বাংলার ভেনিসঃ বরিশাল

প্রকাশের সময় : 2022-12-07 17:51:43 | প্রকাশক : Administration
বাংলার ভেনিসঃ বরিশাল

জেসিউর রহমান শামীম: ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল। বাংলার ভেনিস খ্যাত বরিশাল বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি প্রধান শহর। এটি একই সাথে জেলা ও বিভাগীয় সদর দপ্তর। কীর্তনখোলা নদীর তীরে মোগল আমলে স্থাপিত লবণচৌকি গিরদে বন্দরকে কেন্দ্র করে এ শহর গড়ে ওঠে। এটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নদীবন্দর।

বরিশালের নামকরণ সম্পর্কে জানা যায়, পূর্বে এখানে খুব বড় বড় শাল গাছ জন্মাতো; আর শাল গাছ থেকেই 'বরিশাল' নামের উৎপত্তি। 'আইতে শাল, যাইতে শাল / তার নাম বরিশাল' প্রবাদটি উল্লে−খ্য। আবার, কেউ কেউ দাবি করেন, পর্তুগীজ বেরি ও শেলির প্রেমকাহিনীর জন্য বরিশাল নামকরণ করা হয়েছে ইত্যাদি। গিরদে বন্দরে (গ্রেট বন্দর) ঢাকার নবাবদের বড় বড় লবণের চৌকি ছিল। লবণের বড় বড় চৌকি ও লবণের বড় বড় দানার জন্য ইংরেজ ও পর্তুগীজ বণিকরা এ অঞ্চলকে ‘বরিসল্ট' বলত। এ বরিসল্ট পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল হয়েছে।

বরিশাল জেলা পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার সম্মিলিত জলরাশি বাহিত পলিমাটি দ্বারা গঠিত ব-দ্বীপের নিম্নভাগে অবস্থিত। বরিশাল জেলার উত্তরে চাঁদপুর, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলা; দক্ষিণে ঝালকাঠি, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলা; পূর্বে লক্ষ্মীপুর জেলা ও মেঘনা নদী এবং পশ্চিমে পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও গোপালগঞ্জ জেলা অবস্থিত।

বরিশালের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। এখানকার কুলিন সমাজ বাকলা সমাজ নামে খ্যাতছিল। ৭ম শতকে এখানে সামন্ত প্রথা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তালুকদার জমিদারগণ সমাজে প্রথম শ্রেণী হিসেবে বিবেচিত হতেন। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাঁওতাল, গারো, মগ ও চাকমাদের মতো বরিশালে ‘চন্দ্রভদ্র' নামে এক জাতি ছিল।

বাংলার শস্য ভান্ডার বরিশাল একদা ‘এগ্রিকালচারাল ম্যানচেস্টার' হিসেবে পরিচিত ছিল। বরিশালের অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল বাংলার অর্থনীতি। বরিশাল অঞ্চলের জনগণ সত্যিকার অর্থে আরামপ্রিয় ও ভোজনবিলাসী। পারিবারিকভাবে এরা খুবই ঘনিষ্ঠ ও আন্তরিক। তেলে-ঝালে রকমারী সুস্বাদু খাবারের পরে একটা মিষ্টান্ন ছাড়া তাদের তৃপ্তি আসেনা। কবি ঈশ্বরগুপ্ত বরিশালে বেড়াতে এসে লিখেছেন ‘এখানে খাদ্য সুখের কথা বর্ণনা করা যায় না। এখানকার মতো উত্তম চাউল বোধ করি বঙ্গদেশে আর কোথাও নাই।'

বরিশাল জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো ঐতিহ্যগত ভাবে খুবি সমৃদ্ধ। প্রায় আড়াইশ বছর পুরনো ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর দিঘী স্বরূপকাঠি বরিশাল সড়কে মাধবপাশায় অবস্থিত। ১৭৮০ খৃষ্টাব্দে তৎকালীন রাজা শিব নারায়ণ এলাকাবাসীর পানির সংকট নিরসনের জন্য মাধবপাশায় একটি বৃহৎ দীঘি খনন করে তাঁর মা দুর্গা দেবীর নামানুসারে দিঘীটির দুর্গাসাগর নামকরণ করেন। দিঘীর তিন দিকে ৩টি ঘাটলা এবং দিঘীর মাঝখানে একটি টিলা বা ছোট দ্বীপ রয়েছে। শীতকালে দুর্গাসাগরে বুকে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির আগমন ঘটে।

এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম জামে মসজিদ গুটিয়া, যা বরিশাল জেলার উজিরপুর থানায় অবস্থিত। গুটিয়া মসজিদ নামে পরিচিতি পেলেও এর নাম বাইতুল আমান। ২০০৩ সালে এস. সরফুদ্দিন আহম্মেদ সান্টু গুঠিয়া বাইতুল আমান জামে মসজিদ এবং ঈদগাহ্ কমপ্লেক্সের নির্মাণ শুরু করেন যা ২০০৬ সালে শেষ হয়। গুটিয়া মসজিদ কমপ্লে−ক্সের ভেতরে রয়েছে একটি মসজিদ, সুদৃশ্য মিনার, ২০ হাজার লোকের ধারণক্ষমতার ঈদগাহ্ ময়দান, একটি ডাকবাংলো, এতিমখানা, গাড়ি পার্কিং, পুকুর এবং ফুলের বাগান। মসজিদটিতে এক সঙ্গে প্রায় ১৫০০ মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পারে এবং মসজিদটির মিনারের উচ্চতা প্রায় ১৯৩ ফুট। এই মসজিদটিতে মহিলাদের পৃথক নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

বরিশাল শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এক ঐতিহ্যবাহী জলাশয়ের নাম বিবির পুকুর। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে জিন্নাত বিবি জনমানুষের জলের কষ্ট নিরসনের উদ্দেশ্যে এই পুকুর খনন করেন। পরবর্তীতে জিন্নাত বিবির নামানুসারে শতবর্ষী পুকুরটি বিবির পুকুর নামে পরিচিত হয়ে উঠে। তৎকালীন সময় কীর্তনখোলা নদীর সাথে খালের মাধ্যমে বিবির পুকুরের দুইটি সংযোগ ছিল। ফলে নদীর মতই এই পুকুরে নিয়মিতভাবে জোয়ার ভাটা দেখা যেত।

অক্সফোর্ড মিশন চার্চ বরিশাল জেলার বগুড়াগামী রোডে অবস্থিত। শৈল্পিক এ গির্জা স্থাপত্যের নিদর্শন হিসাবে এশিয়ার ২য় বৃহত্তম চার্চ হিসাবে ধরা হয়। এ গির্জার নাম ইপিফানি গির্জা হলেও এটি অক্সফোর্ড মিশন নামেই পরিচিতি লাভ করে। সিস্টার এডিথের নকশায় ১৯০৩ সালে গির্জাটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ফাদার স্ট্রং এর নির্দেশনায় ১৯০৭ সালে কাজ শেষ হয়। অক্সফোর্ড মিশন চার্চটি দেখতে একতলা হলেও উচ্চতায় এটি ৫ তলা ভবনের সমান।

বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার চাখার ইউনিয়নে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের বসতভিটার জায়গা জুড়ে শেরে বাংলা স্মৃতি জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক পিতার মৃত্যুর পর ১৯০১ সালে বরিশাল আগমন করেন। আইন ব্যবসার পাশাপাশি তিনি চাখারের জমিদারিত্বের দেখাশুনা করতেন। ১৯৮৩ সালে সংস্কৃতি বিষয়ক অধিদপ্তরের অধীনে তার ইতিহাস ও স্মৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এই জাদুঘর নির্মাণ করা হয়।

শেরে বাংলা স্মৃতি জাদুঘরে তিনটি প্রদর্শনী কক্ষ, একটি অফিস কক্ষ, একটি বিশ্রামাগার ও একটি গ্রন্থাগার রয়েছে। জাদুঘরের বাম দিকে শেরে বাংলার একটি বিশাল প্রতিকৃতি এবং তার পাশে জীবনকর্মের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, সামাজিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক ছবি এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত শেরে বাংলা ফজলুল হকের বিভিন্ন ফিচার ও ছবি রাখা আছে। আরও আছে বিরল আলোকচিত্র, ব্যবহৃত আসবাপত্র, চিঠিপত্র, সুন্দরবনের শিকার করা কুমিরের মমি, স্বর্ণমুদ্রা, রৌপ্য মুদ্রা, শ্রীলংকা, ব্রিটিশ ও সুলতানি আমলের তাম্র মুদ্রা এবং বিভিন্ন প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন।

কড়াপুর মিয়াবাড়ি জামে মসজিদ বরিশাল জেলার সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৮০০ শতকে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। মূল মসজিদটি উঁচু একটি আয়াতকার বেসমেন্টের উপর নির্মাণ করা হয়েছে। আর নীচের বেসমেন্টের কক্ষগুলো বর্তমানে মাদ্রাসার ছাত্রদের বসবাসের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। মিয়াবাড়ি মসজিদে প্রবেশের জন্য দোতলা থেকে একটি প্রশস্ত সিঁড়ি মাটিতে নেমে এসেছে। আর মসজিদের ছাদে শোভা পাচ্ছে পাশাপাশি অবস্থানে নির্মিত তিনটি সুদৃশ্য গম্বুজ। এছাড়াও মসজিদের সামনে এবং পেছনের দেয়ালে চারটি করে মোট আটটি মিনার রয়েছে।

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com