হারানো শৈশব; কুড়ানো সেই সব!! (৪৯ তম পর্ব)
প্রকাশের সময় : 2019-02-14 15:48:14 | প্রকাশক : Admin
ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ একুশের অনুষ্ঠান হবে; আলম স্যার প্রধান আয়োজক। আমাকে দিয়ে রচনা লেখাবেন, আবার গানও করাবেন। দেশাত্মবোধক গান; সোনা, সোনা সোনা; লোকে বলে সোনা। সোনা নয় যত খাঁটি! কী সাংঘাতিক কথা! এ কাজ তো আমার নয়। হাঁসের বাচ্চা কুড়ামাখা খাবার দেখ্লে যেমনি ফ্যাসফ্যাস করে উঠে, আমি গাইলেও তেমনি শোনায়। গান আমার জন্যে নয়; চাইলেও আমি এই কাজ পারবো না। অবশেষে ঠিক হলো গান নয়, শুধু রচনা লিখবো।
এটাও স্যারের চাপিয়ে দেয়া। স্যারের কাজই ছিল সব সময় আমার উপর তাঁর সকল ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়া। এসব নিয়ে বিস্তর গল্প আছে। যা লিখে শেষ করা যাবে না। স্যারকে কোনদিন ডাক্তারী করতে দেখিনি; কিন্তু রোজ সন্ধায় বাজারের রুহুল ডাক্তার সাহেবের ফার্মেসীতে বসে থাকতে দেখেছি। রাত নয়টা অবধি থাকতেন। তাঁর জ্বালায় বাজারে তেমন ঘোরাফেরা করতে পারতাম না। পেঁচার চোখকে ভয় পেতাম না; কিন্তু স্যারের চোখকে ভয় পেতাম। বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ ফার্মেসীতে তলব। দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রেখে শেষমেষ এক কাপ মিষ্টি দুধ (আধা কাপ দুধ, আধা কাপ পানি) খাওয়াতেন। এভাবে খামাখা লম্বা সময় আটকে রেখে অবশেষে পেটে ছোট একটি গুতা দিয়ে বলতেন, ঘরে যাও। পড়াশুনা বাদ দিয়ে ঘোরাঘুরি করবে না। আমার অবাধ দুরন্তপনায় বাঁধা দেবার কারণে মনে মনে খুব রাগ হতো; কিন্তু কিছু বলতে পারতাম না। শান্তনা নিতাম এই ভেবে, যে স্যার দুধ খাওয়ায় তাঁর গুতা খাওয়াও ভাল।
হাসি আনন্দের সেই দিনগুলো আজ শুধুই স্মৃতির পাতায়! মৃত্যুর আগে আগে বেশ কাবু হয়ে গিয়েছিলেন। রোগশোকের ভারে শরীর একেবারেই থীতু হয়ে গিয়েছিল। চোখের সমস্যায় বড় রকমের কষ্টে ছিলেন। দেখতে পেতেন না একেবারেই। অবসর জীবনে সারাদিন বাড়ীতেই থাকতেন; পারতপক্ষে বের হতেন না। অবসর নিয়েছেন ২০০৭ সালে। এরপর থেকে বাড়ীর বারান্দায় বা উঠোন কোণে বসে আনমনে পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে তাঁর দিন কেটে যেত।
পুরো জীবনে বৈষয়িক অনেক কিছুই স্যারের ছিল না; কিন্তু দু’দুটো আদুরে মা আছে, যারা তাঁকে সন্তানের মত আদর দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে গেছে অবিরত। মাতৃসম এই দুটো উচ্চশিক্ষিত মেয়ের বাবা হয়ে ধন্য স্যারের জীবন। তারা দু’জনে সারাক্ষণ বুকের মধ্যে আগলে রেখেছিল তাদের শিশু বাবাকে। দু’জনেই বাবার পেশাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। শিক্ষক বাবার শিক্ষক সন্তান!! একজন কলেজের অধ্যাপিকা; অন্যজন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা।
যাই হোক। বলছিলাম রচনা লিখার কথা। রচনা লিখা তো আর চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। বিশাল ব্যাপার। প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। সমস্যা হলো বিষয়বস্তু নিয়ে। বিষয়বস্তু তো আর গরু কিংবা ছাগল নয় যে গোঁজামিল দিয়ে লিখে ফেলবো। একুশের উপর রচনা; অমর একুশে ফেব্র“য়ারী। রাত জেগে রচনার একখানা খসরা লিখে স্যারকে দেখালাম। গুড, ভেরী গুড। ভালই লিখেছো; বলেই স্যার কলম হাতে নিয়ে কাটাছেড়া শুরু করলেন। এভাবে আমার লেখা কাটাছেড়া করতে করতে আর তেমন রাখলেন না। ফেলতে ফেলতে শেষমেষ যা রাখলেন তাকে আর আমার নিজের লেখা বলার উপায় নেই।
তবে বলা বাহুল্য যে, গ্রামেগঞ্জে থাকলেও তখনকার দিনে স্যারদের মাঝে তীব্র জাতীয় চেতনাবোধ ছিল। জাতি গঠনে স্যারদের একাগ্রতা এবং প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। কেবল পড়াবেন তা নয়; রাষ্ট্র গড়ার ভবিষ্যৎ কারিগর বানানোই তাঁদের ব্রত ছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বই ছিল নবপ্রজন্মকে জাতীয়তাবোধ শেখানো; মনের গভীরে সেই বোধকে গেঁথে দিয়ে লালন করার উপায় বাতলে দেয়া। তাই প্রত্যন্ত গ্রাম হলেও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে দলমত নির্বিশেষে সমাজের সকলকে নিয়ে জাতীয় দিবস সমূহ পালিত হতো যথেষ্ঠ আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে। সবার মধ্যে দারুণ সাড়া পড়ে যেত। দিবসটি আগমনের ক’দিন আগে থেকেই আমাদের মধ্যে রিহার্সাল শুরু হতো। প্রতিদিন ক্লাশ শেষে রিহার্সাল। এক একটি রিহার্সাল যেন এক একটি অনুষ্ঠান। এভাবে একটি দিবসকে সামনে রেখে আমরা কয়েকটি দিবস এক নাগাড়ে উপভোগ করতাম।
আজকাল আর এসব নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তেমন আয়োজন আর করে না। করলেও গা ছাড়া গোছের। কেবল নিজেদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখে; সমাজের সকলকে নিয়ে করতে পারে না। আজকাল এসব দিবস পালিত হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হাটে, মাঠে কিংবা ঘাটে; দলগত ভাবে সবাইকে বিভক্ত করে। এক দলের অনুসারীরা অন্য দলের অনুষ্ঠানে যায় না। অনুষ্ঠান বলতে তেমন কিছুই না। মূল দিবস নিয়ে কথাবার্তা তেমন হয়না বললেই চলে। হয় দলের প্রথাগত গলাবাজি। এরপরই গানের অনুষ্ঠান। গ্রামেগঞ্জে এটাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বললেও শহরে নাম হয়েছে কনসার্ট।
কনসার্টে সাউন্ড সিষ্টেম থাকে; থাকে আলোর খেলা। দারুণ স্টেজ, দারুণ পারফরমেন্স। এরপরও দিবসটি জমে না। আমাদের সময়ে সে সব কিছুই ছিল না। কোনমতে একটি মাইক, একটি মাইক্রোফোন। স্টেজে হারমোনিয়াম আর তবলা। ব্যাস! দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতো। বক্তারা দারুণ বলতেন। পারফরমাররা দারুণ গাইতেন। গানে আর নাচে দেশপ্রেমের শিহরণ ছড়াতেন। শিহরণ ছড়াতেন একুশের চেতনা মনের গভীরে নাড়া দিয়ে।
একুশ মানেই ফুলের শ্রদ্ধাঞ্জলী। আমরা দলবেঁধে রাতের অন্ধকারে ফুল চুরি করতাম। গ্রামের দু’একটা বাড়ীতে ভাল ফুলের গাছ থাকতো। সে সব সাবার করতাম। বাড়ির মালিক দেখেও না দেখার ভান করতেন। দু’একটা খবিশ মালিকও ছিল। তবে সে সবে পাত্তা দিতাম না। চুরি করা ফুল হাতে খালি পায়ে সকালের প্রভাত ফেরীতে যেতাম। শিশির ভেঁজা পায়ে অবিস্মরণীয় কোরাস “আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী” গাইতে গাইতে শহীদ মিনারে ফুলের শ্রদ্ধাঞ্জলী দিতাম। সকলের মনের মনিকোঠায় জেগে উঠতো সালাম, রফিক, জব্বার আর বরকতের রক্তমাখা কাল্পনিক মুখ। একটা শোকময় নিস্তব্দতা নেমে আসতো চারদিকে। সবশেষে দলবেঁধে একুশের শপথ নিয়ে অনুষ্ঠানে যেতাম। আলম স্যার হতেন সে সব অনুষ্ঠানের মূল আয়োজক।
সেই আলম স্যার চির নিদ্রায় ঘুমিয়ে পরাতে ভালই হয়েছে! আজকের গ্রাম বাংলায় একুশ নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা সাধারণ মানুষের এমন উদাসীনতা আর অবহেলা তাঁর দেখতে হবে না। আজকের অবস্থা বড়ই করুণ। শহরে বসে এটা অনুমান করা কঠিন। বিভক্ত বাঙালী একুশের চেতনাকেও বিভক্ত করেছে। সার্বজনীন অনুষ্ঠান বলতে এখন কিছুই নেই। গ্রামেগঞ্জে একুশ মানে স্কুল ছুটি; ছুটির আমেজ। শহীদ মিনার নির্জনতায় ভোগে। বছর ছয়েক আগে কোন এক মিনারে ফুল দিতে যেয়ে স্কুল গেটের তালা খুলতে দেড়ঘন্টা অপেক্ষা করেছিলাম।
এখন একুশ মানে রাত বারোটায় টিভির সামনে বসা; টিভিতে লাইভ শহীদ মিনার দেখা। একুশ মানে আনন্দ, একুশ মানে জমিয়ে ফেসবুকিং। একুশ মানে বিকালে মনের মানুষকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া; হাতে হাত ধরে হাঁটা। একুশ মানে খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বাদাম খাওয়া; সাথের সংগীকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়া। একুশ মানে মান অভিমানের চেতনাকে জাগ্রত করা।
এসবের সংগে আলম স্যারের কাছ থেকে শেখা একুশের চেতনাকে মিলাতে পারি না। কোনভাবেই পারিনা। কঠিন ঘোরের মধ্যে পড়ে যাই। চারপাশ অন্ধকার দেখি; কেবলই অন্ধকার। নিকশ কালো ঘোর অন্ধকার। আর সেই ঘোরের মাঝেই ভেসে আসে আলম স্যারের সেই মুখ, সেই চাহনী। মনে পড়ে ছেলেবেলায় আমাকে লিখে দেয়া স্যারের সেই রচনার প্রথম ক’টি লাইন! জীবনে বহুবার একুশের বহু কথা শুনেছি! কিন্তু স্যারের মত এমন সুন্দর করে কাউকে কখনো বলতে শুনিনি! লিখতে দেখিনি!!
স্যার লিখেছিলেন, “আজ মহান একুশে ফেব্র“য়ারী! আজ থেকে ২৮ বছর আগে এইদিনে বাঙ্গালী জাতি মাকে মা বলে ডাকার অধিকার ছিনিয়ে এনেছিলো!” কী কঠিন লেখা! কী চমৎকার কথা! সত্যিই তো! একুশ আমাদেরকে মা ডাকতে শিখিয়েছে। না হলে উর্দূতে আম্মী ডাকতে হতো। আম্মীর চেয়ে মা ডাক কতই না মধুর! কতই না সুন্দর!! চলবে!!!