সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলাই প্রধান কাজ!

প্রকাশের সময় : 2023-12-07 14:15:09 | প্রকাশক :
সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলাই প্রধান কাজ!

সরদার মোঃ শাহীন

 

সমাজের তথা দেশের জন্যে কিছু ভাবতে বা করতে হলে অর্থকড়ি থাকতেই হবে এমন কোন কথা নেই। অর্থ ছাড়াও সমাজের জন্যে অনেক কিছু করা যায়। যার যেমন সামর্থ্য, তিনি বা তারা ঠিক তেমন করেই সমাজের জন্য করতে পারেন। ভাবতে পারেন। যার অর্থ আছে তিনি অর্থ দিয়ে করতে পারেন। যার অর্থ নেই তিনি সময় দিয়েও করতে পারেন। অর্থ ব্যয় ছাড়াও কেবল মাত্র সময় ব্যয় করেও সমাজের জন্যে করা যায় এমন হিতকর অনেক কাজ আছে।

বিশেষ করে সচেতনতামূলক কাজগুলো। মানুষকে সচেতন করে গড়ে তুলতে অর্থ লাগে না। লাগে সদিচ্ছা। সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সুচিন্তিত পরামর্শ দিয়ে ভাল কাজে উদ্বুদ্ধ করা খুব কঠিন কোন বিষয় নয়। সহজেই করা যায়। ব্যক্তিগত ভাবে করা যায়, আবার সমষ্টিগতভাবেও করা যায়। এই উদ্বুদ্ধ করাটাই মহৎ একটি সামাজিক কাজ। এবং এই কাজটি খুব সহজে করতে পারে মিডিয়া।

দুঃখজনক হলেও সত্যি, এ ক্ষেত্রে দেশীয় মিডিয়ার ভূমিকা নেই বললেই চলে। প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া বিভিন্ন ফিচার, প্রোগ্রাম বা অনুষ্ঠান নির্মাণের মাধ্যমে সমাজকে একটা বার্তা সব সময়ই দিতে পারে। বার্তায় নানা বিষয়ে সমাজকে জাগিয়ে তুলতে পারে। সামাজিক শিক্ষায় সমাজ গঠনে এর চেয়ে বড় মাধ্যম বর্তমান দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় আর হতে পারে না।

এমনটা নেই বলেই সমাজের প্রতিটি জায়গায় সামাজিক অসংগতি চোখে পড়ে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমরা শিক্ষা পাচ্ছি কিংবা শিক্ষিত হচ্ছি বটে, কিন্তু মারাত্মক ঘাটতি থেকে যাচ্ছে সামাজিক শিক্ষায়। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে যে দায়িত্ববোধ থাকা দরকার সেটাই তো সামাজিক শিক্ষার মূলমন্ত্র। শিক্ষাটা নেই বলেই আমরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিতরাও সমাজের বিদ্যমান অসঙ্গতিগুলো বুঝতে পারি না। দেখতে পারি না। দেখার চোখ নেই বলেই দেখতে পারি না ।

২০০৩ সাল। ঢাকা সবেমাত্র আইটি জগতে প্রবেশ করেছে। বিশ্ববাজারের ডাটা এন্ট্রির কাজ নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা হচ্ছে। আমিও কাজ করছিলাম টোকিওতে সফটওয়্যার নিয়ে। কাজ করাচ্ছিলাম ঢাকায় সাবকন্ট্রাক্টে। কিন্তু সাবকন্ট্রাক্ট দিয়ে জাপানের ক্লায়েন্টকে খুশি করতে পারছিলাম না। অবশেষে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের আউটসোর্সিং কাজের জন্যে হাউজ চালু করলাম ঢাকায়। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট হাউজ।

জাপান থেকে ঢাকায় আসা যাওয়া করেই ঢাকার অফিস চালাবো বলে স্থির করেছিলাম। একটা অফিসও নিলাম। নিলাম লোকবলও। নিলাম গেইটকিপার। অফিস পিয়নও নিলাম। সমস্যা বাঁধলো অফিস পরিষ্কার করা নিয়ে। অফিস রুমের সাধারণ ঝাড়ু মোছার কাজ করতে সে রাজী হলেও বিশেষ বিশেষ জায়গায় সে কোনমতেই কাজ করবে না। টয়লেট, বাথরুম এবং আউটার পার্ট সে কিছুতেই ঝাড়ুও দেবে না। পরিষ্কারও করবে না।

তার ইজ্জতে বাঁধে বলেই করবে না। দরকার হলে চাকুরী ছেড়ে দেবে; তবুও ইজ্জত ছাড়বে না। ভাবখানা এমন যেন সে ইজ্জতপুরের ইজ্জত আলীর ছেলে ইজ্জত উদ্দীন। ঢাকায় এসে ইজ্জত উদ্দীনকে ডাকলাম। ডাক নাম তার সাগর। আদর করে সাগরের কাছে জানতে চাইলাম ওর কাজ না করতে চাইবার সত্যিকারের কারণ। আমার আদরে সে কিছুটা অবাক হলো। এবং খুবই বিনীতভাবে জবাব দিলো, স্যার! গরীব ঘরে জন্ম নিয়েছি। পেটের দায়ে কাজ করি। সব কাজ করতে পারবো। কিন্তু আমি কলেজে পড়া মানুষ। সুইপার মেথরের কাজ করতে পারবো না।

আমি বুঝলাম সমস্যা ওর সামাজিক শিক্ষায়। তবে সমাধানটি খুব কঠিন মনে হলো না। তৎক্ষণাৎ জাপানী অভিজ্ঞতা কাজে লাগালাম। ওর সাথে আমিও নেমে গেলাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে। বললাম, তুমি এতদিন যা যা করেছো, আজও ঠিক তাই করবে। বাকীটা আমি করবো। ও আগের মতই ওর পছন্দের জায়গা পরিষ্কার করতে শুরু করলো। আমি শুরু করলাম টয়লেট পরিষ্কারের কাজ। একের পর এক চারটি টয়লেট ঘষেমেজে সাফ করে ভবনের বাইরে চলে গেলাম।

শুরু করলাম আউটার পার্ট ক্লিনিং। বাইরে প্রচুর ধূলা, তাই মাথায় গামছা বেঁধে শুরু করলাম। লক্ষ্য করলাম, এবার আমি একা নই। আমার সাথে যোগ দিয়েছে অফিসের বাদবাকী সবাই। দু’জন মেয়ে ছিল, ওরাও চেয়ার ছেড়ে দৌঁড়ে এসেছে। হাতের কাছে যে যা পেয়েছে তাই নিয়ে দৌঁড়ে এসেছে। ঝাড়ু, মব এবং নেকরা কাপড় হাতে সবাই নেমে পরেছে কাজে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে। যেন একটা প্রতিযোগিতা। কার আগে কে কোনটা করবে, কে বেশি করবে সে সবের প্রতিযোগিতা।

চোখ বন্ধ করেই বলা যায়, ঘাম ঝরানো প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় লোকজন বেড়ে যাওয়াতে অতীব অল্প সময়ে আউটার পার্ট নিমিষেই পরিষ্কার হয়ে গেল। ছোট্ট আমার সেই অফিসটির ভেতর বাহির এখন ঝকঝকা, তকতকা। যেমনি ঝকঝকা প্রতিটি রুম, তেমনি তকতকা প্রতিটি টয়লেট। মনে হলো, এটা পুরানো কোন অফিস নয়; যেন সদ্য ইনটেরিয়র সমাপ্ত হওয়া নতুন কোন অফিস। নতুন বাড়ি।

একটা দারুণ পরিচ্ছন্নতার আমেজে স্ন্যাকস মিটিং এ বসলাম সবাইকে নিয়ে। বিকেলে আমার ভীষণ প্রিয় ডাল পুরি আর ছমোচা; সাথে লাল চা। চায়ে চুমুক দিয়ে হাসতে হাসতে জানতে চাইলাম সবার অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতি। দেখলাম, সবাই বেশ উৎফুল্ল। এবং উজ্জীবিত। নিজ হাতে নোংরা কাজ করার সংকোচটা অনেকটাই সবার চোখমুখ থেকে যেন সরে গেছে। তবে রয়ে গেছে লজ্জা বোধ। এতদিন এসবে হাত না দেবার লজ্জা, এসব কাজ না করার লজ্জা।

সুযোগটা আমি নিলাম। মনের কথাগুলো শেয়ার করার সুযোগ। প্রশ্ন দিয়েই শুরু করলাম। ঝাড়ু হাতে নিতে আজ কি কারো খারাপ লেগেছে? লজ্জা লেগেছে? উত্তর পেলাম, নো! লাগেনি। বাইরের রাস্তায় ঝাড়ু দিয়ে কারো কি ইজ্জত চলে গেছে? একই উত্তর, নো! যায়নি। তবে মাথা উঁচু করে দেয়া উত্তর নয়। অনেকটাই মাথা নীচু করে দেয়া উত্তর। তাকালাম সাগরের দিকে। একেবারে পেছনের কোনায় বসা সাগরের চোখেমুখে তখন সংকোচহীনতার ঝলক। সবচেয়ে বেশি উৎফুল্ল এখন সে। অনুমতি চাইলো কিছু বলার। অনুমতি দিলাম।

স্যার! আমায় মাফ করবেন। আমি ছোট মানুষ। পড়াশুনা তেমন করি নাই। কলেজে ভর্তি হয়েও পরীক্ষা দিতে পারি নাই। তাই পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে কাজকর্ম খুঁজি। গ্রামে কাজকামও নাই, থাকলেও পয়সাপাতিও তেমন নাই। তাই ঢাকায় আসছি। বেশি সময় লাগেনি, কপাল গুণে এই চাকুরীটাও জুটেছে। জানতাম ছোট চাকুরী। কাজটাও ছোট। কিন্তু শুধু জানতাম না, কাজের মধ্যে কোন বড়ছোট নাই, কাজ তো কাজই।এই বলে একটু থামলো সাগর। এরপর আবার মাথা উঁচু করে বললো, কাউরে লাগবে না, স্যার। কাল থেকে আমি একাই সব জায়গা পরিষ্কার করবো। আগে করবো টয়লেট। আমায় মাফ করে দেবেন, স্যার।

মজার ব্যাপার হলো, শুধু সাগর নয়। কাজ করতে চাইলো অফিসের সবাই। সে এক হুড়াহুড়ি অবস্থা। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবাই কাজ করার জন্যে আবেদন জানাচ্ছে। সবার এতটা আগ্রহ আর পজিটিভ ইচ্ছা আমার প্রত্যাশারও বাইরে ছিল। মাত্র একদিনের সচেতনতামূলক কর্মকান্ডে সবাই এতটা অনুপ্রাণিত হবে আমি ভাবতেও পারিনি। ভাবার কথাও না।

ভাবতে না পারলেও বুঝতে পারলাম, মানুষের মনকে নাড়া দিয়ে অনুপ্রেরণা দিতে পারলে মানুষ অনুপ্রাণিত হয়। শুধু বক্তৃতা আর লেকচার দিলেই হয় না। যিনি বলবেন, তাকে করে দেখাতে হয়। যিনি শেখাবেন, তার নিজেকেও মাঠে নামতে হয়। নেতা যিনি, তিনি নিজে যদি না নামেন, তাহলে কর্মীরা নামেন না। আর সত্যিকারের নেতা তিনি, যিনি কর্মীদের চাইতেও জটিল এবং কঠিন কাজটি করেন। নোংরা হলেও করেন।

চায়ে শেষ চুমুক দিতে দিতে বললাম, কাল থেকে আমরা সবাই নিয়মিত অফিস ক্লিনিং করবো। প্রতিদিন অফিস শুরুর আগে মাত্র পাঁচ মিনিট করে পরিষ্কার করবো। ঘরে বাইরে সব জায়গায় করবো। যে যত বড়, সে তত বড় নোংরা জায়গাটি পরিষ্কার করবো। মন দিয়ে করবো। আমি যখন ঢাকায় আসবো, তখন টয়লেট পরিষ্কারের কাজটি আমিই করবো। অফিসের প্রধান বলেই করবো। নিয়মিতই করবো।

আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, নিজের কাজ নিজে করলে কেউ কখনো ছোট হয় না। বরং বড় হয়; বড় হবার সুযোগ তৈরি হয়। নিজের কাজ অন্যে এসে করে দিলে সে কখনোই বড় হয় না। বরং যে অন্যের কাজ করে দেয় সে নিজেই বড় হয়। অন্যের কাজ করে দেবার মধ্যে মহত্ত্ব আছে। আছে বড়ত্ব। বড় হবার প্রবল সম্ভাবনা। সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত হয়ে সমাজের জন্যে কাজ করে আমরা সেই সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলতে পারি। আর সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলাই হওয়া উচিত আমাদের প্রধান কাজ।

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com