পরোপকারী এক মানুষ ঝিনাইদহের মারুফ
প্রকাশের সময় : 2022-11-23 14:53:14 | প্রকাশক : Administration
এ পর্যন্ত সাপে কাটা ৩০০ মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন মারুফ। যদিও তিনি কোন ওঝা বা ডাক্তার নন। তারপরেও ঝিনাইদহ সদর, হরিণাকুন্ডসহ আশপাশের কয়েকটি উপজেলায় মারুফ এতটাই জনপ্রিয় যে কাউকে সাপে কাটলেই সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে ফোন আসে। গভীর রাত কিংবা প্রচন্ড চটচটে খরায় খবর পাওয়ামাত্র মোটরসাইকেলে ছুটে যান।
রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স বা অন্য কোনো যানবাহনে কাছের হাসপাতালে ছোটেন। নেহাত কিছু না পেলে নিজের মোটরসাইকেলে বসিয়েই রোগীদের হাসপাতালে নেন। বিষধর সাপে কাটা রোগীকে প্রথম ১০০ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা দেওয়া গেলে বাঁচানো যায়।
আবদুল্লাহ মারুফ (৪৫)। বাড়ি ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ড উপজেলার তাহেরহুদা ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের ছেলে তিনি। তার স্ত্রী স্কুল শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তার। এই দম্পতির রামিসা মালিয়াথ (১৪) ও আবদুল্লাহ আজয়াদ (১১) নামের দুটি সন্তান রয়েছে। স্বামীর এসব কাজে গর্বিত ইয়াসমিন আক্তার। তিনি বলেন, আমিও সব সময় তাকে সহযোগিতা করি।
জানা যায়, স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি বন্য প্রাণী ভালোবাসেন। কোথাও বন্য প্রাণী আটকা পড়েছে শুনলেই ছুটে গিয়ে মুক্ত করেন। বিষধর সাপ ধরার খবর পেলেও ছুটে যান। প্রাণীটিকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিতেন। সাপ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নানাভাবে প্রশিক্ষণও নেওয়া আছে তার। তিনি সাপের জাত, বিষ প্রয়োগ, অ্যান্টিভেনোমের বিষয়ে যথেষ্ট ধারণা রাখেন। তার কারণে হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছেন। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কাপড় দিয়ে আক্রান্ত স্থানটি বাঁধা, কোন হাসপাতালে গেলে দ্রুত সেবা পাওয়া যাবে, তা মুঠোফোনে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নেন। কোন হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম আছে এবং কোথায় চিকিৎসক প্রস্তুত আছেন, তারও খোঁজ নেন তিনি। সম্প্রতি হরিণাকুন্ড উপজেলার ধুলিয়া গ্রামের কৃষক মোজাম্মেল হককে (৪৬) সাপে কাটে। পরিবারের লোকজন তাকে নিয়ে যান এক ওঝার বাড়িতে। সেখানে ঝাড়ফুঁক করা হয়। কিন্তু রোগীর অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান মারুফ। রোগীর বাড়ি গিয়ে মারুফ শুরুতেই রোগীকে শান্ত থাকার পরামর্শ দেন। স্বজনদের বুঝিয়ে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যান। এরপর চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন মোজাম্মেল।
স্থানীয় তাহেরহুদা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনজুর রাশেদ বলেন, তার কারণে এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে সাপে কাটা বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। স্বজনদের বুঝিয়ে রোগীকে নিয়ে যান হাসপাতালে। বেঁচে যায় একটি প্রাণ। তিনি আরও বলেন, পাঁচ বছর ধরে নিরন্তর কাজটি করে চলেছেন এই যুবক। এর মধ্যে অর্ধেক রোগীকে গ্রাম্য ওঝার অপচিকিৎসা থেকে বাঁচিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ মারুফ বলেন, সাপে কাটার কারণে প্রতিবছর অনেক মানুষ মারা যায় দেশে। এর মূল কারণ গ্রামের মানুষের অজ্ঞতা। সাপে কাটা রোগীকে হাসপাতালে না নিয়ে সাধারণত ওঝার কাছে নিয়ে যায় গ্রামের লোক। সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে মারা যায় মানুষটি। ঝিনাইদহ জেলার ছয় উপজেলাসহ পাশের চুয়াডাঙ্গা সদর, আলমডাঙ্গা উপজেলা, কুষ্টিয়া সদর উপজেলা থেকেও মারুফের কাছে ফোন আসে। এসব এলাকার মধ্যে হরিণাকুণ্ডু ও শৈলকুপাতে সাপের উপদ্রব বেশি বলে আশপাশের কয়েকটি হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও জানিয়েছেন। গ্রামে বেশ কিছু ধানি জমি আছে মারুফের। রয়েছে মাছের খামার। এসবই দেখাশোনা করেন তিনি। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। এরপর সাংসারিক কারণে কর্মজীবনে ঢুকতে হয়। রোগীর কাছে ছোটাছুটিতে যে খরচ হয় সেটা তিনি নিজেই বহন করেন। তবে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরের খরচ রোগীর স্বজনেরা দেন। তিন শ রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার হিসাব সম্পর্কে জানতে চাইলে মারুফ বলেন, তার কাছে একটা হিসাব আছে।
আবদুল্লাহ মারুফ বলেন, বর্তমানে এই অঞ্চলে খৈয়া গোখরা ও পদ্ম গোখরা, কালাস, শঙ্খিনী ও চন্দ্রবুড়া সাপে কাটার ঘটনা বেশি। এগুলোর সবই বিষধর। তবে সব সময় সাপ মানুষকে কামড় দিয়ে বিষ প্রয়োগ করে না।
ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের চিকিৎসক রাজীব চক্রবর্তী জানান, আবদুল্লাহ মারুফ সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা বিষয়ক বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। তিনি মানুষ হিসেবেও বেশ পরোপকারী। মারুফের এই উদ্যোগের ফলে ঝিনাইদহ সদরসহ আশপাশের উপজেলার সাপে কাটা রোগীদের হাসপাতালে আসার পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়ে গেছে।
জেলা সিভিল সার্জন শুভ্রা রানী দেবনাথ জানান, ঝিনাইদহের সব কটি হাসপাতালে এই মুহূর্তে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম মজুত রয়েছে। রোগী এলেই চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। তিনি আরো জানান, আবদুল্লাহ মারুফ অবশ্যই সমাজে ভালো কাজ করছেন। তার কারণে সাপে কাটা রোগীদের হাসপাতালে আসা বেড়েছে। সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সিভিল সার্জন বলেন, সাপে কাটলে ওঝা নয়, খুব দ্রুত পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে যান। - সূত্র: অনলাইন