এক ফোনেই পৌছে যায় সেবা
প্রকাশের সময় : 2023-01-04 17:04:25 | প্রকাশক : Administration
বসির আহাম্মেদ: " রক্ত দিই জীবন বাঁচাই" “ভালো ও মানবিক কাজ করি সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গড়ি” এই স্লোগানকে সামনে রেখে ঝিনাইদহের শৈলকুপায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে শুরু হয় অনলাইন ফেসবুক গ্রুপ "রক্তদাতা সংঘ বাংলাদেশ" নামে স্বেচ্ছাসেবী একটি অনলাইন ফেসবুক গ্রুপ ভিত্তিক মানবিক প্ল্যাটফর্ম। যা বিনামূল্যে সেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রম কর্মসূচি করে আসছে।
গ্রুপে রক্তের প্রয়োজন এমন পোস্ট আসলে ডাটাবেইজ থেকে ডোনার খুঁজে বের করার জন্য গ্রুপের সেচ্ছাসেবকদের সমন্বয়ে একটি ডোনার ম্যানেজ টিম গঠন করা হয়েছে। যারা অতি দ্রুত ডাটাবেইজ থেকে ডোনার খুঁজে বের করে রোগীর স্বজনের সাথে ডোনারের যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছেন। বিশেষ করে শৈলকুপা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, যশোর, মাগুরা, খুলনা ও ঢাকাতে যেকোনো মুমূর্ষু রোগীর রক্তের প্রয়োজন হলে গ্রুপে পোস্ট দেবার সাথে সাথে অতি দ্রুতই ডোনার ম্যানেজ হয়ে যাচ্ছে।
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার হাটফাজিলপুর বাজারে “রক্তদাতা সংঘের”ব্যানারে কারো এক ব্যাগ রক্ত দরকার, কারো বা পঙ্গুত্ব ঠেকাতে দরকার উন্নত চিকিৎসা বা ছিদ্র হয়ে যাওয়া হার্টের ভাল্ব প্রতিস্থাপনের মত কঠিন প্রয়োজন, কারো বা ঘরদুয়ার আগুনে পুড়ে গেছে, একটিমাত্র ফোনকলেই তিনি পেয়ে যেতে পারেন কাঙ্খিত সেবা। রক্তদাতা সংঘের ব্যানারে এ দায়িত্বের বোঝা মাথায় নিয়েছেন ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার হাটফাজিলপুর বাজারিভিত্তিক একদল যুবক-যুবতী যাদের অনেকেই এখনো শিক্ষালয় ত্যাগ করেননি।
নিরলস এসব কাজ করতে তাদের সমন্বয় করে চলেছেন সম্রাট হোসেন ও হাবিবুর রহমান। মাত্র দু’বছরেরও কম সময়ে রক্তদাতা সংঘ অর্জণ করেছে বিরাট খ্যাতি আর যশ।
রক্তদাতা সংঘের নেতা বা মডারেটর অথবা অন্য যেকোন পদবী নয়, মহৎ কাজের নেশায় পেয়েছে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত সংঘের প্রধান পরামর্শক হাবিবুর রহমান, বেসরকারি চাকুরে ও সমাজসংগঠক সম্রাট হোসেন বিশ্বাস, ইমরান মোল্যা, ইন্দ্রজিৎ বিশ্বাস, শাওন ইসলাম রিহান, শিখন খান সহ কয়েকশ কর্মী বাহিনীকে। ওরা দিনরাত ডুবে আছেন এসব কাজে।
ইন্দ্রজিৎ বিশ্বাস জানালেন, গত ৫ বছরে তিনি ১০বার রক্তদান করেছেন এবং গত দেড় বছরে তিনি রক্তদাতা সংঘের হয়ে ৫বার রক্ত দিয়েছেন দুস্থ মানুষের সেবায়। এ ধরণের কাজে তিনি এবং তার সতীর্থরা গর্ববোধ করেন বলে জানালেন ওই বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা যুবক।
শৈলকুপার কুমিড়াদহ গ্রামের কৃষক দম্পতি সাজ্জাদুল ইসলাম ও লিপি খাতুন বেশ আবেগের সাথে জানালেন, হার্টের একটি ভাল্বে ছিদ্র নিয়ে জন্মায় তাদের একমাত্র কণ্যাশিশু সামিয়া ফেরদৌস। দেশের বিভিন্নস্থানে চিকিৎসা করালেও প্রকৃত প্রস্তাবে আর্থিক কারণে হয়ে ওঠেনি ওর অস্ত্রপচার। বিষযটি কানে যাবার পরই সংঘের সদস্যরা তাদের বাড়িতে এসে পরিবারসহ ঢাকায় নিয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করান, প্রধানমন্ত্রীর আনুকুল্য নিয়ে ছোট্ট শিশুটির সফল অস্ত্রপচার করা হয়। ওর বয়স এখন প্রায় ৪ বছর। শিশুটি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ জীবনযাপন করছে।
সংঘের প্রধান পরামর্শক হাবিবুর রহমান জানালেন, ২০২০ সালের শেষদিকে এলাকার অসহায় মানুষের মুমূর্ষ সময়ে রক্তের প্রয়োজনীয়তা, তাদের চিকিৎসা ও আর্থিক দিক বিবেচনা করে প্রতিষ্ঠা করেন রক্তদাতা সংঘ। ফেসবুকে তাদের সদস্য সংখ্যা সাড়ে ৯ হাজার আর মেসেঞ্জারে ৫’শর মত, তবে ডেটাবেজে আরও দেড় হাজার সদস্য রয়েছেন এ সংঘের ব্যানারে। এখন পর্যন্ত এ প্ল্যাটফর্ম থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ৪৯৩ জন এর বেশি রোগীকে বিনামূল্যে রক্ত দিয়ে সহযোগিতা করা হয়েছে।
তিনি জানালেন, এলাকার মানুষই নয়, বাইরের কোন মানুষের রক্তের দরকার হলে তাদের কাছে একটি ফোনকলই যথেষ্ট। তাদের সদস্যরা যত দ্রুত সম্ভব রক্তদানের ব্যবস্থা করে থাকেন। দরিদ্র মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হলে, পঙ্গুত্ব বা অন্য কোন বড় ধরণের অস্ত্রপচার, চোখের চিকিৎসা, হার্টের চিকিৎসা বা ওই জাতীয় সমস্যা সমাধানে তারা ছুটে চলেন যেখানে প্রয়োজন। মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে তারা মাঝেমধ্যে মেডিকেল ক্যাম্প, হার্টক্যাম্প, ব্লাড গ্রুপিং কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। তিনি আরও জানান “রক্ত দাতা সংঘ” গ্রুপের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম সমূহ হল- সেচ্ছায় রক্তদান, বৃক্ষরোপন, শীতার্তদের মাঝে বস্ত্র বিতরণ, ধর্মীয় উৎসবে দুস্থদের মাঝে উপহার সামগ্রী বিতরণ, মাদক মুক্ত সমাজ গঠন, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন সমাজ গড়া, প্রতিভা বিকাশ কর্মসূচী, সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীর মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, রক্তের গ্রুপিং নির্ণয়, প্রতিটি সদস্য জীবনে একজন মানুষের হলেও ভাগ্য বদলাতে সাহায্য করা।
হাবিবুর রহমান জানালেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন এবং দেশের বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শাহজাহান তাদের সবধরণের কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা দিয়ে এ বিশাল কর্মকান্ড এগিয়ে নিয়ে চলেছেন যা তাদের সমুদয় কর্মযজ্ঞকে সহজতর করেছে, মানুষকে সেবা দিতে উৎসাহ যোগাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ঢাকার খোন্দকার আতিকুজ্জামান শাহীন তাদের সামনে এগিয়ে যাবার লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে হাবিবুর রহমান জানান।
হাটফাজিলপুর বাজারের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ি ও এলাকার সাধারন মানুষের মতে, তাদের এলাকায় কোন দুর্ঘটনা ঘটলে বা বিশেষ প্রয়োজনে মুহুর্তেই ছুটে আসেন রক্তদাতা সংঘের সদস্যরা, তারাই যেন মানুষের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এ ধরায়। - সুত্র: ঝিনাইদহের চোখ