সিলেবাসের বাইরের শিক্ষক
প্রকাশের সময় : 2023-01-03 09:56:36 | প্রকাশক : Administration
বিপুল সরকার সানি: বয়স ৫৬ বছর। বাল্যবিয়ে ঠেকাতে তাঁর যেন দম ফেলার ফুরসত নেই। সকাল ১০টা থেকে বিদ্যালয়ের ক্লাস ও কার্যক্রম শুরু, ছুটি বিকেল ৪টায়। এরপর প্রথমে যান যেসব শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল, তাদের বাড়িতে। খোঁজ নেন কোন শিক্ষার্থীর কী সমস্যা, খাতা-কলমের অর্থ সংকট আছে নাকি। থাকলে সাধ্যমতো সহযোগিতা করা। বাল্যবিয়ের শিকার হতে যাওয়া ছাত্রীদের ফিরিয়ে এনেছেন শ্রেণিকক্ষে। বলছি দিনাজপুর ঈদগাহ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফজলুর রহমানের কথা।
২০০৬ সালের শেষের দিকে বিদ্যালয়ে যোগদানের দিনে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ৪৬ শিক্ষার্থী। শহরের মধ্যে একটি বিদ্যালয়, কিন্তু শিক্ষার্থী এত কম কেন? প্রশ্ন জাগতেই বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকদের নিয়ে আলোচনায় বসেন। জানতে পারেন, আশপাশের এলাকার লোকজন যেমন নিম্নবিত্ত, তেমনি সচেতনতার অভাব। এর পর থেকেই তিনি কাজ শুরু করলেন বিদ্যালয় নিয়ে। আশপাশের এলাকাগুলোতে দেখলেন, অনেক মেয়েই রয়েছে, যারা বিদ্যালয়মুখী নয়; অন্য বিদ্যালয়েও পড়াশোনা করে না। এরপর শুরু করলেন অভিভাবকদের বোঝানোর কাজ। প্রতিদিনই বিদ্যালয়ের ছুটির পর বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন আশপাশের এলাকাগুলোতে। মেয়েদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিতে হাতে-পায়ে ধরেন অভিভাবকদের। তিনি বোঝালেন, মেয়েরা বিদ্যালয়মুখী না হলে যে তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে না।
একসময় অভিভাবকরা বুঝতে শুরু করলেন, তাঁর কথায় সায় দিয়ে মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে শুরু করলেন। প্রথমদিকে অনেক ছাত্রীকেই ভর্তির পর তাদের পড়ালেখার খাতা-কলম, নোটবইসহ বিভিন্ন উপকরণ কিনে দিতে শুরু করেন।
২০০৮ সালের ঘটনা। ফজলুর রহমান জানতে পারেন, তাঁর বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিপড়ূয়া দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এরপর একদিন খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, বিয়ে হয়ে যাওয়া ওই দুই শিক্ষার্থীর মধ্যে একজনের স্বামী মারা গেছে, আর একজনের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। বিষয়টি গভীরভাবে তাঁর মনকে আঘাত করে। এরপর নিজে নিজে প্রতিজ্ঞা নেন, তিনি আর কোনো ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হতে দেবেন না; বরং মেয়েদের সম্পদে পরিণত করতে কাজ করবেন।
যেই ভাবা, সেই কাজ। ২০১০ সাল থেকেই শুরু করেন বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে লড়াই। দিন নেই, রাত নেই; যেখানেই খবর পেয়েছেন বাল্যবিয়ের, সেখানেই ছুটে গেছেন। অভিভাবকদের বুঝিয়ে বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছেন, আবারও বিদ্যালয়মুখী করেছেন ছাত্রীকে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত শতাধিক বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছেন তিনি।
২০১৪ সালের ঘটনা। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় আশামণি নামের এক মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন মা-বাবা। রাতের বেলায় সেই সংবাদ পেয়ে বিয়ে ভেঙে দেন এবং পড়ালেখার সব দায়িত্ব গ্রহণ করেন শিক্ষক ফজলুর রহমান। ওই শিক্ষার্থী এখন আহ্ছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালে রেডিওলজিস্ট পদে চাকরি করেন। তাঁর চাকরির অর্থ দিয়ে সংসার পরিচালনা হচ্ছে।
জুলেখার বাবা মারা গেছেন। ২০১৭ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর বিয়ে ঠিক করে পরিবার। সেই বিয়ে ঠেকান ফজলুর রহমান। এরপর তাকে ভর্তি করে দেন দিনাজপুর উপশহর টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটে। টেক্সটাইল ডিপ্লোমা সম্পন্ন করার পর বর্তমানে জুলেখা ঢাকায় চাকরি করেন।
নূর ইসলাম বেলাল নামে একজন ফুটবলার তাঁর বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে মেয়েদের ফুটবল টিম গঠন করার প্রস্তাব দেন। পরে তাঁর কথায় উৎসাহিত হয়ে ফজলুর রহমান এই বিদ্যালয়ের ২৪ শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে মেয়েদের ফুটবল টিম গঠন করেছেন। একাধিকবার এই টিমের খেলোয়াড়রা বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। নিজ উদ্যোগে ২০১৫ সালে এই টিম গঠন করেন। এই টিমের মেয়েদের ফুটবল থেকে শুরু করে বুট-মোজাসহ যাবতীয় সামগ্রী ক্রয় করে দেন তিনি। শুধু তাই নয়, এসব সদস্যকে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি। মেয়েদের ফুটবল টিম গঠন করার পর দ্রুত বিদ্যালয়ের নাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। তারা ২০১৬ সাল থেকেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। এখানকার শিক্ষার্থীরা জেলা-উপজেলাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন।
মেয়েদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ফজলুর রহমান বিদ্যালয়েই গড়ে তুলেছেন ছোট একটি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র। এই কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা দেন একজন চিকিৎসক। সামান্য কিছু ঔষধও দেওয়া হয়। ছুটির দিনগুলোতে কিংবা অবসরে শিক্ষক ফজলুর রহমান মেয়েদের নিয়ে যান গোড়-এ শহীদ ময়দানে। নিজেই খেলাধুলায় নেমে পড়েন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে।
আহ্ছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালে চাকরি করা আশামণি বলেন, 'স্যার না হলে আজ এতদূর আসতে পারতাম না। হয়তো সংসার করতাম। আজ আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি। আমার মা-বাবা ও স্বজনরা আমাকে নিয়ে গর্ব করেন। এর চেয়ে জীবনে বেশি কী প্রয়োজন হয়।'
ফুটবল খেলোয়াড় আইরিন পারভীন বলেন, 'আমাকে এখন শুধু জেলার মানুষরাই নন, সারাদেশের মানুষই জানেন। আমার স্বপ্ন, আমি একদিন জাতীয় দলের হয়ে খেলব। দেশের জন্য কিছু করব। আজ আমি এই যে স্বপ্ন দেখছি, তা আমাদের স্যারের জন্যই। স্যার না হলে আজ আমি খেলোয়াড় হতাম না।'
শিক্ষক ফজলুর রহমান বলেন, 'আমি যেসব কাজ করছি, তা আমার দায়িত্ব। একদিন এমন সময় আসবে, যখন দেশে কোনো বাল্যবিয়ে থাকবে না। মেয়েরা বর্তমানে এগিয়ে যাচ্ছে; আর তাদের আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব শিক্ষকদের মধ্যে পড়ে। আমি যে একজন শিক্ষক আর আমার এই সমাজকে কিছু দেওয়ার দায়বদ্ধতা আছে, সেখান থেকেই আমার পথচলা।' - সুত্র: দৈনিক সমকাল