৫২ কিংবা ৭১; নতুন প্রজন্ম যোজন যোজন দূর!!!

প্রকাশের সময় : 2023-03-15 15:44:04 | প্রকাশক : Administration
৫২ কিংবা ৭১; নতুন প্রজন্ম যোজন যোজন দূর!!!

সরদার মোঃ শাহীন

 

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। ছেলেবেলার স্মৃতি বিজড়িত বিদ্যাপীঠে সময় পেলেই টুকটাক যাওয়া -আসা করি তখন। বয়সের কারণেই করি। গ্রামের স্কুল। বহু পুরানো স্কুল। দীর্ঘ দিনের প্রবাসী বলে যখনই দেশে ফিরতাম, ইচ্ছে করেই শতবর্ষী সেই স্কুল আঙিনাতেই মাঝেমধ্যে ফিরে যেতাম। ফিরে যেতাম বন্ধুদের খোঁজে। জানতাম, সবাইকে পাবো না। পাবার কথাও না। তবুও যেতাম। ইচ্ছে করেই যেতাম। বন্ধুদের না পাই, ছেলেবেলার সেই সময়টুকুকে ফিরে না পাই; শৈশবের হারিয়ে যাওয়া স্কুল প্রাঙ্গনের সেই ঘ্রাণটুকু তো ফিরে পাবো!

ঘ্রাণ খোঁজার নেশাতেই যেতাম। সবই তো আমার হারানো স্মৃতির পুরোনো ঘ্রাণ। হারানো শৈশবের ঘ্রাণ। মানুষের স্বভাবটাই এমন। মাঝবয়সে মানুষ হারিয়ে যাওয়া শৈশবকে খোঁজে। কেবল আমি নই। আমার মত অনেকেই খোঁজে। অনেকটা এ কারণেই হারানো শৈশবকে কুড়িয়ে পাবার নেশায় আমি একটু বেশি বেশিই খোঁজা শুরু করলাম। আমার সময়ের কয়েকজন শিক্ষাগুরু তখনও বেঁচে আছেন। স্কুলেই আছেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সরাসরি ছাত্র আমি। তিনিও আমাকে বেশ স্নেহ করেন।

বলা যায় স্নেহের লোভেই একটু বেশি বেশিই যাই। স্কুলের খোঁজখবর নেই। সাধ্যে যতটুকু কুলায় টুকটাক স্কুলের জন্যে কিছু কাজও করি। এভাবে কাজ করতে করতে এক সময় মনে হলো স্কুলে কলেজ শাখাও চালু করা দরকার। শতবর্ষী স্কুল। সারাবাংলায় শতবর্ষী একটি স্কুলও অবশিষ্ট নেই, যেটা কলেজ হয়নি। আমাদেরটা হবে না কেন! সরকারের কাছে আবেদন করলে নিশ্চয়ই হয়ে যাবে।

যেই ভাবা সেই কাজ। এলাকার চেনাজানা অনেকের সাথেই পরামর্শ করলাম। সবাই সায় দিল। বিরোধীতা করার একজন লোকও ছিল না সেদিন। আমতা আমতা করছিলেন শুধুমাত্র একজন। তিনি আমার শিক্ষাগুরু প্রধান শিক্ষক। কিন্তু তাঁকে ছাড়া তো হবে না। তাই তাঁকে ম্যানেজ করলাম অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে। রাজি হলেও কৌশলে তিনি কালক্ষেপণ করছিলেন আবেদন করতে। প্রায় একটি বছর আমাদের ঘোরালেন। নাছোড়বান্দা ছিলাম বলে শেষমেষ আবেদন না করে তিনি পারেননি। এবং আল্লাহর রহমতে আবেদন করার পরপরই খুব অল্প সময়ে শিক্ষাবোর্ড তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনও পেয়ে গেলাম।

অনুমোদন পাওয়ায় খুশি আর ধরে না। খুশিতে মনে হলো, আমাদের বিরাট বিজয় হয়েছে। এভারেস্ট জয় করার মত বিজয়। খুশির চোটে এক ধরণের নেশাও চাপলো। সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলেজটিকে ঢেলে সাজাবার নেশা। ঢেলে সাজাতে যেয়ে প্রথমেই মনে হলো কলেজের শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। মানোন্নয়নে পরিশ্রম করতে হবে। বন্ধুরা মিলে এটাসেটা শুরুও করে দিলাম। এসবে আমার মত মাঝবয়সী বন্ধুরা খুব খুশি। খুশির চোটে কলেজকে না জানিয়ে এই বন্ধুরা মিলে একুশের ভোরবেলায় ফুল নিয়ে কলেজ প্রাঙ্গনে থাকা শহীদ মিনারে হাজির হবার সিদ্ধান্ত নিলাম।

এখানেও আগ্রহটা আমারই বেশি ছিল। দুর্ভাগ্য! হঠাৎ জ্বরে পরায় আমি আর যেতে পারলাম না। বাকীরা সবাই গেল। কিন্তু কলেজ গেইটে যেয়ে বন্ধুরা আমার ‘থ’হয়ে গেল। সমস্যা কী ভেবে সবাই মুখ চাওয়াচাওই শুরু করলো। বিদ্যাপীঠের তালাবদ্ধ গেইট দেখে সবাই হতভম্ব; হতবাক। কোনভাবেই ভিতরে ঢোকার জো নেই। যে আঙিনা আজ গমগম করার কথা, সেখানে ভিতরে শিক্ষার্থী ভাল, একটা কাকপক্ষীও নেই। নীরব নিস্তব্ধ স্কুল তথা সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলেজ আঙ্গিনা। দেয়ালে মাথা উঁচু করে ভিতরটা দেখা যায়। নীরবে নির্জনে জীর্নশীর্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সমগ্র এলাকায় থাকা আমাদের একমাত্র শহীদ মিনার!

আমাদের ছোটবেলায় এই মিনারটি ২১ এর প্রাতে লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত। পুরো জনপদের মানুষ জড়ো হতো এখানটায়। ফুলে ফুলে ভরে উঠতো এর পাদদেশ। আজ তার কী শ্রী! কী দৈন্যদশা! খবরটা পেয়েইে স্যারকে ফোন দিলাম। রিং বাজে, কিন্তু স্যার ফোন ধরেন না। কলব্যাকও করেন না। সারাটা দিন এভাবেই কাটিয়ে দিলেন গুরু আমার! তাঁকে পেলাম পরদিন সকালে। ফোনে তাঁর কন্ঠ অনেকটা অচেনা মনে হলো। উদাসীনতায় মাখা। খুবই উদাসীন কন্ঠে মিনমিন করে বললেন, এই সব তো ভাল কাজ না। তরিকাপন্থী কাজ। শিক্ষার্থীদের যতটা সম্ভব তরিকাপন্থী কাজ থেকে দূরে রাখাই উত্তম।

তাঁর উত্তম কাজের আরো নতুন নতুন সন্ধান পেলাম। তিনি কেবল জাতীয় শোকদিবস উদযাপন বিরোধীই নন, খোদ জাতীয় সংগীত বিরোধীও। স্কুল প্রাঙ্গনে যাতে জাতীয় সংগীত না বাজাতে পারে এই জন্যে খুব পরিকল্পনা করে মর্নিং এসেম্বলীটাও বন্ধ করে দিয়েছেন। এসেম্বলী হয় না কয়েক বছর। ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যার শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৫ শতাধিক; সেই প্রতিষ্ঠানে তিনি এসেম্বলী করেন না। একুশে উদযাপন করেন না। স্কুলের অনুষ্ঠানে অন্যান্য গান করতে দেন, বাজনা বাজাতে দেন। কিন্তু আপত্তি তাঁর কেবল জাতীয় সংগীতে।

পাশাপাশি অন্যান্য জাতীয় দিবসেও। ক’দিন বাদেই মহান স্বাধীনতা দিবস। স্যারকে ২৬শে মার্চের গুরুত্ব বিবেচনায় সকল শিক্ষার্থীদের নিয়ে অন্তত ছোটখাট একটা আলোচনা সভা আয়োজন করতে বিনীত অনুরোধ জানালাম। সবাই মিলেই জানালাম। স্যার মোচড়ামুচড়ি শুরু করলেন। কঠিন মোচড়ামুচড়ি। চেষ্টা করলেন প্রসঙ্গ পাল্টে ভিন্ন প্রসঙ্গে যেতে। বুঝলাম স্যার বড়ই বিব্রত হচ্ছেন। না পারছেন সরাসরি না করতে; না পারছেন হ্যাঁ করতে।

এই হ্যাঁ এবং না এর দোলায় দোলতে দোলতে তাঁর মত মানুষেরা জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকার যে অবমাননা করছেন সেটা পরিষ্কার বুঝলাম। তাঁরা অবমাননাটা শুরু করেন ধর্মের দোহাই দিয়ে। ধর্মের ভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দিয়ে কোমলমতি মানুষদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেন এবং ইনিয়ে বিনিয়ে জাতীয় সংগীত এবং জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মানকে ধর্মহীনতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। যেহেতু ধর্মপ্রাণ মানুষেরা ধর্মহীনতাকে গ্রহণ করে না, তাই বিনাবাক্য ব্যয়ে তারা জাতীয় সংগীত গাইতে চায় না এবং পতাকার প্রতিও সামান্য সম্মান দেখায় না।

সম্মান দেখায় পাকিস্তানের অখন্ডতায়। অখন্ড পাকিস্তান মানেই যেন অখন্ড ইসলাম। তাতে বাঙালী পরাধীন হোক, সমস্যা নেই। একটা স্বাধীন দেশে পরাধীনতার স্বপ্নে বিভোর মানুষেরা কেমন করে বীরদর্পে টিকে থাকে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের আমলে, সেটা ভেবেও আমি  কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। অগত্যা পরামর্শ করলাম কলেজের গভর্নিং বডির প্রধানের সাথে। তিনিই একমাত্র ভরসা। ভাবলাম আর কেউ না বুঝুক, তিনি অন্তত বুঝবেন। কেননা তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের বড় নেতা। তিনি এলাকার নেতা, কলেজেরও নেতা। আর যাই করুন, স্বাধীনতা দিবস নিয়ে তিনি সহযোগীতা করবেনই ।

না, তিনি করেননি। কেবল তিনি নন, এলাকার একজন আওয়ামী লীগারও সামান্যতম সহযোগীতা করেননি। যেমনি বড় নেতারা করেননি, তেমনি ছোট নেতারাও। সহযোগীতা করার সময় কোথায় তাদের। তারা ব্যস্ত নিজ নিজ আখের গোছাতে। সত্যি বলতে এমনিতর নেতায় এখন ভরে গেছে দেশ। এটা কেবল এক এলাকায় সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলায়। দীর্ঘদিনের ক্ষমতার স্বাদ সরকারী দলের মফস্বল উইংকে এতটাই অন্ধ করেছে যে, দলে লোক ভেড়াতে তারা কোন বাছবিচার করে না। হাতে পেলে মোটা খাম, জায়েজ সকল ডান বাম।

ক’দিন আগের এই ডান-বামদের অনেকেই এখন আওয়ামী লীগার। বর্ণচোরা আওয়ামী লীগার। আর এমনিতর লীগারদের হাতেই মফস্বলের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাই স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান করা নিয়ে সেদিন আমার স্কুলে যা হয়েছিল, তা অহরহ হয় দেশের অধিকাংশ স্কুলেই। দশ বছর আগেও হতো, এখনও হয়। সব কিছুই হয় স্থানীয় আওয়ামী লীগারদের নেতৃত্বে। কেননা অলিখিতভাবে এটাই প্রতিষ্ঠিত যে, আওয়ামীলীগার ছাড়া বর্তমানে দেশের একটি এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজও পরিচালিত হচ্ছে না।

বলা যায় তারাই চালাচ্ছে। আর তাদেরই পরোক্ষ সমর্থনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের অধিকাংশ বড় পদ দখল করেছে নব্য স্বাধীনতা বিরোধীরা। এরাও বর্ণচোরা। দীর্ঘদিন একসাথে চললেও বোঝার উপায় নেই ওদের আসল চেহারা। মুখোশের আড়ালে এরা কঠিন রকমের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। তবে বোঝার কায়দা নেই। বড় কৌশলী এরা। কৌশলের আশ্রয় নিয়েই বীরদর্পে এদেশে টিকে আছে। আছে ক্ষমতার অনেকটাই কাছাকাছি।

আগেও ছিল। তবে পার্থক্য কেবল এইটুকুই যে, আগে ওরা নিজ পরিচয়ে মাথা উঁচু করে প্রকাশ্যে আসতো। এখন প্রকাশ্যে আসলেও নিজ পরিচয়ে আসে না। আসে মুখোশের আড়ালে; মাথা নীচু করে। তবে থাকে অপেক্ষায়। একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাছ শিকারী বকের মত কঠিন অপেক্ষায়! কাঙ্খিত সুদিনের অপেক্ষায়!! ক্ষমতার মসনদ থেকে হাসিনার বিদায়ের অপেক্ষায়!!! 

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com