হারানো শৈশব; কুড়ানো সেই সব!! (৫০ তম পর্ব)
প্রকাশের সময় : 2019-02-28 15:05:42 | প্রকাশক : Admin
ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ সুন্দর করে ভাষা শেখাতেন, কথা বলতে শেখাতেন আখতার স্যার। কিভাবে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হয় স্যার সেটাও শিখিয়ে দিতেন। অশুদ্ধ বা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা স্যারের নীতি বিরুদ্ধ ছিল। তাঁর একটাই কথা। “গায়ের ভাষায় বল্, কিন্তু শুদ্ধটা বল্বি তো! ঠিক মত শিখ্বি তো! ছাত্রাবস্থায় শিখ্বি না, তো কবে শিখ্বি? যতক্ষণ স্কুলে থাকবি শুদ্ধ ভাষায় কথা বল্বি।” শুধু শুদ্ধ ভাষাতেই নয়, শুদ্ধ উচ্চারণেও স্যার খুবই সচেতন ছিলেন।
গাঁয়ের মানুষ হলেও স্যারকে অশুদ্ধ উচ্চারণে কখনো কথা বলতে শুনিনি। আমাদের এক ক্লাশ উপরের একজন বড়ভাই; চর এলাকায় বাড়ী। একটু টেনে টেনে কথার শেষে সুর দিয়ে কথা বলতেন। একদিন স্যার ধরলেন। আচ্ছা করে ধরলেন। খুব চেষ্টা করলেন শুদ্ধতা শেখাতে। ক্লাশ টেন এর বড় ভাই; স্কুলের মোষ্ট সিনিয়র ছাত্র। সাদা পাঞ্জাবী গায়ে আসতেন। স্যার যতই চেষ্টা করছেন তাকে শেখাতে; তিনি পারছেনই না। স্যার বলছেন, বল্, এখন থেকে আমি আর অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলবো না। ভাইটি বলছেন, ‘অহন্তে আমি আর অশুদ্ধ কথা কইতাম না।’
মহা মুশকিলের বিষয়। স্যার বলছেন, বল্! চিকেন এর বাংলা কি? ‘একেবারই সোজা স্যার; মুগামুগগী’; ভাইটার পটাপট উত্তর। সবাই হেসে কুটিকুটি। পাশের ক্লাশরুমে বসে আমরাও হাসছি। বার কয়েক চেষ্টা করেও আখতার স্যার ভাইটাকে মোরগ মুরগী বলাতে পারেননি। কী আর করা! স্যারও হাসা শুরু করেছেন। কিন্তু দমে যাননি। তখনকার দিনে টিভি দেখার সুযোগ ছিল না আমাদের। তাই স্যার বলতেন, শহরে যেয়ে সুযোগ পেলেই টিভি দেখবি। টিভি নাটকে শুদ্ধ উচ্চারণের চর্চা হয়। কথা বলবি শুদ্ধ উচ্চারণে, শুদ্ধ ভাষায়। একটা সুন্দর দেশ গঠনে এর কোন বিকল্প নেই।
বিকল্প যে আছে এটা স্যার জানতেন না। জানেন নির্মাতা মোস্তফা সারোয়ার ফারুকী এবং ভাইবেরাদারের দল। বর্তমান মিডিয়ার প্রায় পুরোটাই তার স্বগোত্রীয়রা নিয়ন্ত্রন করছে একচেটিয়া। তারা যত পারে অশুদ্ধ ভাষায় নাটক সিনেমা বানিয়ে জাতি গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করছেন। এই জাতি দীর্ঘ দিনে স্যারদের মত মানুষদের কল্যাণে যেটুকু শুদ্ধ ভাষা শিখেছিল সেটাও ভুলতে বসেছে। তবে জাতি যে গঠিত হচ্ছে না, তা নয়। গঠিত হচ্ছে। বেতাল জাতি গঠিত হচ্ছে। অকথ্য ভাষা, অসভ্য কিংবা ছেচড়া প্রেম, ইভটিজিং এবং লিভটুগেদারে ছেয়ে গেছে দেশ। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অশুদ্ধ ভাষায় একটি অশুদ্ধ জাতি তৈরী হচ্ছে।
আমাদের দেশের শুদ্ধতা সব জায়গাতেই ঝিমিয়ে পড়ছে। সব কিছুই যেন উলটপালট হয়ে যাচ্ছে। সাদা এপ্রোন পড়ার কথা ডাক্তারদের। সারা পৃথিবীর সব ডাক্তাররাই ডিউটিরত অবস্থায় পড়ে। পড়তে বাধ্য। ব্যতিক্রম কেবল বাংলাদেশে। সাধারণত আমাদের দেশের কোন হাসপাতালে যেয়ে ডাক্তারদের গায়ে এপ্রোন পাবেন না। এপ্রোন পাবেন মেডিকেলের সব শিক্ষার্থীদের গায়ে। কেবল যে কলেজে ক্লাশ চলাকালীন পাবেন তাই নয়; রাস্তাঘাটে, শপিংমলে সব জায়গায় পাবেন। ভর্তি হবার পর থেকে সেই যে পরা শুরু করে ইন্টার্নীর শেষ দিন পর্যন্ত পরে। ইন্টার্নী শেষ তো এপ্রোন পরাও শেষ।
আসলে আমাদের দেশে কোন কিছুর সিস্টেমটাই তৈরী হয়নি। আখতার স্যার যাই করতেন সিস্টেম মেইন্টেন করেই করতেন; পারফেক্টলি করতেন। অস্বাভাবিক কোন কিছু স্যার কিছুতেই সহ্য করতেন না। বিশেষ করে ছাত্রদের নকল করা কোনভাবেই বরদাস্ত করতেন না। ধলা হাই স্কুলের সমগ্র নকলবাজ শিক্ষার্থীরা দু’জন স্যারের ভয়তে থরথর করে কাঁপতো। একজন আখতার স্যার আর অন্যজন শফিকুল স্যার। দ্বিতীয় জন বাঘের বাচ্চা নয়; সাক্ষাত বাঘ। কাউকে ধরলেই বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়তেন।
শফিকুল স্যারকে ভয় করতো না এমন ছাত্রছাত্রী পুরো স্কুলে কেবল আমাদের কালে নয়, কোন কালেই ছিল না। শিক্ষার্থীগণ তাঁর ভয়তে ক্লাশে কাপড় ভিজানো ছাড়া আর সবই করতো। থরথর করে কাঁপতো। স্যারের হাতে কেউ পড়েছে তো শেষ। সব সময় তাঁর অবয়বে ছিল আলাদা একটা বিশেষ বৈশিষ্ট। যতনা রাগী মানুষ তিনি, তার চেয়ে ঢের রাগী এবং গম্ভীর মনে হতো। সমাজে তাঁর পরিচিতি ছিল শফিকুল বিএসসি হিসেবে।
অংক বিজ্ঞানে খুবই পারদর্শী একজন শিক্ষক। ভীষন পারদর্শী। সব কিছু খুবই চমৎকার করে বোঝাতেন। এক সময় ধলা ছেড়ে ঢাকার মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে চলে আসেন। বিদ্যায় গুণী এবং জ্ঞানী এই মানুষটি অকালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বহু আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও আজও তাঁকে সম্মানের সাথে স্মরণ করে এলাকাবাসী। বাড়ী গফরগাঁয়ে হলেও থাকতেন আমাদের স্কুলের বোর্ডিং এ। আর বিকেলে বসতেন বাজারের ফার্মেসীতে; আকরাম ডাক্তার চাচার সাথে।
ফার্মেসীতে বসে রোগীর রোগ কতটুক ধরতে পারতেন তা ছোটবেলায় না বুঝলেও এটা বুঝতাম যে নকল ধরায় তিনি ভারী ওস্তাদ। কিন্তু সব সময় ইচ্ছে করেই ধরতেন না। শুধু মুচকী হাসতেন আর এড়িয়ে যেতেন। দেখেও না দেখার ভান করতেন। নিজে বুঝতেন কিন্তু কাউকে বুঝতে দিতেন না। কিন্তু যেদিন ধরতেন বা যাকে ধরতেন, তার খবর করে ছাড়তেন। নকলের নাম জনমের তরে ভুলিয়ে ছাড়তেন।
ছাত্ররা নকল করতো ছকে বাঁধা কিছু কমন স্টাইলে। কেউ বইয়ের আস্তপাতা ছিঁড়ে নিয়ে আসতো। পরীক্ষার খাতার ভাঁজে পাতা রেখে দেখে দেখে লিখতো। খুব বেশী পরিশ্রম নয়। লেখার সময় শুধু সামনে পিছনে তাকানো ছাড়া খুব বেশী কিছু করা লাগতো না। আর কোন স্যারকে দেখলেই খাতা চেপে ধরে হাবাগোবা ভাবে বসে থাকলেই ব্যাস! আবার কেউ দুই হাতের তালু ভরে ফেলতো লিখে। দেখে মনে হতো, মেহেদী মাখা হাত; যেন বিয়ের বর। তবে নকলবাজরা বেশী ব্যবহার করতো হাইবেঞ্চ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর কাঠের বেঞ্চের উপর গুটিগুটি করে লিখে রাখতো।
একবার পাঞ্জাবীওয়ালা সেই ভাইটি আখতার স্যারের হাতে পরলেন। কঠিন পরা। পাঞ্জাবীর হাতার ভিতর সুতা দিয়ে বেধেঁ নকল নিয়ে এসেছেন। পাতার পর পাতা ছিড়ে নিয়ে এসেছেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে হাত দিয়ে একটু একটু টানেন আর হাতার ভিতর থেকে সুর সুর করে বের হয় নকল। বিষয়টি নজরে পড়লো আখতার স্যারের। আর যায় কোথায়। স্যার প্রথমে পাঞ্জাবীর হাতা গুটালেন। সব বের হয়ে এলো। হাতে বাঁধা পাতার পর পাতা। এরপর গা থেকে পাঞ্জাবী খোলালেন। প্রচন্ড শিহ্রিত হবার পালা; সারা গায়ে নকল পেঁচানো। নকলের কাগজে গায়ের গেঞ্জি ঢাকা পড়েছে।
শুরু হলো সন্দি বেতের বারি। পা থেকে গলা পর্যন্ত বারি। দু’হাতের পাতায়, পায়ের গোড়ালীতে সব জায়গাতেই। ভাইজান তো ওরে বাবা, ওরে মা বলে চিৎকার করেই যাচ্ছেন। কে শোনে তার কথা। আমাদের লেখা বন্ধ; পরীক্ষার হল নীরব নিস্তব্দ হয়ে গেছে। এক সময় স্যার থামলেন। বন্ধ হলো মাইর। স্যার কাঁপছেন। কাঁপতে কাঁপতেই বলছেন, বল, আর কোনদিন নকল করবো না; আমি প্রতিজ্ঞা করছি। শুদ্ধ করে বলবি। ভাইজান এদিক ওদিক তাকিয়ে জিহ্বায় ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলছে, আর জীবনেও নকল করতাম না, স্যার। কিরা কাইট্টা কইতাছি। আর মারুইন্না যে!
এ সবই আমাদের সেই আমলের কথা। এই আমলের শিক্ষার্থী তো ভাল, নকল করায় সহযোগীতা করে শিক্ষকের দল। তথাকথিত ভাল ভাল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরাও এই খাতায় নাম লিখেয়েছেন। আবার সিন্ডিকেট করে প্রশ্ন ফাঁসের ব্যবসায়ও নেমেছিলেন। যে শিক্ষকেরা জাতি গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত তারাই প্রশ্ন ফাঁস করে বেড়ান! ভাবা যায়! প্রায় প্রতিটি পরীক্ষায় তারা এই অপকর্ম করে জাতিকে প্রায় ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলেন। খুব করে মন চায়, প্রশ্ন ফাসঁকারী এইসব কুলাঙ্গারদের ধরে আখতার স্যারের হাতে তুলে দিতে।
বহু বছর পরে সেই মানুষটির সাথে গত বছর আবার দেখা। একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা। চলনে বলনে অবিকল সেই আগের মতই আছেন। কেবল বদলেছে বয়সের কারণে পোষাকের ধরন আর শরীরের গড়ন। কিন্তু একটুও বদলায়নি তাঁর ব্যক্তিত্বের আবরণ। সাংঘাতিক নিয়ম মেনে চলা মানুষ। নিয়ম ভাঙ্গেন না। জীবনটাকে চমৎকার একটা সিষ্টেমে বেঁধে নিয়েছেন, যে সিষ্টেমটা একটি জাতির জন্যে জরুরী। জাতি গঠনে এই সিস্টেমটা যেমনি প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আখতার হোসেন মন্ডল স্যারের মত প্রকৃত শিক্ষক। বড় প্রয়োজন। চলবে...