একটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি
প্রকাশের সময় : 2023-01-03 09:58:38 | প্রকাশক : Administration
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি মানে, দুঃসহ বেদনার স্মৃতি, ধ্বংসের বিভীষিকা, ধর্ষণ ও গণহত্যার স্মৃতি। সিলেটে কানাইঘাট উপজেলায় চারিপাড়া গ্রামের একটি ঘটনা, একটি রোমহর্ষক খুনের স্মৃতি। এ গ্রামের অধিবাসী মাওলানা ফায়জুল হক একজন সহজ সরল মানুষ। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক। স্থানীয় এক মাদ্রাসায় কর্মরত আছেন। পাঁচবোনের মধ্যে একমাত্র ভাই। তাই খুব আদরের ছিলেন। তবে তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বৃদ্ধা মায়ের সেবার জন্য তিনি যুদ্ধে যাননি। দেশকে রক্ষা করার জন্য তাঁর তীব্র বাসনা সারাক্ষণ তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কাউকে কিছু বলেননা। দেশের জন্য কিছু করার নীরব ইচ্ছা হৃদয়ে লালন করছেন। তাঁর মতো অনেক মাওলানা পাকসেনাদের দোসর হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীশক্তি হিসেবে কাজ করছেন। আর তিনি স্বাধীনতাকামী এক নীরব দেশপ্রেমিক।
চাল-চলনে এমনটিই ছিলেন যে, কেউ তাকে সন্দেহ করেনি। বরং রাজাকার ও পাকসেনারা তাকে নিজেদের পক্ষের একজন মনে করত।
তখন ছিল শীতকাল। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। একরাতে এলাকার একদল মুক্তিযোদ্ধা অপারেশন শেষে গভীর রাতে এ মাওলানার বাড়ি আসেন। তাঁর স্ত্রী মুরগির খোপ থেকে মুরগি ধরে রান্না করে খাওয়ালেন। মুক্তিসেনারা তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে গভীর রাতেই তারা এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। স্থানীয় চরেরা পাকিস্তানীদের পা-চাটা জানোয়ার। হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে মুক্তিসেনাদেরকে আপ্যায়নের খবরটি পৌঁছে দিল। কেউ টের পেলনা। মাওলানা ফয়জুল হকও এ নিয়ে আর ভাবছেন না। কিন্তু কে জানতো যে তাঁর জন্য বিভীষিকাময় পরিণতি অপেক্ষা করছে।
দুদিন পরেই নিকটবর্তী মণিপুরটিলায় পাকসেনাদের ক্যাম্পে ডাক পড়ে মাওলানা ফয়জুল হকের। বৃদ্ধা শয্যাশায়ী মা বলেন, বাবা, ওদের কাছে যেও না। তুমি বরং কোথাও পালিয়ে যাও। মাওলানা ফয়জুল হক মায়ের কথা শোনেননি। তিনি বলেন, আমিতো অন্যায় কিছু করিনি, মা। যারা দেশের জন্য যুদ্ধ করছে তাদেরকে খাবার দিয়েছি, এটা কী অপরাধ? মায়ের মমতার বাঁধন মাতৃভূমির টানে ছিঁড়ে গেল। মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও তিনি মনে সাহস নিয়ে ওদের ক্যাম্পে গেলেন। সেখানে দেশীয় দোসর মীর জাফরের উত্তরসুরী রাজাকারও ছিল, ওরা দেখলো শিকার হাতে ধরা দিয়েছে। কোন কথাবার্তা বিনিময় না-করেই আচ্ছাকরে পিটালো। এমন নির্দয়ভাবে পেটানো হলো যে তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন। রাইফেলের বাঁট ও পিটানোর জন্য রাখা বিশেষ লাঠির আঘাতে দেহ থেকে রক্ত ঝরছে। তার আর্তনাদে আকাশ-বাতাস কেঁদেছিল কিন্তু ওদের হৃদয় গলেনি।
কিছুক্ষণ পর মাওলানা সাহেবের জ্ঞান ফিরলে তিনি খুব কাতর কন্ঠে পানি চাইলেন। অদৃষ্টের পরিহাসে জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে তৃষ্ণার্ত একজনের পানির প্রয়োজন কতটুকু তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানে। কোন মানুষ কী এ মুহুর্তে পানি না দিয়ে থাকতে পারে? কিন্তু কী নির্মম আচরণ! ওরা তাকে একফোঁটা পানিও দেয়নি। পানির বদলে মুখে রাইফেলের নল ঢুকিয়ে খোঁচানো হলো। তিনি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। এতক্ষণ নির্যাতন করছিল সাধারণ সৈনিকরা। এবার তাদের প্রধান এসে বলেন, একে হাত-পা বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে দাও। তাই করা হলো। এবার যা করা হলো তা মধ্যযুগের নিষ্ঠুরতাকেও হার মানায়। ব্লেড দিয়ে শরীরে পোঁচ দিয়ে দিয়ে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেওয়া হলো লবন ও মরিচের গুঁড়ো। যন্ত্রণায় মাওলানা ছটফট করছে আর ওরা পাকিস্তানের ভাষায় গালিগালাজ করছে। বলছে, স্বাধীনতার মজা কেমন এবার দ্যাখ! তারপর আরেকদফা পেটানো হলো। এভাবে নির্মম নির্যাতনের মাঝে এ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে তিনি না-ফেরার দেশে চলে গেলেন। ঘরে রেখে আসা অসহায় অসুস্থ মা পুত্র হারানোর এ ব্যথা কতদিন সয়েছিলেন তা আর কারো জানা হলো না।
এমনি হাজারো স্মৃতির আলোয় মহান স্বাধীনতার ইতিহাস চির অম্লান। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্বও কর্তব্য। - লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: আখতার হোসেন মন্ডল; উৎস: সহকর্মী সালাহ উদ্দিন তারেক