হারানো শৈশব; কুড়ানো সেই সব!! (৫৪ তম পর্ব)
প্রকাশের সময় : 2019-04-25 16:59:19 | প্রকাশক : Admin
ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ রেজাল্টের করুণ দশায় খুবই বিশ্রী একটা পরিস্থিতিতে পরে গেলাম। কাউকে মুখ দেখাবার অবস্থা নেই। ব্যাডাগিরি দেখাবার দিনও আর নেই। কারণে অকারণে হাবভাব মার্কা লম্ফ ঝম্ফ দেয়া শেষ; হামভরি ভাব দেখানোও শেষ। পরীক্ষায় খুবই খারাপ ফলাফলের কথাটা জানাজানি হতে সময় লাগলো না। চারিদিকে দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়লো। জের হলো খুবই ভয়াবহ। দিন সাতেকের মাঝে সবচেনা পৃথিবী অচেনা হয়ে গেলো। সবাই কেমন করে যেন তাকায়। সিনিয়রা তাকায় করুণার চোখে; আর জুনিয়ররা তাকায় অবহেলায়।
আবার স্বাভাবিক ভাবে কেউ আমার দিকে তাকালেও মনে হয় ভালো করে নয়, কেমন কেমন করে যেন তাকাচ্ছে। মানে, চোরের মনে পুলিশ পুলিশের মত অবস্থা। পরিস্থিতির আলোকে চলাফেরায় সতর্ক হলাম। খুব সাবধানে হাঁটাচলা শুরু করলাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে হাঁটি। সামনে পিছনেও তাকাই। বিশেষ করে স্যারদের সামনে যেন ভুলেও পড়তে না হয় সে ব্যাপারে বেশী সতর্ক থাকি। সচরাচর স্যারেরা যে রাস্তা ব্যবহার করেন, চলাফেরায় সে সব রাস্তা আমি এড়িয়ে চলি। রাস্তায় বহু দূর থেকে স্যারদের দেখতে পেলে তাড়াহুড়া করে রাস্তা বদলাই।
এসবের কারণে সারক্ষণ টেনশানেও থাকা লাগে। আর এমন টেনশান নিয়ে চলাফেরাও দায়। তবুও করতে হয়। বিশেষ টেনশান করতাম বিশেষ দু’জন মানুষকে নিয়ে। একজন তোফাজ্জল চেয়ারম্যান সাহেব। বালিপাড়া ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। প্রচন্ড শিক্ষানুরাগী কিন্তু ভীষন রাশভারী ধরনের মানুষ। সমাজের এক নাম্বার সম্মানিত মানুষ হলেও আমার প্রতি বেশ স্নেহশীল ছিলেন। তাঁর ছেলে মোশারফ আমার সহপাঠি। সেই ক্লাশ ওয়ান থেকেই আমরা সহপাঠি। এই সুবাদে তাঁর বাড়িতে আমার অবাধ যাতায়াতও ছিলো।
তারপরও ভয় পেতাম; খুব ভয় পেতাম। ভয়ে ধলা বাজারে তাঁর ফার্মেসীর সামনে দিয়ে যাওয়া আসা বন্ধ করে দিলাম। কখন তাঁর ডাক পড়ে এই ভয়েতেই বন্ধ করলাম। ফার্মেসীতে তিনি সকাল বিকাল নিয়ম করে বসতেন। তাঁর বড় ছেলে মোফাজ্জল ভাই এবং শংকরদাও বসতেন। আজকের শংকর ডাক্তার তাঁর এসিস্টেন্ট ছিলেন। তাঁর হাতেই তৈরী। তাঁর ফার্মেসীতে বসেই পল্লী চিকিৎসক হয়েছেন। শংকর দা বলতেন, এদিক দিয়া আর আইও না। যে রেজাল্ট করছো সামনে পরলে খবর আছে তোমার!
খবর তো থাকবেই। আমার খবর তিনি সব সময়ই রাখতেন। শুধু আমার খবর নয়, অনেকের খবরই রাখতেন। সাদা শুভ্রদাঁড়িতে লুঙ্গী পাঞ্জাবী পড়া মানুষটি বেশ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ছিলেন। পরিস্থিতির মোকাবেলা করাটা বেশ ভালভাবেই জানতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কঠিন পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছিলেন। এলাকার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন কিন্তু করতেন মুসলিম লীগ। এদিকে এলাকায় পাক মিলিটারি এলেই লোকজন তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিত। আশ্রয় দিতেন বলেই আশ্রয় নিত। আমরাও আশ্রয় নিয়েছিলাম অন্তত তিনবার।
কেবল আমাদের মত সাধারণ লোকজন নয়, মুক্তিযোদ্ধারাও তাঁর আশ্রয়ে থাকতেন। গোপনে সাহায্য সহযোগীতাও পেতেন। অন্যদিকে তিনি মিলিটারিদের ম্যানেজ করেও চলতেন। ধলা বাজারের রেলস্টেশনে একবগীর পাঞ্জাবী মিলিটারির ট্রেন এলেই তাঁর ডাক পড়তো। সবদিক তিনি ভালই সামলাচ্ছিলেন। একবার বিধি বাম। মিলিটারির সন্দেহের মধ্যে পড়ে গেলেন। বাড়ি থেকে ডেকে নিলেন বটে। কিন্তু আর ছাড়লেন না। ট্রেনে করে সোজা ময়মনসিংহ নিয়ে গেলেন।
এলাকায় রটে গেল তোফাজ্জল চেয়ারম্যান শেষ। মিলিটারিরা বেয়নেট দিয়ে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে মেরে ফেলছে। কেউ বলছে লাশ ফেলছে ব্রহ্মপুত্রে, কেউ বলছে বালিপাড়া বন্যার পুলের তলে। কিন্তু সঠিক হদিস কেউই দিতে পারছিলো না। দিচ্ছিল শুধু গুজব আর গুজব। এলাকার মানুষজনের মন খুবই খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপ মুক্তিযোদ্ধাদেরও। বাসায় আব্বাকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখেছি। কেঁদেছেন আম্মাও তাঁর জন্য। নফল নামাজ পড়ে দোয়া করেছেন।
কমবেশী সবাই দোয়া করেছেন। তিনিও দোয়া পড়ে পড়েই মিলিটারির জেরা মোকাবেলা করেছেন। পাঞ্জাবী মিলিটারির জেরা! কথায় কথায় ন্যাংটা করে জেরা করে। মানি মানুষের মান মারার জন্যে পাঞ্জাবীদের তুলনা হয় না। ময়মনসিংহের ক্যাম্পে নিয়ে তাঁকে এমনটা না করলেও বেশ হেনস্তা করা হলো। পানি ছাড়া কিছুই খেতে দেওয়া হয়নি মানুষটিকে। ভয়ভীতি দেখিয়েছে প্রচন্ড। বার বার বোঝার চেষ্টা করেছে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কোনরূপ সহযোগীতা আদৌ করেন কিনা। তিনি বলিষ্ঠ ছিলেন। স্বীকার করেননি। অগত্যা ছাড়া পেয়ে ধলায় ফিরে আসেন। সাত সকালে ট্রেণে তাঁকে ফিরতে দেখে এলাকাবাসী হাঁফছেড়ে বাঁচে। খুবই আনন্দিত হয়।
সামছু ভাইকে দেখে আমি সচারচার আনন্দিত হলেও ফলাফলের করুণ দশায় টেনশানেও পড়ে গেলাম। তিনি সাক্ষাৎ যম। সামনে পড়লে নিশ্চিত চিবিয়ে খেয়ে ফেলবেন। কঠিন একটা চোখ রাঙানী দিয়ে এমন ভেংচি দিবেন যার মোকাবেলা করার ক্ষমতা ঐ বয়সে আমার ছিল না। সদা স্বতঃস্ফূর্ত, হালকা পাতলা এবং লম্বা দেহের চরমাদাখালির সামছু ভাই। একজন খাটি এবং প্রকৃত শিক্ষানুরাগী। শুধু শিক্ষার প্রতি অনুরাগই নয়, শিক্ষার্থীদের পড়াশুনায় তিনি আঁঠার মত লেগে থাকতেন। যাকে যেখানে পেতেন, ধরে বসতেন। হয় আদর করতেন; না হয় শাসন। শুধু পড়াশুনার জন্যই করতেন।
আমার পরম শ্রদ্ধেয় এই মানুষটির মত এমন একজন শিক্ষানুরাগী মানুষ আমি আজতক সমাজে পাইনি। খুব জোর দিয়েই কথাটি বলতে পারি। একদিন রাস্তায় আমাকে পেয়ে তিনিও খুব জোর দিয়েই বললেন, কইলজাডা ফাইট্যা গেছে সরদার। তুমি এইডা কি করলা! এতডা অধঃপতন তোমার! তুমি ফেইল করলা! আমি মাথা নীচু করে রেখেছি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ মাথা নীচু করে দুই আঙুলের দু’টি নখ দিয়ে খোটাখুঁটি করছি।
সেদিকে তাঁর বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। রাগ তার বেড়েই চলেছে। এবার তিনি কুদানি মারা শুরু করলেন। কঠিন কুদানি, থেমে থেমে কুদানি। কিছুক্ষন বলেন, আবার থামেন। গ্যাপে গ্যাপে কুদানি দেন। দিয়ে আবার বলা শুরু করেন; শইল্ডা আমার জ্বলতাছে। মনডায় কয় একখান দেই। কইষ্যা একখান দেই। থাবরানি চিনো; ডেবরা হাতের থাবরানি। পাঁচটা আঙুল গালে সেটিং কইরা দেম। এমন জোরে কইষ্যা থাবরানি দেম যে চাপার দাঁত অর্ধেকটি মাডিতে পড়ে।
তিনি আর থামেননি। কথাগুলো বলেই হনহন করে চলে যান। ভাগ্য ভাল তিনি চলে গেছেন। না হলে এতক্ষণে আমার খবর হয়ে যেত। মাড়ির দাঁত গোনা শুরু করা লাগতো। ছোট্ট মানুষের ছোট্ট মাড়ি; ছোট্ট ছোট্ট দাঁত। দাঁতগুলোর কি হতো কে জানে! পুরো চাপাইতো খালি হয়ে যেত। চাপার দাঁত অর্ধেক হারিয়ে স্কুলে গেলে বুন্ধরা বলতো, “সামছু ভাইয়ের কর্ম বেশ; চাপাবাজের চাপা শেষ!”
সামছু ভাইয়ের হাত থেকে মুক্তি পেলেও আবারও পরীক্ষা নামক কঠিন বিভীশিখা থেকে মুক্তি পাইনি। রমজানের মাসব্যাপী লম্বাছুটির আগের দিন আবারও পরীক্ষার নোটিশ। ছুটি শেষে স্কুল খোলার পর পর ২য় সাময়িক পরীক্ষা হবে। অকস্মাৎ আবারো পরীক্ষার নয়, যেন জুলুমের খবর পেলাম। ঘরে বাইরে সব জায়গায় কেবল জুলুম আর জুলুম। বাইরে সামছু ভাইয়ের থাবরানি আর স্কুলে পরীক্ষার হয়রানি সহ্য করা আসলেই কঠিন।
কঠিন মোজ্জামেল স্যারও। কথাবার্তার ধরনে মায়া মমতা নেই। কথায় কথায় টিটকারি আর উপহাস। “সরদার সাহেব পরীক্ষাতো আবারো আইলো। এইবার কিন্তু দশের মধ্যে থাহনোই লাগবো। দশজনের একজনও কিন্তু খারাপ না। কী কও!” এমনি উপহাস করেই নির্দেশ দিলেন টিচার রুম থেকে চক আর ডাস্টার আনতে। আগে খুব ভালো লাগতো এই কাজটা করতে। ইদানিং ভালো লাগে না। খুবই বিব্রত লাগে; লজ্জা লাগে।
লজ্জিত ভঙ্গিমায় বিড়ালের মত পা ফেলে ফেলে চকডাস্টার নিয়ে টিচার রুম থেকে বের হতে যাবো। অমনি মাওলানা স্যারের ডাক। ঘুমচোখে মাথা নীচু করে বজলুল হক মাওলানা স্যার চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। মাথা আর উঠালেন না। নীচু করেই বললেন, “কানে ধইরা আমার পাশে খাড়া সরদার! শক্ত কইরা কানে ধর, আর প্রতিজ্ঞা কর। লজ্জার কিছু নাই। বেডা মাইনসের আবার লজ্জা কি। পরীক্ষায় ভালোমন্দ থাকেই। জীবনে মোডে একবার খারাপ অইছে। বারবার তো খারাপ হয় নাই। নেক্সট পরীক্ষায় ভালো ফল কইরা তুই আবার দেখাইয়া দিবি। পুরো একমাসের রোজার ছুটি। নয়মাসে একটা দেশ স্বাধীন হতে পারলে পুরো একমাসে তুই ঘুইরা দাঁড়াইতে পারবি না ক্যান!” চলবে...