সুবীর নন্দী: এক উজ্জল নক্ষত্র
প্রকাশের সময় : 2023-01-04 16:52:16 | প্রকাশক : Administration
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বন্ধুর গিটারের সুরের সাথে গলা মেলাতে কার না ভালো লাগে? বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে তো এরকম দলের দেখা মেলে হরহামেশাই। গান গাইতে দেখলে অজান্তে ঠোঁটে খেলা করে একরাশ হাসি, তাই না? বলিউড কিংবা হলিউড কোনোটাই ততোটা মানানসই লাগে না যতটা লাগে বাংলা গানে। কেমন যেন একটা টান অনুভূত হয়।
গত কয়েক বছরে এরকম খবর কানে এসেছে অসংখ্য। একের পর এক নক্ষত্রের পতন। বাংলা গানের জন্যে তো অবশ্যই একটা বড় রকমের বিপর্যয়। বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি এরকমই একজন কিংবদন্তীকে হারিয়েছে গত বছর। যার গলার সুর ছিল মনকাড়া, যার গান শুনলে শ্রোতারা আজও গানের ভিতরে হারিয়ে যায়, যার গান শুনলে আজও চোখের কোণে পানি জমে। ইনিই সেই সুবীর নন্দী। যার উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত সেই মুখখানার দেখা মিলবে না আর। তার গানগুলোও হয়ে থাকবে রেকর্ডে আবদ্ধ।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা: হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা বাগানের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘর আলো করে ১৯৫৩ সালের ৩০ নভেম্বরে জন্ম হয় আধুনিক বাংলা গানের জগতের এক নক্ষত্রের, নাম রাখা হয় সুবীর নন্দী। বাবা সুধাংশু ভূষণ নন্দী ও মা পুতুল রানী নন্দীর নয়টি সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। বাবা ছিলেন চা বাগানের ডাক্তার আর মা গৃহিণী। বাবা-মা দুজনেই বেশ গান ভালোবাসতেন। সেই সুবাদে গানের প্রতি তার ঝোঁক ছোটবেলা থেকেই। বাবা পূর্বে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের ক্যাপ্টেন ছিলেন। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার দিনে বাক্স ভর্তি অনেকগুলো গানের রেকর্ড কিনে এনেছিলেন। আর সেই রেকর্ডের গান শুনতে শুনতে বড় হন ছোট্ট সুবীর নন্দী। মা পুতুল রানী নন্দীও সন্তানদের গানের প্রতি আগ্রহ দেখে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাড়িতে গানের আসর বসাতেন। তখন থেকেই গান শেখার হাতেখড়ি এই তারকার।
পড়াশোনা ও সঙ্গীত জগতে আসা: প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেন তেলিয়াপাড়ায়। তারপর পুরো পরিবারসহ চলে আসেন হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার নন্দীপাড়া গ্রামে। সেখানেই ভর্তি হন পুরাতন হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং সেখান থেকেই ১৯৬৯ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন। তারপর ভর্তি হন বৃন্দাবন কলেজে। কলেজে পড়াকালীন মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগের মুহূর্তে হবিগঞ্জে দেখা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ আরো কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে।
সুবীর নন্দীর গানের প্রতি আগ্রহ তীব্রতর হয় যখন দেখেন তার বড় ভাই এবং বোন গান শিখতে শুরু করেছেন। তিনিও বেশ তোরজোড় করে গান শিখতে শুরু করেন। গানের শিক্ষক ছিলেন ওস্তাদ বাবর আলী খান। ওস্তাদ ছাড়াও তিনি তার মেসো গঙ্গেশ দেব রায়ের কাছ থেকেও মাঝে মাঝে তালিম নিতেন। অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও একাগ্রতার জন্য এক বছরের মধ্যেই ক্লাসিকাল গানের অনেক কিছু শিখে ফেলেছিলেন তিনি। আর প্রতিদিন রেওয়াজ করে নিজেকে ঝালিয়ে নেওয়া ছিল তার অভ্যাস। যার কারণে কঠিন কাজকে আয়ত্ত করে নিতে পেরেছেন সহজেই।
গানের যাত্রারম্ভ: সুবীর নন্দীর আনুষ্ঠানিক ভাবে গানের যাত্রা শুরু হয় রেডিও পাকিস্তানের মাধ্যমে। ১৯৬৭ সালে এক প্রতিযোগিতায় তার সাথে দেখা হয় মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান ও মোহাম্মদ মোজাক্কের নামক দুই রেডিও পাকিস্তান কর্মকর্তার। অডিশনে তিনি নজরুলের ‘বৌ কথা কও’গান গেয়ে বিচারকের মন জয় করে ফেলেন। তারপর থেকে তিনি প্রতি মাসে দু’বার করে সিলেটে রেডিও পাকিস্তানের স্টেশনে যাওয়া শুরু করেন গান রেকর্ডের জন্য। মাত্র তের বছর বয়স তখন তার, একা একাই ট্রেনে করে হবিগঞ্জ থেকে সিলেট যাওয়া আসা করতেন। তখন প্রতিটি প্রোগ্রামের জন্য পেতেন মাত্র ৩৫৯ টাকা।
১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান সঙ্গীত প্রতিযোগীতায় ভাই তপন কুমার নন্দীর সাথে তিনিও যোগ দেন। আর নজরুল সঙ্গীত ও সমসাময়িক গানের সেগমেন্টে ২য় স্থান অর্জন করেন।
তারপর তিনি সমবয়সীদের সঙ্গে নিয়ে যোগ দেন মফস্বলের রাজনৈতিক সংঘে। মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পূর্বে রচনা করেন ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’ও ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা’নামক দুটি দেশাত্মবোধক গান। তিনি জানতেন গানের মাধ্যমে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথ আরো সুগম করা সম্ভবপর আর সেই অনুযায়ী তিনি কাজও করেছেন। অতঃপর যুদ্ধ আরম্ভকালে পরিবারের নির্দেশে চলে যান ভারতে।
লোকসঙ্গীত জগতে অনুপ্রবেশ: যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশে আসার প্রস্তুতি নেয়ার সময়ে মারা যান তার বাবা সুধাংশু ভূষণ নন্দী। আর তখন থেকেই কষ্টের দিনাতিপাত শুরু। পরিবারের ভার এসে পড়ে তার ছোড়দার উপর। তখন পাশে এসে দাঁড়ান মেসো ও বোনের জামাই। পরিবারের অভাব দূর করতে তারপর ছোড়দা শ্রীমঙ্গল কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন আর তিনি চাকরি নেন সিলেটের জনতা ব্যাংকে। সেখানেই দেখা হয় জমিদার বিদিত লাল দাসের সাথে। সুবীরের প্রতিভার কথা জেনে আহবান জানান নিজ লোকসঙ্গীত দলে। তখন দলটিতে ছিলেন বিদিত লাল দাস ছাড়াও আকরামুল ইসলাম, জামালুদ্দীন বান্না, রাখাল চৌধুরী, হিমাংশু বিশ্বাস ও আরো কিছু বিখ্যাত শিল্পী। তাদের রচিত বিখ্যাত ‘সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী’গানটি শেষ না হতেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গানটি তখন এতই বিখ্যাত হয়েছিল যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদেরকে নিজ বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে তখন সুবীর নন্দীও ছিলেন সেই দলের সদস্য।
আধুনিক গানে পদার্পণ: তিনি ছিলেন সাধারণত নজরুল সঙ্গীতের গায়ক। তিনি যখন ১৯৭৪ সালে ঢাকা আসেন এবং ভিন্নরকম অনুষ্ঠান করতে শুরু করেন তখন তাকে বেশ কিছু বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কয়েকজন বলেন ‘আপনি নিঃসন্দেহে ভালো গান করেন কিন্তু গানে কি যেন একটা নেই।‘
তারপর থেকেই হতাশায় ভুগতে থাকেন তিনি। এরপর বন্ধু মোজাক্কেরের কাছে গেলে তিনি তাকে সুরের ধরন বিবেচনা করে আধুনিক গান করার পরামর্শ দেন। তারপরেই তার রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্রের যাত্রার শুরু।
সঙ্গীতাঙ্গন ও চলচ্চিত্র জগতের শুরু: মুক্তিযুদ্ধের পর সুবীর নন্দীর রেডিও পাকিস্তানের সব কলিগ বাংলাদেশ বেতারে যোগ দেয়। তাদের সাথে দেখা করতে প্রায়ই ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়া আসা করতেন। আর বেতনের বেশিরভাগ অর্থ ব্যয় হয়ে যেতো যাতায়াতের ভাড়ায়। তিনি এতোটাই বন্ধুসুলভ মানুষ ছিলেন যে টাকার মায়া করতেন না। তাকে প্রায়ই আসতে দেখে একদিন সঙ্গীত পরিচালক মীর কাশেম তার ব্যাপারে জানতে চান মোজাক্কেরের কাছে। ঠাট্টাচ্ছলে সেদিন মোজাক্কের মীর কাশেমকে বলেছিল-
‘এ তো সিলেটের এক প্রখ্যাত শিল্পী।’
তখন তার গুণ যাচাই করার জন্য তিনি ‘যদি কেউ ধূপ জ্বেলে যায় ‘গানটি রেকর্ডের প্রস্তাব দেন। সুবীর নন্দীও এক কথায় রাজি হয়ে যান। তারপর এক ঘন্টার মধ্যে গান রেকর্ড করে মীর কাশেমকে প্রায় তাক লাগিয়ে দেন। ব্যস! এরপর মীর কাশেম চূড়ান্ত রেকর্ডিংয়ের জন্য পরিচয় করিয়ে দেন সুরকার সুজয় শ্যামের সাথে। পরবর্তী সময়ে রেকর্ডটি খুব দ্রুত ব্রডকাস্ট হয় আর তিনি সুনাম অর্জন করতে শুরু করেন।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)-এর সঙ্গীতানুষ্ঠান ‘মালঞ্চ’-তে আনোয়ারুল আবেদীনের লেখা ও ওমর ফারুকের সুর করা ‘জোয়ারের টানে ভেসে এলে’গানের মধ্য দিয়ে তিনি প্রথম টিভিতে গান পরিবেশন করেন।
১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে ‘সূর্যগ্রহণ’ছবির ‘দোষী হইলাম আমি’গানের মাধ্যমে প্রথম প্লেব্যাক গান প্রকাশ করেন।
স্মরণীয় ঘটনা: মান্না দে’র ভক্ত ছিলেন সুবীর নন্দী। প্রায় সব অনুষ্ঠানেই মান্না দে’র একটি হলেও গান গাইতেন। তিনি বিখ্যাত তবলা বাদক আল্লা রাখা, মেহেদী হাসান ও বাহাদুর খানের সামনেও পারফর্ম করেছেন। একদিন সুবীর যখন গান গাইছিলেন আল্লা রাখা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। গান শেষ হওয়ার পর তাকে ৫০ ডলারের নোটের ওপর অটোগ্রাফ দিয়ে আশীর্বাদ করেন। সেই নোটটি তিনি নিজের কাছে সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন।
এক ফ্রেমে যত অর্জন: ১৯৭৪ সালে ‘মহানায়ক’চলচ্চিত্রে কাজ করার সুবাদে সুবীর নন্দী শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন। তারপর শুভদা (১৯৮৬), শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯), মেঘের পরে মেঘ (২০০৪), মহুয়া সুন্দরী (২০১৫)-এর জন্য মোট ৫ বার চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
এছাড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।
২০০৪ সালে লন্ডনের হাউস অফ কমন্স এ সব সাংসদের উপস্থিতিতে গান গাওয়ার সুযোগ পান।
২০১২ সালে সিটি ব্যাংক কর্তৃক গানে গানে গুঞ্জন সংবর্ধনা পুরস্কার পান।
২০১৮ সালে চ্যানেল আই কর্তৃক আজীবন সম্মাননা পুরস্কার পান।
২০১৯ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হন।
অসুস্থতা ও মৃত্যু: মৌলভীবাজারে এক আত্নীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে। সেখান থেকে ফেরার পথে ট্রেনে অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসকের পরামর্শে ঢাকার সিএমএইচে ভর্তি করা হয় সুবীর নন্দীকে। শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। ১৮ দিন পর ৩০ মার্চ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও হার্ট অ্যাটাক ও মাল্টিপল অরগ্যান ফেলিউর হওয়ায় শেষ রক্ষা হয়নি। ৭ই মে ভোর ৪টা ৩০ মিনিটে সবাইকে ছেড়ে চলে যান এই কিংবদন্তী।
মৃত্যুর আগে তার একমাত্র কন্যা ফাল্গুনী নন্দীকে বলেন তার জন্য যেন সবাই ফুল আনে। ফুল খুব ভালোবাসতেন তিনি। - সূত্র: অনলাইন