ইয়েমেন: মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গরিব দেশ
প্রকাশের সময় : 2022-10-13 16:12:40 | প্রকাশক : Administration
জেসিউর রহমান শামীম: পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশেরই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেগুলি হতে পারে দেশটির স্থানীয় খাবার সুন্দর শহর কিংবা সুন্দর সব গ্রাম। এই বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্ববাসীর সামনে দেশটির এমন একটি ভাবমূর্তি তৈরি করে যা দেশটিকে আকর্ষণীয় করে তোলে। তেমনি একটি দেশ ইয়েমেন। যার সরকারি নাম রিপাবলিক অফ ইয়েমেন। ইয়েমেন মধ্যপ্রাচ্যের এক দরিদ্র দেশ। এটিকে সবচেয়ে বিপদজনক জায়গাও বলা হয়। এর কারণ যদি খোজা হয় তাহলে দেখা যায় যুদ্ধ এর মূল কারণ। এ ছাড়াও বহু আতঙ্ককারী সংগঠন এর জন্য দায়ী।
এটি আরব উপদ্বীপের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র, যার খুব সমৃদ্ধ একটি ইতিহাস আছে। এটি অতীতে অত্যন্ত ধনী দেশ ছিলো। যদিও আজ এই অঞ্চলটি বিভিন্ন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক সমস্যায় ভুগছে। আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তের মরুভূমি বেষ্টিত দরিদ্র দেশ এটি। এর মোট আয়তনের অর্ধেকের বেশিই মরুভূমি এবং বসবাসের অযোগ্য। পৃথিবীতে যতগুলো প্রাচীন জনপদ রয়েছে তার মধ্যে ইয়েমেন অন্যতম। এর প্রতিবেশি দেশ সৌদি আরব এবং ওমান। এর দক্ষিণে রয়েছে আরব সাগর এবং এর পশ্চিমে রয়েছে লোহিত সাগর। প্রাচীনকালে এই জনপদ অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। আরব বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু হলো ইয়েমেন।
ইয়েমেনে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা এবং প্রাকৃতিক বিস্ময় রয়েছে। যার মধ্যে সব থেকে বিস্ময়কর হচ্ছে শিবাম নগরি। এখানে শুধু মাটি দিয়ে তৈরি বহুতল ভবন আছে। যেগুলো ৫ তলা থেকে ১১ তলা পর্যন্ত। এখানে প্রায় ৫০০ টি ভবন আছে। আর এই ভবন গুলো প্রায় সতের শত বছরের পুরনো। ২০০৯ সালের আল কায়দার হামলা ও সম্প্রতিক গৃহ যুদ্ধে বিস্ময়কর এই সৃষ্টির ব্যাপক ক্ষতি হয়। দেশটির আরও একটি বিস্ময় হচ্ছে সুকাত্রা দ্বীপ। মূল ভূমি থেকে প্রায় ৩৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের এই দ্বীপটিতে অদ্ভুত সব প্রাণি ও উদ্ভিদের দেখা মিলে। যার কারণে এই দ্বীপটিকে এলিয়েনের দ্বীপও বলা হয়।
অপরিশোধিত তেল উৎপাদনের বাইরে, ইয়েমেনের প্রধান পণ্যগুলি হল সিমেন্ট, বাণিজ্যিক জাহাজ মেরামত এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের মতো জিনিসগুলি। কৃষিজাতি ও গোষ্ঠীগুলিতে বেশিরভাগ নাগরিক নিযুক্ত হওয়ার কারণে দেশটিতে কৃষি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইয়েমেনের কৃষি পণ্যগুলির মধ্যে শস্য, ফল, শাকসবজি, কফি এবং গবাদি পশু এবং হাঁস-মুরগি রয়েছে।
আরব বিশ্বের সবচেয়ে গরিব দেশ ইয়েমেনে লড়াইয়ের শুরুটা হয় আরব বসন্ত দিয়ে। যার মাধ্যমে আসলে দেশটিতে স্থিতিশীলতা আসবে বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু ঘটেছে উল্টো। তিন বছরের যুদ্ধে দেশটি এখন প্রায় পুরোপুরি বিপর্যস্ত।
৫ লাখ ২৭ হাজার ৯৬৮ বর্গকিলোমিটার এর এই দেশের মোট জনসংখ্যা ২ কোটি ৭৫ লাখ ৮৪ হাজার ২১৩ জন। যার প্রায় অর্ধেকটাই মানব বসবাসের অযোগ্য। সানা হল ইয়েমেনের সবচেয়ে বড় শহর ও রাজধানী। ধারণা করা হয় এটি পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো শহরগুলোর মধ্যে একটি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৩০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত হওয়ায় এটি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু শহর। এক সময় দেশটির শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র ছিল এর রাজধানী শহর সানা। কিন্তু বিভিন্ন কারণে ধীরে ধীরে এলাকাটির গুরুত্ব হ্রাস পায় এবং তাদের ভাগ্যের উন্নয়নও খুব একটা হয় নি।
ইউনেস্কো সানাকে ‘ওয়াল্ড হেরিটেজ অফ মেনকাইন্ড’ বলে ঘোষণা করেছে। প্রাচীন শহর হওয়ায় এতে প্রচুর প্রাচীন স্থাপত্যের সমাহার দেখা যায়। ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ২,০০০ অব্দের দিকে উত্তর ইয়েমেনে প্রথম জনবসতি গড়ে ওঠে। খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দের দিকে এ অঞ্চল ব্যবসায়ের জন্য বিখ্যাত হতে শুরু করে। এ সময়ে ইথিওপিয়া এ অঞ্চল দখল করে। পরবর্তী প্রায় ১৩০০ বছর এ অঞ্চলের বিভিন্ন উপজাতি ও ধর্মীয় গন্ডগোল লেগেই ছিল। সানা হল বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন জনবহুল শহর।
১৫১৭ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত ইয়েমেনের উত্তর অংশ অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। যদিও ১৮৩৯ সালে এর এডেন উপত্যকা ব্রিটেন দখল করে নেয় এবং ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত দখল করে রাখে। ১৯৬৭ সালে দক্ষিণ ইয়েমেন পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করে এবং কমিউনিস্ট মতাদর্শে পরিচালিত হতে থাকে। যদিও জনগণের ভাগ্যের খুব একটা পরিবর্তন হচ্ছিল না। বিংশ শতাব্দীর শেষে তেলের খনির আবিষ্কার দেশটির জনগণের আশার আলো হয়ে আবির্ভূত হলেও দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে তা জীবনমানের খুব বেশি একটা পরিবর্তন ঘটায়নি। বরং আরব বসন্তের পর জনগণের অবস্থা এতটাই খারাপ হয় যে দুর্ভিক্ষের অভিশাপ হানা দেয় দেশটিতে।
সানার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মসজিদ, আল জামা-আল-কবর (গ্রেট মসজিদ) -তে একটি পবিত্র মাজার রয়েছে যা একসময় জায়েদ উপাসনার প্রধান বিষয় ছিল। সানার উত্তরে অবস্থিত রাওয়াহ বাগানের শহরতলিতে মরিশ শৈলীতে একটি সুন্দর মসজিদ রয়েছে।
শতাব্দী ধরে চলে আসা ঐতিহ্যগত ভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে এই ইয়েমেনে। ৩১ দিন ধরে বিরতিহীন ভাবে চলে এই বিয়ের অনুষ্ঠান। বিশ্বের সবচেয়ে ভালো এবং দামী মধু দোয়ানি মধু এই ইয়েমেনেই পাওয়া যায়। দেশটিতে ইয়েমেনি আরবি ভাষা প্রচলিত। মারিব শহরে ৩ হাজার বছর আগে নির্মিত বাধ এখনো দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও প্রায় প্রতিটি শহরে সে সময়ের নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। দেশটির শিক্ষার হার মাত্র ৬৪ শতাংশ। দেশটির প্রায় শত ভাগ মানুষ মুসলিম। এদের মধ্যে প্রায় ৫৫ ভাগ সুন্নি।