বিএনপির তাওয়ায় সরকারের তা!

প্রকাশের সময় : 2022-11-09 11:51:15 | প্রকাশক : Administration
বিএনপির তাওয়ায় সরকারের তা!

মোস্তফা কামাল: বিএনপির আন্দোলন বা সভা-সমাবেশের তোড়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যাওয়ার মতো দল আওয়ামী লীগ? সেই সাংগঠনিক হিম্মত বিএনপির আছে কিনা, তা অন্য অনেকের চেয়ে সরকারের বেশি জানার কথা। দলটির হাঁড়ির খবরও জানে সরকার। তাহলে কেন নানা ছলাকলায় বিএনপির সভা-সমাবেশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি? এতে বিএনপির সমাবেশ খবরের আগেই খবর হয়ে যাচ্ছে। ফাও তালে ভাইরাল হচ্ছে মিডিয়া কভারেজে। এক অর্থে সরকারই সফল বা গুরুত্বপূর্ণ করে দিচ্ছে দলটির কর্মসূচিগুলোকে। সর্বশেষ অতিবুদ্ধিতে বা ক্ষমতার জোশে তা করেছে খুলনায়।

এর আগে ময়মনসিংহে করেছে, শেষ মুহূর্তে বিএনপির সমাবেশের নির্দিষ্ট ভেন্যু নিয়ে তালবাহানা করেছে। মরা গাঙে জোয়ার আনার মতো বিএনপি কর্মীদের চাঙ্গা করে পরে আরেক জায়গায় সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। এই জল ঘোলা করারও বেনিফিট পেয়েছে বিএনপি। গণমাধ্যমে দলটিকে আপনা-আপনি কভারেজ পাইয়ে দিয়েছে। এসবের কোনো দরকার ছিল সরকারের? এ প্রশ্ন ঘুরতে ঘুরতেই খুলনায় সরকার এ চর্চাটি করেছে আরো বেশি মাত্রায়। মালিক-শ্রমিকদের দিয়ে খুলনার ১৮টি রুটে সড়কে সমাবেশের দিন ও আগের দিন দুদিন ধর্মঘট করে ছাড়িয়েছে।

এ ধরনের খুচরা চাতুরি কি না করলেই হতো না? এতে কি অর্জন হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের? বরং অর্জন হয়েছে বিএনপির। আর মোটা দাগে সরকারের হয়েছে বদনাম। উঠেছে অনেক প্রশ্ন। খুলনা অঞ্চলে পরিবহন ধর্মঘটে বড়জোর কিছু জ্বালানি তেল সাশ্রয় হয়েছে। উপরন্তু বিএনপিকে সুযোগ করে দেয়া হয়েছে ‘সরকার ভয় পেয়েছে’ মর্মে চড়া গলায় কথা বলার। এ উপকারের স্বীকৃতি বিবেচনায় সরকার বিএনপির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ আশা করলে তা অমূলক হবে না।

নানা ঢংয়ে জলপথ-সড়কপথ বন্ধ করে বিরোধী পক্ষকে সমাবেশ করতে বাধা দেয়া রাজনৈতিক সুস্থতা নয়। এতে কোনো অর্জন আসে না। বরং দুর্বল বিরোধী দলকে সাবল্যের ক্রেডিট পাইয়ে দেয়া হয়। সেই সঙ্গে জোগান দেয়া হয় পাবলিক সিমপ্যাথির সুযোগ। আওয়ামী লীগের মতো একটি লড়াকু ও প্রাচীন দলের এ অভিজ্ঞতা অনেক। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময় তখনকার ক্ষমতাসীন বিএনপি এ ধরনের কাজ করে ধিকৃত হয়েছে। বিএনপি মন্দ কাজ করেছে বলে আওয়ামী লীগ সরকারও তাই করবে- তা কোনোক্রমেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। মন্দ সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখা বা তাতে সায় দিয়ে সাফাই গাওয়ার মধ্যে রুচির দৈন্য প্রকাশ পায়। আর অপজিশনকে করে দেয়া হয় শর্টকাট পজিশন। খুলনায় সেই প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে বিএনপির।

স্থলে-জলে সরকারি দলের বাধার মধ্যেও বিএনপি নেতাকর্মীরা বিভাগের বিভিন্ন এলাকা থেকে নানাভাবে খুলনা শহরে পৌঁছেছেন। সমাবেশটি শনিবার দুপুর ২টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শুক্রবার রাত থেকেই কয়েক হাজার মানুষ সমাবেশস্থলে জড়ো হয়ে যায়। খুলনায় থাকার জায়গা না থাকায় কর্মীরা চট বিছিয়ে রাজপথেই অবস্থান নেয়। গ্রেপ্তার এড়াতে তারা একসঙ্গে থাকার কৌশল নেয়। এর মধ্য দিয়ে একটি সরগরম উৎসব আমেজ তৈরি হয়। এতে সমাবেশের আগেই সমাবেশ সফল হয়ে যায়। সমাবেশ থেকে বিএনপির যা অর্জন হতো তার চেয়ে বেশি প্রাপ্তি যোগ হয়ে যায়। একদিনের মিডিয়া কভারেজ পায় টানা ৩ দিন। বিএনপির সমাবেশ ঠেকাতে গিয়ে সরকারের নেপথ্য আয়োজনে পরিবহন ধর্মঘট ৩ দিন খুলনা এবং আশপাশের জেলার লাখো মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে। তা ঢাকতে মন্ত্রী ও নেতাদের বারবার বলতে হচ্ছে পরিবহন ধর্মঘটের সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষ যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। তাই বলে বিএনপি বা তাদের হিতাকাক্সক্ষীরা এ উপকার বা সাফল্যের কৃতিত্ব কি সরকারকে দিয়েছে? মোটেই না। বরং সারাদেশ থেকে খুলনাকে বিচ্ছিন্ন করে মানুষের বিরক্তি যোগ হয়েছে সরকারের ঝুলিতে। সেই সঙ্গে ভুল বার্তা গেছে মানুষের কাছে। যে বার্তা কখনোই ক্ষমতাসীনদের সুখকর হয় না।

বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশ করতে দিলে সরকারের লোকসান হয় না। আর আওয়ামী লীগের মতো বিশাল দলের জন্য তো সেই শঙ্কাই নেই। কী সরকারে, কী বিরোধী দলে রাজপথের আন্দোলনে তাদের কাবু করার সক্ষম দল এ মুল্লকে কখনো ছিল না। এখনো জন্ম নেয়নি। তার ওপর খুলনা আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত এলাকা। খুলনা বিভাগে এখনো আওয়ামী লীগ যে কোনো নির্বাচনে ভালো ফলাফল করে। এখানের সব মানুষ বিএনপি করে না। বিএনপির সমাবেশে যায় না, বিএনপিও সেই দাবি করে না। কিন্তু নির্বোধের মতো পুরো জনপদের মানুষকে বিএনপি বানিয়ে দেয়ার কান্ডকীর্তি ঘটানো দলটির মানায়নি। ক্ষমতায় থাকতে বিএনপিও এমন করেছিল। এর পরিণতিও ভুগেছে। বা এখনো ভুগছে। আওয়ামী লীগ কেন বিএনপির চর্চা হাওলাত করবে?

আন্দোলন-সমাবেশ-বিক্ষোভ ইত্যাদি কারো দান বা দয়া-দাক্ষিণ্যের বিষয় নয়। এক সময় তা করতে চাইলেই করা যেত। সারা বিশ্বে, এমনকি বাংলাদেশেও তার শত শত উদাহরণ ছিল। সমাবেশ বা মিছিল করা এক সময় ছিল পুলিশকে অবহিত করার বিষয়। সেই ‘অবহিতকরণ’ গত বছর কয়েক দিন ধরে উপনীত হয়েছে ‘অনুমতিতে’। কোথাও সভা-সমাবেশ করলে পুলিশকে অবহিত করে রাখার ব্যাপার ছিল। পুলিশ আশপাশে অবস্থান নিয়ে কর্মসূচিটির নিরাপত্তা সহায়তা দিত। বিএনপি সরকারই সেটাকে পুলিশের অনুমতি নেয়ার পর্যায়ে এনেছে। তাদের তালিমটা আচ্ছা মতো নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। তারা সেটাকে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ নিয়ন্ত্রণের জায়গায় এনে ঠেকিয়েছে। অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্টাইলে এগোচ্ছে তারা। কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রামে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা দলটিকে তা মানায় না।

এর জেরে এরই মধ্যে রাজনীতির বাইরের মানুষের মধ্যেও সরকারের ভয় পাওয়ার গসিপ চলছে। এ সুযোগ করে দিয়েছে সরকারই। ভয় না পেলে সরকার এত অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে কেন? বিএনপিকে নিষ্ফলা, মরা গাঙ, মাজা ভাঙা ইত্যাদি সম্বোধন বাড়ছে কেন? কেনই বা দলটির সমাবেশের উপস্থিতিকে মামুলি বলে তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে? এসব করে তাদের উসকে দেয়া হচ্ছে? নাকি গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে? এসব প্রশ্নের জবাব কূলকিনারাহীন। নিষ্পত্তিহীনও। প্রতিপক্ষকে হেয়, অপদস্থ, নাজেহালের মাধ্যমে স্মার্টনেস শো করা এক ধরনের অসুস্থতা। কারো অসুখ-বিসুখ নিয়ে তাচ্ছিল্য করা আক্রান্তদের জন্য নির্মম কষ্টের। শুধু রাজনীতির কারণে মানবিক সম্পর্কও এভাবে আলগা হয়ে গেলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। হিংসা-ক্লেদ এ পর্যায়ে চলে যাবে কেন?

কারো রোগ-শোক যেমন সন্দেহের বিষয়ে রূপ নেয়া ঠিক নয়। খুশি হওয়ার বিষয়ও নয়। রোগও আপেক্ষিক হয়ে গেলে শোক নিয়েও সুখ পাওয়ার নোংরামি চেপে বসবে। রাজনীতির উঠানে মানবিকতার হাহাকারে দানবিকতাকে হৃষ্টপুষ্ট না করে পারে না। অশ্রদ্ধা-অবিশ্বাসের চলমান নোংরা দৌঁড়ে তারা নিজেরা কোথায় যাচ্ছেন? মানুষকেই বা কোথায় নিয়ে যেতে চান? হাসি-কান্না, রাগ-অনুরাগ মানুষের চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যের অংশ। এগুলো থাকে না যন্ত্রের, রোবটের। পারস্পরিক শ্রদ্ধা-বিশ্বাস শেষ হয়ে গেলে রাজনীতির সঙ্গে সামাজিক চর্চা কেবল ক্ষয়ে যেতেই থাকবে।

তাচ্ছিল্য করে, সভা-সমাবেশে বাধা না দিয়ে কোনো দলকে নিঃশেষ করা গেলে আওয়ামী লীগ কবেই রাজনীতির মাঠ থেকে ‘নাই’হয়ে যেত। বরং আওয়ামী লীগ অবিরাম সংগঠিত হয়েছে। সেই ইতিহাস আওয়ামী লীগেরই সবচেয়ে ভালো জানা। তাই বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশ ধরনের কর্মসূচি পালনের সুযোগ দিয়ে আওয়ামী লীগ বর্তমানেই নতুন ইতিহাস জন্ম দিতে পারে। নইলে পরিস্থিতি এর মধ্যে যে জায়গায় ঠেকেছে সেখানে সমাবেশ ডাকবে বিরোধী দল, তাতে বাধা দেবে সরকারি দল, পেটাবে-ধরবে পুলিশ। গণপরিবহন ধর্মঘট ডাকবে মালিক-শ্রমিকরা। সরকার বলবে এ ধর্মঘটের সঙ্গে তারা নেই। এ ধারা কেবল চলতেই থাকবে না, আরো ঢালপালা ছড়াবে। এ দেশে মন্দচর্চা কমে না। একবার চালু বা শুরু হলে থামে না। চলতেই থাকে। কারো জন্যই এটি ভালো হয় না। তবে আক্রান্তদের সুবিধা পাইয়ে দেয়। - সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com