সুন্দর বিশ্বকাপের অসুন্দর অধ্যায়

প্রকাশের সময় : 2023-01-04 16:54:15 | প্রকাশক : Administration
সুন্দর বিশ্বকাপের অসুন্দর অধ্যায়

সরদার মোঃ শাহীন

 

শেষ হয়ে গেল বছর। কম তো নয়! বারোটি মাস! গুনে গুনে বারোটি মাসকে নিয়ে পুরো একটি বছর। এবং সেই সাথে শেষ হলো দুনিয়া কাঁপানো উম্মাদনা ছড়ানো বিশ্বকাপ ফুটবল। আর সঙ্গে ভাঙলো ফুটবলের আনন্দঘন মিলন মেলা। সারা পৃথিবীর সব আনন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে আনন্দের বন্যায় ভাসালো আর্জেন্টিনাকে। ভাসালো মেসিকে। বিশ্ব ফুটবলের নতুন সম্রাট জীবন্ত কিংবদন্তী লিওনেল মেসি।

বিশ্ব এখন মেসি জ্বরে ভাসছে। চারদিকে শুধু মেসি আর মেসির জয়গান। মেসির গল্প আর ছবিতে মিডিয়া একাকার। বলা যায় মেসির জনপ্রিয়তা আর্জেন্টিনাকেও ছাপিয়ে গেছে। আর্জেন্টিনার চেয়েও জনপ্রিয় শব্দ এখন মেসি। যদি বলি এত উত্তাপ আর উম্মাদনা ছড়িয়ে এ বছরের বিশ্বকাপ রেখে গেল কী? জয় পরাজয়ের টুকিটাকি গল্প আর জুয়াড়ীদের দু’নম্বরী হিসেব নিকেষ! শুধু কি এইটুকুই? নাকি আরো কিছু?

বলার মত বিশ্বকাপের আরো গল্প আছে। সে সব গল্প কি এবারের আসরের শুরু দিয়ে শুরু, নাকি আসরের আয়োজক দেশ হিসেবে কাতার নির্বাচিত হবার দিন থেকে শুরু? বিশ্বকাপের ঢামাডোলে হয়ত আমরা সে সব ভুলেই গেছি। কিংবা চাইলেও মনে করতে পারছি না। যেদিন বিশ্বকাপের জন্যে কাতার নির্বাচিত হয়, সেদিন থেকেই সমালোচনা শুরু। পশ্চিমা মিডিয়া তথা মোড়লগণ কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি কাতারের নির্বাচন। তাদের কাছে কাতার মানে পিছিয়ে থাকা দুনিয়া। কাতার মানে তথাকথিত সভ্যতার মানদন্ড পেরুতে না পারার দুনিয়া। মত প্রকাশের স্বাধীনতাবিহীন অগণতান্ত্রিক দুনিয়া।

এসবকে বিষয়বস্তু বানিয়ে যত বাজে প্রোপগান্ডা চালানো যায় তারা সবাই মিলে চালিয়েছে। যত রকমের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা যায়, বাকী রাখেনি কিছুই। এভাবেই চলছিল শুরুর দিকটা। বিশ্ব ফুটবল সংস্থা ফিফার অনড় অবস্থানের কারণে কোনভাবেই কাতারের নির্বাচন ওরা বাতিল করাতে না পেরে শেষমেষ বেছে নিয়েছিল ভিন্ন পথ। সব সময় এরা দুর্বল কাউকে কাবু করার জন্যে যে পথ ধরে ঠিক সে পথই ধরেছিল। এরা পুঁজি করেছিল দুর্নীতি আর মানবাধিকারকে।

জিনিস একখান মানবাধিকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর এটাই এদের সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র। এই একটি অস্ত্র এরা প্রয়োগ করে আসছে তাবৎ দুনিয়ায়। বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে এর চেয়ে ধারালো অস্ত্র এদের আর নেই। তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে মানুষের সীমাহীন মত আর ইচ্ছে প্রকাশের স্বাধীনতায় এরা কঠিনভাবে বিশ্বাসী। যদিও এরা এই দুটোর একটিতেও মনে প্রাণে বিশ্বাসী নয়। এরা ততক্ষণ এ দুটোতে বিশ্বাসী যতক্ষণ মানুষের মত এবং ইচ্ছে এদের পক্ষে থাকে। যখনই এদের বিপক্ষে যায় তখনই হেনতেন বলে এরা স্বরূপে আবির্ভূত হয়; আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানুষের টুটি চেপে ধরে।

তখন অন্যায়ভাবে নির্যাতিত এসব মানুষের প্রকৃত মানবাধিকার নিয়ে এদের কোন দরদ থাকে না। নির্মমতার চরম রূপ প্রদর্শন করতেও এরা লজ্জা পায় না। মানবাধিকার শব্দটি মুখে উচ্চারণ করতে করতে এরা মানুষের সত্যিকারের মানবাধিকারকে ধুলায় লুন্ঠিত করে। তেমনি খেলাই খেলেছে কাতারকে নিয়ে। লক্ষ্য একটাই, কাতারে কোনভাবেই বিশ্বকাপের আয়োজন করতে দেয়া যাবে না। তাই, শুরুতেই কাতার দুর্নীতি করেছে আর করেছে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে গুরুতর অভিযোগ আনা শুরু করলো।

কী সেই অভিযোগ? প্রথম অভিযোগ দুর্নীতি। বিশ্বকাপের আয়োজনে ঘুষের লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ করা হলো। কী সর্বনাশ, কাতার ঘুষ দেয়! মিডিয়ায় ছিঃছিঃ উঠলো আর উঠলো রব। এটা ২০১০ সালের কথা। কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পায় এই ২০১০ সালে। এই ২০১০ সালের প্রথম দিকেই দেশটির বিরুদ্ধে ঘুষ দিয়ে আয়োজক হওয়ার অভিযোগ ওঠে। কিন্তু কথা হচ্ছিল এক তরফা। কাতার ঘুষ দিয়েছে। এটা সত্যি হলে পশ্চিমারাও যে ঘুষ নিয়েছে সে কথাটিও প্রমাণিত হয়। ওদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। অবশ্য ফিফার তদন্তে কাতারকে নির্দোষ রায় দেওয়ার পর ওরা থামে। মানে থামতে বাধ্য হয়।

দুর্নীতি প্রমাণে ব্যর্থ হয়ে আনে মানবাধিকার প্রসঙ্গ। দেশটির বিরুদ্ধে শ্রম শোষণের প্রসঙ্গ সামনে আসে। ২০২১ সালের ফেব্র“য়ারিতে ব্রিটেনে গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আয়োজক হওয়ার পর থেকে কাতারে সাড়ে ছয় হাজার অভিবাসী শ্রমিক মারা গেছেন। প্রতিবেদনে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে দাবি করে কাতার জানায়, বিশ্বকাপের অবকাঠামো নির্মাণের সময় মারা গেছেন ৩৭ জন, যাদের মধ্যে কাজে জড়িত ছিলেন মাত্র ৩ জন।

এভাবে মিথ্যেকে সত্য বানিয়ে গেল প্রায় দুই বছরে চিল্লাপাল্লা কম হয়নি। এখানে ওখানে কুটুর কুটুর হয়েছে অনেক। মূলত শ্রমিকদের মানবাধিকার নিয়ে মুখে খই ফোটালেও মানবাধিকার বলতে ওরা চেয়েছিল খেলা চলাকালীন কাতারে রাতভর মদ আর মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করার অধিকার। কেননা মানবাধিকার বলতে এরা এটাকেই গুরুত্ব দেয় বেশি। এদের কাছে মানবাধিকার মানে প্রকাশ্যে মদ খেয়ে মাতলামো করা, ক্লাবে রাতভর অর্থের বিনিময়ে নারীসঙ্গ উপভোগ করা। আর উপভোগ করা সমকামীতা বা সমলিঙ্গের বিকৃত সম্পর্ক।

সমস্যা হলো কাতারে এর একটিরও সুযোগ নেই। গোপনে আছে কি না জানি না। তবে প্রকাশ্যে একটিও নেই। প্রচুর চেষ্টা হয়েছে কাতারকে ঘাড়ে ধরে এসব করাতে। নানা চাপে ফেলে এসব আদায় করতে। ভিতর বাহির সব দিক থেকেই চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হয়নি। মাথা নত করেনি কাতার। ভয় দেখানো হয়েছে সিদ্ধান্ত না বদলালে কাতারে কেউই খেলা দেখতে আসবে না। কাতার এসবকেও তোয়াক্কা করেনি। কাতারের সাফ কথা, খেলা দেখতে কেউ আসলে আসবে; না আসলে নাই।

কী আর করা! কিছুতেই কিছু করতে না পেরে শেষমেষ ওরা হাল ছেড়ে দেয়। এবং খেলা হয় শুরু। ঠিক এই সুযোগটাই নিয়েছেন ফিফা সভাপতি। উদ্বোধনের দিন উদ্বোধনী বক্তৃতায় তিনি মনের সুখ মিটিয়ে পশ্চিমাদের ঝেড়েছেন। বিশ্বকাপ শুরুর আগের দিন সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হন ফিফা সভাপতি। এটিই সাধারণ রীতি। সেই রীতি মেনে দোহায় সংবাদ সম্মেলন করেন ফিফা সভাপতি জিরান্নি ইনফান্তিনো। ৫৪ মিনিটের সংবাদ সম্মেলনে যতটা না প্রশ্নের মুখে পড়েছেন, তার চেয়ে বেশি প্রশ্নই তুলেছেন ফিফা সভাপতি। বিশ্বকাপ আয়োজক কাতারের সমালোচনাকারীদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে রীতিমতো তোপ দাগিয়েছেন তিনি। কাতারের শ্রমিক অধিকারের সমালোচনা ইউরোপীয় দেশগুলোর ‘ভন্ডামি’উল্লেখ করে পশ্চিমা বিশ্বের অতীত ইতিহাসও মনে করিয়ে দিয়েছেন ইনফান্তিনো ।

সুইজারল্যান্ড ও ইতালির দ্বৈত নাগরিক ইনফান্তিনো ২০১৬ সালে ফিফা সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার আগে ছিলেন ইউরোপীয় ফুটবল কর্তৃপক্ষ উয়েফার জেনারেল সেক্রেটারি। সেই ইনফান্তিনো বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে তাঁর অঞ্চলের অতীত ইতিহাস তুলে চাঁছাছোলা মন্তব্য করেছেন, “ইউরোপ আর পশ্চিমা বিশ্ব এখন অনেক কিছু শেখায়। গত ৩ হাজার বছর ইউরোপিয়ানরা বিশ্বজুড়ে যা করেছে, তাতে মানুষকে নীতিকথা শোনানোর আগে আগামী ৩ হাজার বছর তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত।

দুঃখজনক হলেও সত্যি সর্বদা অন্যদের নীতিকথা শেখানো এই দেশগুলো কখনোই নিজেদের নীতিহীনতার তোয়াক্কা করে না। কোনকালেও চায় না ক্ষমা। কোথায়ও না। কাউকে চাইতে সহযোগীতাও করে না। অথচ ন্যায়পাল সেজে দুনিয়া দাবড়ে বেড়ায়। তাদের আশকারা এবং সরাসরি সহযোগীতায় পাকিস্তান ৭১ এ বাঙালীর সাথে যুদ্ধাপরাধের মাধ্যমে চরম ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেও আজ পর্যন্ত ক্ষমা চায়নি। ক্ষমা চাইবার সামান্যতম ইচ্ছাও পোষণ করেনি।

ঐ পশ্চিমাদের মদদইে করেনি। মদদ ওরা দিয়েই চলেছে। আজ এদেশে মদদ দেয় তো কাল ওদেশে। ওরা একচোখা, এককানা। নিজেদের পক্ষের লোকজনের দোষ এরা কখনোই দেখেও না, শোনেও না। শোনে না বলেই ওরা ‘মায়ের ডাক’শুনলেও ‘মায়ের কান্না’শুনতে পায়না। শোনার সামান্যতম চেষ্টাও করে না। করে অবজ্ঞা। অবজ্ঞা করে হনহন করে গাড়িতে চড়ে বসে। একটিবারের জন্যেও পেছনে তাকায় না। তাকালেই যে তাদের নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্বের চরম রূপ বিশ্বসমাজ জেনে যাবে। বুঝে যাবে।

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com