শুরু করে চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। মাথায় চুল নেই। পরচুলা পরতাম। জাপানে কেউ কারও দিকে তাকায় না। তবে বাংলাদেশে থাকলে এই বিষয়গুলো নিয়ে অস্বস্তির মাত্রাটা বাড়ত।’জাপানের টোকিও মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল ইউনিভার্সিটিতে মলিকুলার ইমিউনোলজি বিভাগের পিএইচডি গবেষক ফারজানা সুলতানা।
২০১৯ সালে জাপান যান তিনি। ২০২০ সালের অক্টোবর সেশনে জাপানের মেক্সট স্কলারশিপ পাওয়ার পর ফারজানার ব্যস্ততা বাড়ে। সব ভালোই চলছিল। তবে শুকনা কাশি, রাতে অনেক ঘাম হতে থাকলো। করোনার সময় বলে কাশি দিলে ল্যাবের অন্যরা বেশ খানিকটা বিরক্তই হতে থাকলেন। তাই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হলো।
গত বছরের ডিসেম্বরে চিকিৎসক জানালেন, ফারজানা মেডিসটিনাল ম্যালিগন্যান্ট লিম্ফোমায় আক্রান্ত। তারপর শুরু হয় অন্য রকমের যুদ্ধ। ফারজানা বলেন, নিজে চিকিৎসক, গবেষণার বিষয়বস্তুও ক্যান্সার। আর পরিবারে ক্যান্সার শব্দটি খুব একটা অপরিচিতও নয়। নানা, নানি আর এক মামা ক্যানসারে মারা গেছেন। এক খালা বাংলাদেশেই স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা করিয়ে গত আট বছর ধরে ভালো আছেন।
তারপরও নিজের ক্যান্সার হয়েছে, এ কথাটি জানার পর তা মেনে নেওয়া বেশ কঠিন ছিল। বিদেশবিভুঁইয়ে ছোট বাচ্চা নিয়ে সব সামাল দেওয়া ছিল কঠিন এক সংগ্রাম। তবে স্বামী এ কে এম নজরুল ইসলাম শুধু ফারজানাকে নয়, সামলেছেন ছেলে ফাইজান নুবাইদকেও। হাসপাতালের খাবার খেতে পারতেন না। স্বামী সারাদিন অনলাইনে অফিস করে, অসুস্থ বাচ্চাকে দেখাশোনা করে, রাতে আবার তার জন্য রান্না করে খাবার হাসপাতালে নিয়ে আসত।
বাসায় কাজের কোনো সহকারী নেই। রোগেশোকে বিধ্বস্ত ফারজানার স্বামী বহুবার আশা হারিয়েছে, বহুবার রাগের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, কিন্তু স্বামীকে কখনো এতটুকু বিরক্ত হতে দেখেনি। যে পরম মমতা ফারজানার স্বামী তাকে দেখিয়েছে, সেটা বিরল। ফারজানা সুলতানা তাঁর ফেসবুকে ক্যান্সারের আগে, ক্যান্সারের চিকিৎসা নেওয়ার সময় টাক মাথার এবং বর্তমানে ছোট চুলের তিনটি ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘তিনটি ছবিই আমার নিজের। তিনটি ছবিই গত এক বছরের মধ্যে তোলা।’
ছবি তিনটি দিয়ে সে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘আমার নেই এটা নিয়ে যেমন হতাশ হওয়ার কিছু নেই, তেমনি আমার আছে এটা নিয়ে অহংকার করারও কিছু নেই। সৃষ্টিকর্তা চাইলে নিতেও সময় লাগে না আবার দিতেও সময় লাগে না।’ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস কালীন দিনের পর দিন তিনি তার ছেলেকে দেখেনি। শুধু ক্যান্সারের কারণেই ফারজানা অসুস্থ মাকে দেখতে বাংলাদেশে আসতে পারেননি।
মায়ের দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে যায়। এর মধ্যে মা করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২২ দিন হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি ছিলেন। দুই দেশে মা ও মেয়ের চরম খারাপ অবস্থা। ফারজানার তখন রেডিওথেরাপি চলছিল। কেউ কাউকে দেখতে যেতে পারছেন না। ফারজানা বলেন, ‘মায়ের অসুস্থতার সময় ডানা ঝাপটিয়েছি শুধু, উড়াল দিতে পারিনি। তারপর মাত্র ৫১ বছর বয়সে মা মারা গেলেন।’
ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করার শক্তিটা ফারজানা পেয়েছিলেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে। বলেন, ‘আমি আমার মাকে দেখেছি শুধু মনের জোরে দুটো অচল কিডনি নিয়ে দিনের পর দিন লড়াই করছেন। অসুস্থ শরীরে পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিসের জন্য ব্যবহার করা স্যালাইন ব্যাগ নিয়ে আম্মু উমরাহ করতে গেছেন। আম্মুর কাছ থেকেই শিখেছি, শরীরের মৃত্যুর আগেই যেন কোনোভাবে মনটাকে মেরে না ফেলি।’
বাংলাদেশে ফারজানার বাবা আর এক বোন আছেন। তার মা যখন বেঁচে ছিলেন তখন যাতে চিন্তা না করেন, তাই প্রথম দিকে ক্যান্সারের কথা গোপন করেছিলেন ফারজানা। বাংলাদেশ থেকে ভিডিও কল দিলে ফারজানা টুপি পরে চাদর গায়ে দিয়ে কথা বলতেন। মায়ের মন হয়তো কিছু আন্দাজ করত। তাই শুধু জানতে চাইতেন, মাথায় টুপি কেন? তখন ঠান্ডা থাকায় কোনোভাবে প্রশ্নগুলোকে পাশ কাটাতে পারতেন।
ফারজানা বলেন, ‘ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়ার মতো অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। তারপরও ভেঙে যাইনি। এখনো আমি বেঁচে আছি, ভালো আছি। পিএইচডি সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে গেছি, এখন আবার নিয়মিত ল্যাব, গবেষণা, সংসার সবই করছি। আমি এখনো সুন্দর সুস্থ একটা জীবনের স্বপ্ন দেখি।’ফারজানা বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে জাপানে যান।
ক্যান্সার ধরা পড়ার পর শুরু হয়েছিল বিশাল এক জার্নি। টিউমারটা ছিল তার হার্ট আর লাংসের মাঝে, অনেকগুলো ভাইটাল আর্টারি আর অর্গান রয়েছে সেখানে। অপারেশন করাটা খুব জটিল ছিল। চিকিৎসকেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শুধু কেমোথেরাপি আর রেডিওথেরাপি দিয়ে টিউমারটা অপসারণ করবেন। ছয়টি কেমোথেরাপি আর ২০টি রেডিওথেরাপি লেগেছিল। সব মিলে সময় লেগেছিল ছয় মাস।
হেলথ ইনস্যুরেন্সসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরও খরচ হয় বাংলাদেশি ছয় লাখ টাকা। আর ছয় মাসের এক একটা দিন তার কাছে এক একটা বছরের মতো মনে হতো। বাংলাদেশে কখনো ক্যানসারের চিকিৎসা করাননি, তাই চিকিৎসার মান নিয়ে কিছু বলতে চান না ফারজানা। তবে খালার উদাহরণ দিয়ে বলেন, খালা বাংলাদেশেই চিকিৎসা করিয়েছেন এবং আট বছর ধরে ভালো আছেন।
ক্যানসার চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ হলো কত তাড়াতাড়ি ক্যানসার শনাক্ত করা সম্ভব হলো। শনাক্ত করতে যত সময় বেশি লাগবে ততই ভালো হওয়ার আশা কমতে থাকবে। ফারজানা এ ক্ষেত্রে তাঁর ল্যাবের সহকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। কেননা, তাঁদের বিরক্তি কমাতে এবং আশ্বস্ত করতেই তিনি দ্রুত চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন। তারপরও প্রায় আড়াই মাস লেগে গিয়েছিল, আর তত দিনে ক্যান্সার দ্বিতীয় ধাপে ছড়িয়ে পড়েছিল। ফারজানা বলেন, ‘সুস্থতা যে কত বড় নিয়ামত, সেটা অসুস্থ না হলে আসলে বোঝা যায় না। তাই রোগকে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না।’- সূত্র: অনলাইন