ফেরত চাই আমাদের সেই প্রভাত-ফেরি

প্রকাশের সময় : 2023-02-01 14:56:56 | প্রকাশক : Administration
ফেরত চাই আমাদের সেই প্রভাত-ফেরি

জোবাইদা নাসরীন: সৈয়দ এনামুল ইসলাম এসেছেন লন্ডন থেকে। তিনি আশির দশকে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। দুই মাস আগেই ফোনে জানিয়েছেন তিনি এবার দেশে আসবেন। এনাম ভাইয়ের খুব ইচ্ছে তার সময়কার বন্ধুদের নিয়ে খালি পায়ে একুশের প্রভাত-ফেরিতে যাবেন। রাস্তাও বলে দেন। আজিমপুর কবরস্থান হয়ে যাবেন, কারণ সেখানে ঘুমিয়ে আছেন মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদ বরকত, জব্বার, শফিউর।

এনাম ভাইয়ের একুশের প্রভাত-ফেরিকে কেন্দ্র করে এই আবেগ আমাকে স্পর্শ করে, আমার গলায় কেমন যেন কিছু একটা পাকিয়ে আসে। আমি কিছু বলি না। আসলে বলতে পারি না। কিন্তু তার মনে সম্ভাব্য বিষন্নতার কথা ভেবে নিজেরই মন খারাপ হয়। কারণ, আমরা জেনে গেছি এখন আর সেই প্রভাত-ফেরি নেই। এখনকার প্রজন্ম সেই প্রভাত-ফেরির কথা হয়তো চিন্তাতেও আনতে পারবে না কোনোদিন।

গত দু’দিন আগে এনাম ভাই ঢাকায় এসেই সাদা পাঞ্জাবি কিনতে ছুটে যান দোকানে। আমি তাকে আশ্বস্ত করি এখন আর এগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। এখন একুশে ফেব্রুয়ারি ‘উৎসব’-এর দিন হয়ে গেছে অনেকটাই। এক মাস আগে থেকেই এগুলোর ব্যবসায় মেতে ওঠেন দেশীয় পোশাক বেনিয়ারা। কেউ কেউ আবার ‘ডিসকাউন্ট’-এর অফার দিয়ে রাখেন এক সপ্তাহ জুড়ে।

তাই আমাদের মধ্যে এখন একুশ আসলে সাজ সাজ রব পড়ে। পোশাক তো দূরে থাক, এখন আর কেউ ফুল নিয়েও ভাবেন না। সবই এখন কিনতে পাওয়া যায়। যেদিন ফুল দেওয়ার কথা বিনে পয়সায় বরং এদিন সবচেয়ে দামি হয়ে ওঠে ফুল। এখন আর একুশে ফেব্রুয়ারি শোকের দিন নয়, এখন আর কেউ শোক করে না, অনেকটাই করে ‘সেলিব্রেশন’। দিবসটিকে কেন্দ্র করে এত এত বেনিয়াদের ভিড়ে এখন ‘সেলিব্রেশন’আর ‘অবজারবেশন’-এর পার্থক্য করা দুরূহ হয়ে ওঠে হয়তো।

কিন্তু আমরা হারিয়ে ফেলেছি সারারাত জেগে থেকে বিভিন্ন জায়গা থেকে ফুল চুরি করে সুতায় গেঁথে মালা কিংবা তোড়া বানিয়ে কিংবা একটা ফুলই হাতে নিয়ে সাদা জামা বা কালো পাড়ের সাদা শাড়ি পরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানটি গাইতে গাইতে খালি পায়ে শহীদ মিনার যাওয়া সেই দিনটি। কেন সেই দিনগুলোতে পায়ে কাঁটা বিঁধে যাবার ভয় হতো না?

বাবা-মায়েরাও সে সময় ভয় পেতেন না? এখনও বেশ মনে আছে, আমরা ছোটরা ২০ তারিখ থেকেই আমাদের সাদা জামা পরিষ্কার করতাম। কি এক আবেগ ভর করতো কে জানে? এই দিনে ফুল চুরি করলে কেউ বকা দেয় না, এই ধারণা কিভাবে সবাই সেই অল্প বয়সেই বুঝে নিয়েছিল? বিকাল থেকেই শুরু হতো কোন কোন বাড়িতে ফুল আছে সেগুলা দেখে আসার পালা। সবাই বাবা-মায়েরা কেন বাচ্চাদের হাত ধরে শহীদ মিনারে আসতেন? কেন আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি অনেকটা জাতীয় সংগীতের মতোই শেখানো হতো?

তারপর বাড়ি ফিরে এসেও আবারও ঘরে দেয়াশলাইয়ের শলাকা দিয়ে কিংবা স্কেল দিয়ে টেবিলের মধ্যেই শহীদ মিনার বানিয়ে সবাই চমকে দিতাম। পাড়ায় পাড়ায় কেমন করে যেন সবাই নানা ফর্মে শহীদ মিনার বানিয়ে ফেলতো। গ্রামগঞ্জে, পুকুর পাড় এমনকি রাস্তার পাশে ইট, বালি কিংবা মাটি দিয়েও গড়া হতো শহীদ মিনার। আহা আমাদের আবেগের এত মিনার আমাদের বুক ভরিয়ে দিতো।

এখনও আমরা শহীদদের স্মরণ করি, আবেগ, শ্রদ্ধা প্রকাশেরও হয়তো ঢংয়ে পরিবর্তন আসে। কিন্তু কোথায় গেলো আমাদের সেই প্রভাত-ফেরি? আজ যখন হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে শহীদ বরকত, শফিউর আর জব্বারের কবরের কাছে গেলাম তখন দেখতে পেলাম দুই একজন শিক্ষার্থীকে সত্যিই আবেগে আপ্লুত হয়ে গেছে।

অনেকেই জানতেন না ভাষাসৈনিকদের অনেকেই এই আজিমপুরেই ঘুমিয়ে আছেন। সে কবরে এখন দুই একটি ফুলের ডালা। বরকতের কবরের পাশে তাঁর স্বজনরা মোনাজাত করছিলেন। মনে পড়ছিল আমার মায়ের কথা। মা বলতেন, শহীদ বরকতের মা হাসিনা বেগম যতদিন বেঁচে ছিলেন, আসতেন ছেলের কবরে, আর বলতেন, ‘এক বরকতকে হারিয়ে হাজারো বরকতের মা হইছি’। 

সেই মা উদ্বোধন করেছিলেন প্রথম শহীদ মিনার। সেই মা হাসিনা বেগম বেঁচে নেই। কিন্তু জাগ্রত আছে তাঁর ছেলেদের তৈরি ইতিহাসের শহীদ মিনার। শুনেছি আগে রাত বারোটা ১ মিনিটে ফুল দেওয়ার রেওয়াজ ছিল না। শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানানোর প্রভাত-ফেরিই ছিল এই দিনের সবচেয়ে গাম্ভীর্যপূর্ণ রেওয়াজ। কিন্তু সেটির পরিবর্তে একটি বিশেষ সময় থেকেই বিশেষ কারণেই রাতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।

আর তার সঙ্গে সঙ্গেই নষ্ট হয়ে যায় প্রভাত-ফেরির তুমুল আবেগের জায়গাটি। এখন প্রতিবছরই ২১শে ফেব্রুয়ারি এলেই হাল ফ্যাশনের পোশাক বের হয়। বর্ণমালা অনেক আগেই পোশাকে স্থান পেয়েছে। রাস্তায় প্ল্যাকার্ড, ব্যানারজুড়ে রাজনীতিবিদদের একুশের স্লোগানসহ শুভেচ্ছা বাণী। ব্যানারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শাখা নেতাদের অনেকের ছবি আছে।

কিন্তু যাদের জন্য আজকে এই দিনটি পৃথিবীর বুকে স্মরণীয় তাঁদের ছবি নেই কোথাও। শহীদ মিনারে কেউ জুতা নিয়েই উঠেছেন, কেউ খুলে, কেউ বা জুতা খুলবেন কিনা ইতস্তত করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। কেউ বা জুতা হারানোর ভয়ে শহীদ মিনারে এসেও দাঁড়িয়ে আছেন। এখন আর মিছিল থেকে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি শোনা যায় না। তার বিপরীতে শোনা যায় স্লোগান। শুধু কেন্দ্রেই একা একা বাজে গানটি।

অনেকেই হয়তো যুক্তি দেবেন, এখন একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়ে ওঠার কারণে এখন শোকের পাশাপাশি ‘উৎসব’-এর দিনও। কিন্তু আমাদের সবসময় একটা কথা বিশ্বাস করতে হবে, নিপীড়নের ইতিহাস এবং শহীদদের প্রতি ভালোবাসা যদি আমরা আবেগ দিয়ে না ধরে রাখতে পারি, তাহলে আস্তে আস্তে এই ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে মুছেই যাবে।

আমাদের প্রভাত-ফেরিই তো হতে পারে ইউনেস্কোর হেরিটেজের অংশ। কারণ, একটি জাতি একটি প্রতীকী প্রথার মধ্য দিয়ে তাঁর সর্বোচ্চ সন্তানদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করছে, সেটিই তো অনেকের জন্য অনুকরণীয় হতে পারতো। কিন্তু সেটির বিপরীতে এখন দেখানো, পোশাকি, আনুষ্ঠানিকভাবে যাওয়া হয় বেশি। তাই এখন আর সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের কবর কেউ চেনে না, সেখানে ফুল দেওয়া হয় না, চেহারাও হয়তো বেশিরভাগ মানুষ চেনে না। কারণ, আমরা পোশাকি একুশে নিয়েই এখন ব্যস্ত।

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com