শত রঙে শতরঞ্জি খ্যাত রংপুর

প্রকাশের সময় : 2023-01-18 13:06:53 | প্রকাশক : Administration
শত রঙে শতরঞ্জি খ্যাত রংপুর

জেসিউর রহমান শামীম: প্রাচীনকাল থেকেই উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী জনপদ রংপুরের রয়েছে গৌরবময় ও বৈচিত্রপূর্ণ ইতিহাস। শত রঙে শতরঞ্জি খ্যাত এই জেলা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। রংপুর জেলার উত্তরে লালমনিরহাট, পূর্বে কুড়িগ্রাম, দক্ষিণ-পূর্বে গাইবান্ধা, উত্তর-পশ্চিমে নীলফামারী এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে দিনাজপুর জেলা অবস্থিত। তিস্তা নদী উত্তর ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তকে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলা থেকে পৃথক করেছে।

অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, রংপুরের নামকরণের ক্ষেত্রে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজীর শাসনামলেই রংপুরের নাম ‘রঙ্গপুর’হয়েছিল। ভিন্ন ইতিহাস থেকে জানা যায়, উপমহাদেশে ইংরেজরা নীলের চাষ শুরু করে। নীলকে স্থানীয় লোকজন ‘রঙ্গ’নামেই জানত। কালের বিবর্তনে সেই রঙ্গ থেকে রঙ্গপুর এবং তা থেকেই আজকের রংপুর।

রংপুরের মধ্যদিয়ে বয়ে চলেছে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ঘাগট, যমুনা, ধরলা প্রভৃতি নদ-নদী। ভিন্নজগৎ, তাজহাট জমিদারবাড়ি, কেরামতিয়া মসজিদ, চিকলির বিল, টাউনহল, রংপুর চিড়িয়াখানা, মিঠাপুকুর তিনকাতারের মসজিদ, ইটাকুমারী জমিদারবাড়ি, রংপুর কারমাইকেল কলেজ, বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র এর মত প্রাচীনতম নিদর্শন ও দর্শনীয় স্থান সমূহে সমৃদ্ধ হয়েছে রংপুর অঞ্চল।

তাজহাট জমিদারবাড়ি রংপুর শহরের অদূরে তাজহাটে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক প্রাসাদ। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে স্বর্ণকার মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। কথিত আছে, তার মনমুগ্ধকর ‘তাজ’বা মুকুটের কারণেই এ এলাকা তাজহাট নামে অভিহিত হয়ে আসছে। তাজহাট জমিদার বাড়িতে রয়েছে বিশাল আকারের চারটি পুকুর। প্রধান প্রাসাদটির ২য় তলায় ওঠা-নামার জন্য গ্যালারির মতো একটি বিরাট সিঁড়ি রয়েছে। অভিগমন পথের ধাপ গুলো সাদা ও ছাই রংয়ের পাথর দ্বারা মোড়ানো। ছাদনির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে বড় বড় লোহার বীম ও লোহার ফালি। কক্ষের দরজাগুলিও বিশালাকার । প্রাসাদের ভিতর দিয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠানামার জন্য লৌহনির্মিত নকশা করা কাঠের সিঁড়িও রয়েছে, সিঁড়ির রেলিংগুলিও লোহার নকশা করা যা দেখতে ফুল গাছের মতো। সিঁড়িটির ভূমি থেকে ভবনের ছাদ পর্যন্ত সাদা-কালো পাথরে মোড়ানো। রাজবাড়ির পেছনের দিকে একটি গুপ্ত সিঁড়ি রয়েছে। এই গুপ্ত সিঁড়ি কোনো একটি সুড়ঙ্গের সাথে যুক্ত, যা সরাসরি ঘাঘট নদীর সাথে যুক্ত বলে জনশ্রুতি রয়েছে। সিঁড়িটি বর্তমানে নিরাপত্তাজনিত কারণে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

ভিন্ন জগতের ভিতরে যেন আরেকটি ভিন্ন জগৎ। বিভিন্ন প্রজাতির গাছে গাছে বাসা বেঁধেছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। এটি রংপুরের সবচেয়ে বড় পিকনিক স্পট ও পর্যটনকেন্দ্র। রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলায় এর অবস্থান। পার্কে প্রবেশের পর লোহার ব্রিজ, তা পেরোলেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মনোরম পরিবেশ প্রশান্তি এনে দেয়। এখানে কটেজ রয়েছে ৭টি, আরো রয়েছে থ্রীস্টার মডেলের ড্রিম প্যালেস। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের প্রথম প্লানেটেরিয়াম। প্লানেটেরিয়ামে ঢুকে হারিয়ে যেতে হয় গ্রহ-নক্ষত্রের ভিড়ে। জানা যায় ‘মহাবিস্ফোরণ বা বিগব্যাং’-এর মাধ্যমে পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস।

২০০৫ সালে রংপুর জাদুঘরকে সরিয়ে তাজহাট জমিদারবাড়ী প্রাসাদের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে আসা হয়। তাজহাট জমিদার বাড়ির প্রাসাদ চত্বরের মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে জাদুঘরে উঠলেই রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী কক্ষ, যাতে রয়েছে দশম ও একাদশ শতাব্দীর টেরাকোটা শিল্পকর্ম। এ ছাড়া এখানে বিভিন্ন হস্তলিপি, পুরনো পত্রিকা, শিবপত্নী পার্বতীর মূর্তি, মাটির পাত্র, বিভিন্ন পোড়ামাটির ফলক, রাজা-বাদশাহদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, সরলা দেবীর ব্যবহৃত সেগুন কাঠের তৈরি বাক্স, ঐতিহাসিক মহাস্থানগড় থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন পোড়ামাটির ফলক রয়েছে এখানে। এ ছাড়াও রয়েছে নারী মূর্তি, লোহার দ্রব্যাদি, সাঁওতালদের ব্যবহৃত তীর, লাল পাথরের টুকরো, পাহাড়পুর বিহার থেকে সংগৃহীত নারী মূর্তি, পাথরের নোড়া, বদনা, আক্রমণাত্মক যোদ্ধার মূর্তি। মহাভারত, রামায়ণ, গাছের বাঁকলে লেখা সংস্কৃত হস্তলিপি, তুলট কাগজে লেখা হস্তলিপি, কবি শেখ সাদী ও বাদশাহ নাসির উদ্দিনের স্বহস্তে লেখা কোরআন শরিফ এবং ছোট্ট কোরআন শরিফও রয়েছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রায় ১১০০ একর জায়গা নিয়ে ঘাঘট নদীর দুপাশে গড়ে তুলেছে প্রয়াস সেনা বিনোদন পার্ক। বেশ গোছানো এ পার্কের উপার্জনের ৭৫ শতাংশ ব্যয় হয় প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে। সেনা চৌকি পুরো বিনোদন কেন্দ্রটিকে করেছে নিরাপদ ও নির্ঝঞ্জাট। পার্কের ভেতরের মূল সড়ক সাজানো হয়েছে লোহার গ্রিল দিয়ে, যার ওপরে লতার মতো বেয়ে উঠেছে বাগান বিলাস। সড়কের দুই পাশে শিশুদের জন্য তৈরি করা হয়েছে দোলনাসহ কিছু রাইডার এবং বিভিন্ন খেলাধুলার সরঞ্জাম। নদীর কিনাররায় রেপ্লিকা হিসেবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের নৌকা।

বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া-এর পৈত্রিক বাড়ি পায়রাবন্দ। এই মহীয়সী নারী জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর এখানেই এই পায়রাবন্দ গ্রামে। এখানেই রয়েছে বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদ কার্যলয়,  পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া স্মৃতি গণকেন্দ্র পাঠাগার ও রোকেয়া কলেজ। সরকারী ব্যবস্থাপনায় এখানে গড়ে তোলা হয়েছে একটি গেস্ট হাউজ ও বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র। স্মৃতি কেন্দ্রে  অফিস ভবন, সর্বাধুনিক গেস্ট হাউজ, ৪ তলা ডরমেটরি ভবন, গবেষণা কক্ষ, লাইব্রেরি ইত্যাদি রয়েছে। কম্পাউন্ডের ভিতরে ঢুকে এগিয়ে গেলেই বেগম রোকেয়ার পিতলের চকচকে একটি ভাষ্কর্য/মূর্তি চোখে পড়বে।

বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রটিতে রয়েছে দশহাজার গ্রন্থ ধারণ করার মতো গ্রন্ধাগার। গ্রন্ধাগারে এক সঙ্গে ৫০ জনের পাঠ করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আরো রয়েছে শব্দ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসহ ২৫০ আসনের মিলনায়তন। সেমিনার কক্ষে রয়েছে একশত আসনের ব্যবস্থা। স্মৃতি কেন্দ্রটি ৩.১৫ একর ভূমিতে গড়ে তোলা হয়েছে।

রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলায় প্রায় ৮০ একর সম্পত্তির উপর ইতিহাসখ্যাত প্রজা হিতৈষী দেবী চৌধুরানীর জমিদার বাড়ি অবস্থিত। বিশাল এলাকা নিয়ে ছড়ানো ছিটানো এ রাজবাড়ির অসংখ্য দালান আজ ধ্বংস প্রায়। বাড়ির পিছনে ইতিহাসের কালের সাক্ষী হয়ে কোনমতে বেঁচে আছে দেবী চৌধুরানীর খননকৃত ঢুসমারা খাল অর্থাৎ হঠাৎ বা অকষ্মাৎ সৃষ্টি। দেবী চৌধুরানী এ খাল দিয়ে নৌকাযোগে নদী পথে বিভিন্ন গোপন আস্থানায় যাতায়াত করতেন।

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com