এ.টি.এম হায়দার: বাংলার কিংবদন্তি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা

প্রকাশের সময় : 2022-11-09 11:51:39 | প্রকাশক : Administration
এ.টি.এম হায়দার: বাংলার কিংবদন্তি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা

১৯৭১ সালের মে মাস। সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে তখন। অপারেশন সার্চলাইটের রাতে বাংলাদেশী সৈন্যদের যে প্রতিরোধ ছিল ঢাকাতে তারপরে তেমন কিছু আর দেখা যেত না। সীমান্তবর্তী এলাকায় যুদ্ধ চললেও ঢাকায় তখনও কোন মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম শুরু হয়নি। এদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নির্দেশে বিশ্ববাসীর কাছে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক বোঝাতে ঢাকাতে খুলে দেয়া হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তারা বিশ্ববাসীর কাছে বোঝাতে চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক। কেননা তখন বিশ্ব মিডিয়ার কভারেজ পেত শুধু পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা। তাই দখলদার হানাদার বাহিনী চেয়েছিল ঢাকার অবস্থা স্বাভাবিক দেখাতে। কিন্তু তা আর পারল কিভাবে!

জুন মাসের প্রথম থেকেই ঢাকাতে শুরু হল ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের হামলা। যে গেরিলাদের হামলায় তটস্থ হয়ে জেনারেল নিয়াজী তাদের নাম দিয়েছিল ‘মুক্তি কা বিচ্ছু’। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে এই বিচ্ছুর দল কাকডাকা ভোরে, রৌদ্রোজ্জ্বল অপরাহ্ণে কিংবা মধ্যরাতে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন চালিয়ে যেত। ছোট ছোট অপারেশনের মাধ্যমে তারা তটস্থ করে রাখতো পাক বাহিনীদের। আর স্বাধীনচেতা ঢাকা অবরুদ্ধ বাঙ্গালীদের মনোবল তাতে হতো দৃঢ়।

এসবের মূলে ছিলেন একজন। ২ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের অন্যতম সহযোগী ক্যাপ্টেন এ.টি.এম হায়দার (পরবর্তীতে মেজর)। এ.টি.এম হায়দার নিজেই এই গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। গেরিলাদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন হায়দার ভাই নামে। তার হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই গেরিলারা যুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ ঢাকাতে বেশ কিছু অ্যাকশন করেছিল। এরমধ্যে এলিফেন্ট রোড, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, যাত্রাবাড়ি ব্রিজ, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন, স্টেট ব্যাংক এবং বনানীতে প্রাক্তন গভর্নর মোনেম খাঁর ওপর হামলা অন্যতম।

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে সেনাবাহিনীর যে বীর বাঙালি সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে সামগ্রিক প্রতিরোধ, মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে এ.টি.এম হায়দার অন্যতম। এ.টি.এম হায়দার এর জন্ম ১৯৪২ সালের ১২ জানুয়ারি কলকাতার ভবানীপুরে। তাঁর পুরো নাম আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দার। তাঁর গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের কান্দাইল গ্রামে। বাবা মোহাম্মদ ইসরাইল বৃটিশ ও পাকিস্তান পুলিশ বিভাগের ইন্সপেক্টর ছিলেন। মা হাকিমুন নেসা গৃহিনী। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে লে. কর্ণেল হায়দার ছিলেন দ্বিতীয়। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন পাবনা জেলার বীণাপাণি স্কুলে। পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন কিশোরগঞ্জ রামানন্দ হাইস্কুল থেকে। ১৯৬১ সালে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৬৩ সালে লাহোর ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন। পরে লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানে ভর্তি হন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স প্রথম পর্ব পড়াকালীন সেনাবাহিনীতে ভর্তির জন্য আবেদন করেন এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে কমিশনের জন্য মনোনীত হন। ১৯৬৫ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। এ.টি.এম হায়দার ট্রেনিং করেন পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী কাকুলেতে। কমিশন প্রাপ্তির পর গোলন্দাজ বাহিনীর অফিসার হিসাবে নিয়োজিত হোন। পরে তিনি চেরাটে S.S.G. (Special Service Group)ট্রেনিং-এ কৃতিত্বের সাথে উর্ত্তীর্ণ হন। উল্লেখ্য, চেরাটের এই ট্রেনিংটি ছিল মূলত গেরিলা ট্রেনিং। এখানে ৩৬০ জন অফিসারের মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র দুইজন। ১৯৬৯ সালে ট্রেনিং শেষ করার পর মুলতান ক্যান্টনমেন্টে তাঁর প্রথম পোস্টিং হয়। তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের ক্যাপ্টেন হিসেবে ১৯৬৯ সালের শেষে অথবা ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে তিনি কুমিল্লা সেনানিবাসে নিয়োগ পান।

অপারেশন সার্চলাইট এর পরে ২৬/২৭ শে মার্চ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের পনের দিনে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে যান এ.টি.এম হায়দার। তারপর তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থিত চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্যান্য অফিসারদের সাথে একত্রিত হন। সেখান থেকে তেলিয়াপাড়া, পরে ভারতের মতিনগর হয়ে আগরতলার মেলাঘরে যান। মেলাঘর ছিল ২নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার, এর কমান্ডার ছিলেন মেজর কে এম খালেদ মোশাররফ। ক্যাপ্টেন এ.টি.এম হায়দার এ সেক্টরের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে নিযুক্ত হন।

এ.টি.এম হায়দার এখানে প্রথমে একটি স্টুডেন্ট কোম্পানি গঠন করেন। তিনি নিজেই কোম্পানিকে গেরিলা ট্রেনিং প্রদান করতেন। এ.টি.এম হায়দারের করা উল্লেখযোগ্য অপারেশনগুলোর মধ্যে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে কিছু সৈন্য নিয়ে কিশোরগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ মহাসড়কের তারেরঘাট ব্রিজ, মুসুল্লি রেলওয়ে ব্রিজ ধ্বংস করে প্রতিরোধ ব্যবস্থা সুসংহত করা ও মে মাসের শেষ সপ্তাহে বিশেষ গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীতে অবস্থিত বড় ব্রিজটি ধ্বংস করা উল্লেখযোগ্য। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে কসবা যুদ্ধে মেজর খালেদ মোশাররফ গুরুতরভাবে আহত হলে ২ নং সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান এ.টি.এম হায়দার।

এ.টি.এম. হায়দারের ছোট বোন ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম ও ছোট ভাই এটিএম সফদার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ.টি.এম সফদার ভারতের মেলাঘরে অবস্থিত ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নেন এবং শালদানদী এলাকায় বিভিন্নযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আর ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম বিশ্রামগঞ্জে বাংলাদেশ হাসপাতালে কাজ করতেন। পাঁচশত বেডের এই হাসপাতালে তিনি একজন কমান্ডিং অফিসার হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন। হাসপাতালটি সম্পূর্ণভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা পরিচালিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম বীর প্রতীক উপাধি পান।

খালেদ মোশাররফ আহত অবস্থায় হাসপাতালে থাকায় ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ‘অজ্ঞাত কারণে’কে -ফোর্সকে দু’ভাগ করে যথাক্রমে চট্টগ্রাম ও চাঁদপুরে পাঠানো হয়। এ সত্ত্বেও ক্যাপ্টেন হায়দার তাঁর দলবল নিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে ডেমরা অতিক্রম করে কমলাপুর রেলস্টেশন ও মুগদাপাড়া দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে ১৬ ই ডিসেম্বর বেতার কেন্দ্র দখল করেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। যারা এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে তিনি ও এ কে খন্দকারই ছিলেন বাঙালি অফিসার।

স্বাধীনতার পর ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সকাল ৮টা ১০ মিনিটে মুক্ত বাংলাদেশে রেডিও প্রথম চালু হয়। মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ আলী চৌধুরী ঘোষণা করলেন যে, এখন জাতির উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন সেক্টর ২-এর কমান্ডার ইনচার্জ মেজর আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দার। সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে মেজর হায়দার তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শুরু করলেন।

এ.টি.এম হায়দার বললেন: “আমি মেজর হায়দার বলছি। প্রিয় দেশবাসী, আমাদের প্রিয় দেশকে মুক্ত করা হয়েছে। আমাদের দেশ এখন মুক্ত। আপনারা সবাই এখন মুক্ত বাংলাদেশের নাগরিক।” এ.টি.এম হায়দার স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত হন। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে মেজর থাকা অবস্থায় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ১৩ ইস্টবেঙ্গল প্রতিষ্ঠা করেন এ.টি.এম হায়দার। ১৯৭৪ সালে তিনি লে. কর্ণেল পদে উন্নীত হন এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অষ্টম বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মাঝে ৭ ই নভেম্বর তিনি নিহত হন। এই অভ্যুত্থান নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, বিতর্ক ও এ.টি.এম হায়দার এর প্রিয় সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের ভূমিকা নিয়েও অনেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, মত দ্বিমত থাকলেও অভ্যুত্থানে এ.টি.এম হায়দার এর কোন ভূমিকা ছিল না। এ.টি.এম হায়দার কোনকিছুতে অংশগ্রহণ না করেও তাকে এই চরম অবস্থার শিকার হতে হয়।

৭ নভেম্বর সকালে শেরেবাংলানগরে হত্যা করা হয় মেজর খালেদ মোশাররফ, কর্ণেল নাজমুল হুদা ও এ.টি.এম হায়দার কে। পাক হানাদাররা যাকে স্পর্শ করতে পারেনি, এমন একজন বীরকে তাঁর দেশেরই কতিপয় সেনার হাতে নিহত হতে হয়। ১১ নভেম্বর তাঁর লাশ শেরেবাংলা নগর থেকে তাঁর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। পিতা কর্তৃক স্থাপিত কিশোরগঞ্জ শোলাকিয়া মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com