ডিজিটাল ডাকঘরের উদ্যোক্তারা
প্রকাশের সময় : 2022-10-26 15:53:13 | প্রকাশক : Administration
হাবিবুল আলম: নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় এলাকার এক বখাটের সঙ্গে বিয়ে হয় রাজবাড়ী জেলার দেবগ্রামের মেয়ে রাহেলার (৩০)। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে, তাই দ্রুত বিয়ে দেওয়াই নিরাপদ মনে করেছিলেন বাবা। কিন্ত যৌতুকলোভী ও মাদকসেবী স্বামীর সংসার বেশিদিন করা হয়নি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ভাঙে সংসার। মেয়ের সংসার ভাঙার বেদনায় বাবাও চলে যান না-ফেরার দেশে। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তখন দিশেহারা পুরো পরিবার। বড়ো হওয়ায় পাঁচজনের পরিবারে হাল ধরার দায়িত্ব বর্তায় রাহেলার ওপর। এই সময়ে অনেকটা অনাহারে দিন কাটাতে হয়েছে রাহেলা ও তার পরিবারকে। তবে দমে যাননি। শোককে পুঁজি করে আবারও স্কুলে ভর্তি হন। দুই বছর পড়ালেখা বন্ধ থাকলেও স্কুলে ভালো ছাত্রী হিসাবে সহপাঠী ও শিক্ষকদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন।
শতকষ্টের মাঝেও সামনে এগিয়েছেন। সংসার আর পড়ালেখার খরচ জুগিয়েছেন প্রাইভেট পড়িয়ে। এসএসসি পাশ করে ভর্তি হন কলেজে। পরিবার চালাতে স্থানীয় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় (এনজিও) চাকরি নেন। চাকরি করা অবস্থায় এইচএসসি ও ডিগ্রি পরীক্ষায় পাশ করেন। এরপর চাকরির পেছনে না ঘুরে নিজে কিছু করবেন বলে স্থির করেন। সরকারি খরচে কম্পিউটার শিখে নিজ ইউনিয়নে উদ্যোক্তা হিসাবে ২০১৪ সালে কাজ শুরু করেন।
উদ্যোক্তা হওয়ার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে রাহেলা বলেন, ‘প্রথমে গ্রামের সাধারণ মানুষের ডিজিটাল সেবা সম্পর্কে ধারণা ছিল না। তবে ধীরে ধীরে তারা এ সেবা সম্পর্কে বুঝতে পেরেছেন। ফলে এখন আমাদের আয়ও ভালো হয়েছে। বর্তমানে মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় করতে পারি। এখন আর সংসারে অভাব-অনটন নেই। তিন বেলা বোনদের নিয়ে ভালো খেতে পারি।’
সেবাগ্রহীতা তানিয়া বলেন, ‘এখন অধিকাংশ সেবা ডিজিটাল হওয়ায় কম সময়ে বেশি সেবা পাওয়া যায়। আর গ্রামে হওয়ায় সেবা নিতে শহরে যাওয়ার দরকার হয় না বললেই চলে। উদ্যোক্তারা পরিচিত হওয়ায় প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। এজন্য ডিজিটাল ডাকঘরেই সেবা নিতে বেশি আসি।’
প্রীতম দাশ। স্থানীয় একটি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন ২০১৪ সালে। বৃন্দাবন সরকারি কলেজে ম্যানেজমেন্টে অনার্স পড়াশোনা শুরুর পর থেকেই তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ইচ্ছা ছিল কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার। কিন্তু সুযোগের অভাব ছিল, বিশেষ করে অবকাঠামোগত সুবিধার। অবশেষে তিনি খোঁজ পান বাংলাদেশ ডাক বিভাগের পোস্ট ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি প্রজেক্টের। পরীক্ষা দিয়ে জেলার একজন উদ্যোক্তা হিসাবে নির্বাচিত হন। ডাকঘর বিভাগের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে পান ল্যাপটপ, মডেম, ফটোপ্রিন্টারসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য সামগ্রী। এরপর শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা ডাকঘরে উদ্যোক্তা হিসাবে যোগ দেন।
ডিজিটাল ডাকঘর থেকে ই-মেইল আদান-প্রদান, কম্পিউটার কম্পোজ, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, ছবি স্ক্যানিং, ছবি তোলা ও প্রিন্টসহ বিভিন্ন সেবা পাওয়া যায়। কিন্তু এসব সেবা এই উদ্যোক্তার পার্শ্ববর্তী অনেক কম্পিউটারের দোকানেও পাওয়া যায়। তবে সেখানে গুণগত মানের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো প্রতিষ্ঠান ছিল না বললেই চলে। এ বিষয়টি অনুধাবন করে প্রীতম এমএস অফিস অ্যাপ্লিকেশন যেমন: ওয়ার্ড, এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্ট প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণে আগ্রহীদের খোঁজ নিতে শুরু করেন। প্রকল্প থেকে পাওয়া ল্যাপটপ দিয়ে শুরু করেন প্রশিক্ষণ।
অন্য উদ্যোক্তাদের মতো শুরুটা খুব সহজ ছিল না প্রীতমের। ২০১৬ সালে যখন কাজ শুরু করেন, তখন প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা ছিল নগণ্য। মাসে হয়তো একজন বা দুজন প্রশিক্ষণার্থী পাওয়া যেত। সময় বদলেছে। সময়ের সঙ্গে চাহিদা বাড়ায় ঋণ নিয়ে অতিরিক্ত ৮টি ল্যাপটপ কিনে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। সরকারিভাবে পাওয়া ল্যাপটপ বিকল হয়েছে ইতোমধ্যেই। কিন্তু নিজের অদম্য ইচ্ছায় প্রশিক্ষণ অব্যাহত রেখেছেন।
প্রথমদিকে আয় খুব কম ছিল এই উদ্যোক্তার। কখনো এক হাজার আবার কখনো পাঁচশ টাকা আয় হতো। এখন কোনো মাসে ২০ হাজার টাকাও আয় করেন। প্রীতমের সেন্টারের অনেক প্রশিক্ষণার্থীই এখন সরকারি চাকরি করছেন। তাদেরই একজন জুয়েল, যিনি বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদে কাজ করছেন। উল্লেখ্য, এখন পর্যন্ত পাঁচশর অধিক প্রশিক্ষণার্থী প্রীতমের এই সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক প্রশিক্ষণার্থী মনে করে, ডাক বিভাগ কম্পিউটার প্রশিক্ষণের যে সার্টিফিকেট দেয়, সেটা চাকরিদাতা কর্তৃক যথাযথ মূল্যায়ন হয় না। সেজন্য প্রশিক্ষণার্থীরা কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সার্টিফিকেট পাওয়া যায়-এমন সেন্টারে প্রশিক্ষণ নেওয়ার ওপরই বেশি গুরুত্ব দেয়। তাছাড়া কম্পিউটারসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী বিকল হয়ে গেলে সরকারি খরচে যদি মেরামত করে দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের মতো উদ্যোক্তা যাদের আয় তুলনামূলক কম, তাদের জন্য খুবই ভালো হয়। ’
রাজবাড়ীর পোস্টমাস্টার মোঃ রিয়াজুল হক জানান, ‘উদ্যোক্তারা ভালো করছেন। প্রতিষ্ঠানগুলোয় উদ্যোক্তা থাকার ফলে সাধারণ মানুষ যেমন সেবা পাচ্ছেন, ঠিক তেমনই উদ্যোক্তারাও লাভবান হচ্ছেন। পর্যায়ক্রমে উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে। বর্তমানে রাজবাড়ীতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৭০ জন পুরুষ ও নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন। এসব উদ্যোক্তা চাকরিজীবীদের চেয়েও ভালো আছেন। কারণ এখান থেকে চলে গেলেও বেকার থাকবে না তারা। তাই সবার উচিত-চাকরির পেছনে না ঘুরে নিজ থেকেই কিছুর চেষ্টা করা। এমন হলে বেকারত্বের হার কমবে।’
বাংলাদেশ ডাক বিভাগের পোস্ট ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি প্রজেক্টের সঙ্গে কাজ করছে ব্যাংক এশিয়া। ব্যাংক এশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী বলেন, ‘সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ৮ হাজার ৫০০ ডিজিটাল ডাকঘরকে ‘ব্যাংকিং হাব’হিসাবে পরিণত করা হবে, যা ব্যাংক এশিয়ার অন্যতম লক্ষ্য; যেখান থেকে মানুষ ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিতভাবে গ্রহণ করবে। এমন উদ্যোগ গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে। তদুপরি সরকারের ঘোষিত গ্রামকে শহরে উন্নীত করার মহান কাজটিতে ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট ব্যাংকিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলেই বিশ্বাস। ’
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘ডিজিটাল বাণিজ্য যত বাড়বে, ডাকঘরের চাহিদা ও গুরুত্ব তত বাড়বে। এজন্য ডাকঘরকে সম্পূর্ণভাবে ডিজিটাল ডাকঘরে রূপান্তরের বিকল্প নেই। ডাকঘরকে ডিজিটাল যুগের উপযোগী করে গড়ে তুলতে প্রণীত ডিজিটাল সার্ভিস ডিজাইন ল্যাব (ডিএসডিএল) প্রস্তাব ডিজিটাল ডাকঘর প্রতিষ্ঠায় একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক।’
২০১৪ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের ফলে প্রান্তিক পর্যায়ে যেমন ডিজিটাল সেবা পৌঁছে গেছে, তেমনই নতুন উদ্যোক্তাও তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বাড়ছে। সর্বোপরি প্রীতম বা রাহেলার মতো সফল উদ্যোক্তা দেখে অনেক তরুণ-তরুণী অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। সরকারি এই উদ্যোগ আগামী দিনে অব্যাহত থাকলে আশা করা যায় সেবাগ্রহীতা ও উদ্যোক্তা উভয়ই আরও বেশি উপকৃত হবেন। ফলে দীর্ঘমেয়াদে গ্রাম ও শহরের ডিজিটাল বৈষম্য আরও কমবে। - সংগৃহিত