পলিটিক্যালি আসিলাম
প্রকাশের সময় : 2023-05-17 16:30:05 | প্রকাশক : Administration
পারভেজ রাকসান্দ কামাল: গত পরশু ছিল আমাদের ১০ম বিবাহবার্ষিকী। এই একটি বিষয় স্ত্রীরা কখনই ভোলেন না এবং কাউকে ভুলতেও দেননা। আর স্বামীরা যতটা পারেন কম মনে রাখতে চেষ্টা করেন। আমার স্ত্রী শিলা বিবাহের সেই কঠিন দিনটিকে দুই-তিন মাস আগে থেকেই আকারে ইঙ্গিতে আমাকে মনে করিয়ে দিতে থাকেন। আমিও হাসি চেপে মনে পড়ার ভঙ্গী করি। মনে করানোর আবার নানা রকম তরিকা রয়েছে। এই যেমন, সেদিন সকালে নাস্তার টেবিলে আদুরে গলায় বলে বসল, “অ্যাই এইবার আমাকে কী দিবা?”
আমি বুঝেও না বোঝার মতো করে বলি, “কী দিব মানে? বাসায় বাজার আছে তো। শনিবারের আগে বাজার করব না। একটু চালিয়ে নিও প্লিজ।”
শিলা আমার চালাকি ধরে ফেলল। তারপরও মুখটা হাসি হাসি করে বলল, “আমাদের তো ১০ বছর হতে চলল। আমায় এবার কী উপহার দিবা? আমি ঠিক করেছি তোমাকে একটা সারপ্রাইজ গিফট দেব।”
এই এক সমস্যা। আমার কাছে জানতে চাচ্ছে যে, আমি কী গিফট দিব। কিন্তু নিজেরটা রয়েছে সারপ্রাইজ গিফট। এটা কী একটা পলিটিক্যালি ট্রিকস নাকি বাবা! আমি ভেবে কূলকিনারা করতে পারিনা।
আমিও বললাম, “সারপ্রাইজ গিফট হবে আমারটাও। এই বলে অফিসে চলে আসলাম।
অফিসে এসে কাজের ফাঁকে ভাবতে লাগলাম, কী গিফট করা যায়! দুপুরের লাঞ্চের পর মিনিট তিরিশেক একটু চোখ বন্ধ করে ঝিমানো আমার অভ্যাস। এই কয়েকদিন ঘুমের মাঝেও গিফটের কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
যাই হোক অনেক ভেবে চিন্তে একটা আইডিয়া বের করে ফেললাম। আমার পরিচিত চারুকলার এক ছোট ভাইকে ফোন দিলাম।
“শোন আমার ১০ম বিবাহ বার্ষিকী। তোমার ভাবীরে একখান গিফট দিব। তুমি তোমার ভাবীর একটা পোট্রেট করে দিবা। পারবা না?”
সে বলল, অবশ্যই পারবো। আমি তোমার ভাবীর একটা ফটো পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওইটা দেখে দেখে আঁকবা। ঠিক আছে?”
“তয় কিছু খরচাপাতি লাগব।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কত?”
ছোটভাই বলল, “দিয়েন হাজার বিশেক। ওহন কিছু টাকা এডভান্স দেন।”কথা শুনে আমার তো আত্মা উড়ে যাবার দশা। আমি বললাম “বড়ভাইদের সাথেও ব্যবসা করবা নাকি? আমি হাজার পাঁচেক টাকা দিব। তোমারে হোয়াটসঅ্যাপে ছবি দিছি। দেখো।”
ও সব শুনে বলল, “ঠিক আছে। দেখি।”
আমি মাস খানেক পর গিয়ে টাকা দিয়ে ছবি নিয়ে আসব।”
মনে মনে ভাবি শাড়ি বা গয়না কিনতে গেলে অন্তত হাজার তিরিশ থেকে পঞ্চাশ লাগত। সেখানে পাঁচ হাজারে পার হয়ে যাব। এসব কথা কাউকে জানানো যায়না। তাই নিজের পলিটিক্যাল বুদ্ধির তারিফ নিজেই করতে থাকি।
এর মধ্যে আমি পোট্রেটের কথা বেমালুম ভুলে গেছি। ইতিমধ্যে মাস খানেক পার হয়ে গেছে। পোট্রেটের খবর জানার জন্য সেই ছোট ভাইকে একটা ফোন দিলাম।
কি খবর? পোট্রেটের কী অবস্থা? কবে নিতে আসব?”
সে বলল, “আপনে তো এডভান্স পাঠাইলেন না। আর আমি ফ্রী কাম করি না।
“ফ্রী, কিসের! পাঁচ হাজার টাকা দেব বলেছি তো।”পাঁচ হাজারে রং, তুলি, ক্যানভাসের টাকাই উঠেনা। ভাবীরে অন্য গিফট দেন বস।”
এ কথা শুনে আমি এসির মধ্যেও ঘেমে উঠতে লাগলাম। কাল বাদে পরশু বিবাহবার্ষিকী। হঠাৎ মনে হলো আমি নিজে প্রকৌশলী। ফলে ড্রয়িং করার অভ্যাস আছে ও সেই সাথে ট্রেনিংও আছে। পোট্রেট আমি আঁকব। অফিসের পিয়নকে পাঠিয়ে রং, তুলি, ক্যানভাস ও পেন্সিল কিনে আনলাম। শিলাকে বললাম, “অফিসে কাজের খুব চাপ। রাত হবে ফিরতে।”
যাক বাব্বাহ! শান্তিমত ছবি আঁকব। সুতরাং কোমড় বেঁধে, শুরু করলাম আঁকা। শিলার যে ছবিটি আমি চারুকলার ছোট ভাইকে পাঠিয়েছিলাম, সেই ছবিটি দিয়েই কাজ শুরু করলাম। ঝাড়া তিন ঘন্টার পরিশ্রমে স্কেচ করে ফেললাম। দূরে দাঁড়িয়ে দেখলে, একবার শিলার মুখের মতো আবার অন্য কিছুর মতো মনে হচ্ছে। না না আর এসব অলক্ষুণে কথা ভাববনা।
যাক সেসব। এবার ছবিতে রং দেবার পালা। কিন্তু পিয়ন ব্যাটা এই কিসব রং কিনে এনেছে! এই রং দিয়ে আমি মুখাবয়বের কালার আনব কী করে? এতো সব ডার্ক রেঞ্জের কালার। মনে মনে বেশ রাগ হলো পিয়নের উপর। অগত্যা এই সব রং দিয়ে কাজ চালাতে হবে। প্রায় পৌনে দুই ঘন্টা ধরে স্কেচের উপর রং লাগিয়ে ছবিটিকে একটা মানানসই রকম ব্যবস্থা করে ফেললাম।
তারপর পোট্রেটটি একটা দোকান থেকে বাঁধিয়ে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। শিলা দরজা খুলে দিল। আমার হাতে একটা বড়সড় জিনিস দেখে শিলা জিজ্ঞেস করল, “কী এটা?”
আমি মুচকি হেসে বললাম, “তোমার জন্য সারপ্রাইজ গিফট।”
শিলা বোধহয় ভেবেছিল যে, ছোট একটা ডায়মন্ডের বক্স বের করব পকেট থেকে। তা না করে আমি চারকোনা বাক্সটি খুলে আমার আঁকা সেই পোট্রেটটি ওর সামনে মেলে ধরলাম। পোট্রেটের দিকে তাকিয়ে শিলা একেবারে চুপ হয়ে গেছে। একবার ছবির দিকে তাকাচ্ছে, একবার আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে আবার একবার আয়নায় নিজের দিকে তাকাচ্ছে। আমি ভাবছি নিশ্চয় ছবিটি ওর পছন্দ হয়েছে। এ মনে হচ্ছে তারই নমুনা।
আমাদের পাঁচ বছরের কন্যা ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “হোয়াই ইজ দ্যাট এলিফ্যান্ট অয়ারিং মামস ড্রেস?”
কথা শেষ করেই কন্যা আর দাঁড়ালো না।
এবার আমি শিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, “পোট্রেটটা তোমার পছন্দ হয়েছে?
শিলা বলল, “খুব পছন্দ হয়েছে। মেয়ের কমেন্ট শোননি?” তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “এর পুরষ্কার হিসাবে, তুমি বাসা থেকে বেরিয়ে যাবে। তোমার চোখে আমি এইরকম দেখতে? ছি: ছি:। আগামীকাল সবাইকে এই গিফট আমি কিভাবে দেখাব!”
শিলার রুদ্রমূর্তি দেখে আমি ভয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। আমার প্রতিভার কোন মূল্যই নেই শিলার কাছে। শিলাকে বারবার ফোন দিচ্ছি, কিন্তু ফোন ধরছেনা। ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত আমি আমার শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
শাশুড়ি আম্মা সাত সকালে আমাকে দেখে বললেন, “কী ব্যাপার বাবা! শিলা কোথায়?”
আমি বললাম, “আম্মা, শিলা বাসায় আছে। আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। তাই একটু আশ্রয়ের জন্য এই বাসায় এসেছি। মানে বলতে পারেন পলিটিক্যালি আসিলাম, থাকিবার জন্য।”শাশুড়ি বললেন, “বুঝলাম না।”
একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমার ছোট শালি আমাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। বলল, “মা, ভাইয়া রাজনৈতিক আশ্রয় বা পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম চাচ্ছে।”
যাক সকালে ভরপেট নাস্তা খেয়ে শ্বশুর, শাশুড়ি ও শালিকে সব ঘটনা খুলে বললাম। ভাল করে বোঝালাম যে, আমি যে কতবড় মাপের একজন চিত্রশিল্পী। প্রতিভার কতবড় অপমান!
সব শুনে শাশুড়ি ফোন দিলেন শিলাকে। বললেন, তুই পোট্রেটটা নিয়ে বাসায় আয়।”শিলা ওদিক থেকে কী বলল বুঝতে পারলাম না। দুপুরের দিকে শিলা, আমার বড় আপা ও দুলাভাই আমার শ্বশুরবাড়ি এসে হাজির। সাথে আমার আঁকা সেই অতুলনীয় পোট্রেটটি।
পোট্রেটটি দেখে আমার শালী সশব্দে হেসে উঠল। তারপর সবাই হাসতে লাগল। শুধু শিলার মুখে কোন হাসি নেই। শাশুড়ি আম্মা বললেন, মুখের রং ওরকম শ্রী কৃষ্ণের গায়ের কালারের মতো কালচে নীল কেন?”
আমি বললাম, “এতে আমার কোন দোষ নেই আম্মা। ঔ পিয়ন ব্যাটা ঠিকঠাকমত রং কিনতে পারে নাই।”
“আর ঠোঁট দুটো অত মোটা মোটা কেন?”
“হঠাৎ করে রং বেশি পড়ে গিয়েছিল তাই একটু মোটা হয়ে গেছে। এরপরের বার ঠিক হবে।”
শাশুড়ি মা এবার শিলাকে বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে। জামাই আঁকার চেষ্টা করেছে তাই বড় কথা। তাই বলে বাসা থেকে বের করে দিবি?”
সংসার জীবনে একটু বুদ্ধি করে চলতে হয়। মানে একটু পলিটিকস করে চলতে হয়। কিন্তু বেশি বুদ্ধি খাঁটাতে গেলে বুদ্ধিবিড়ম্বনাও কম পোহাতে হয় না। তাই বলছি বেশি পলিটিক্যালি ট্রিকস না করাই ভালো। - সূত্র: ইত্তেফাক