নীরব বিপ্লব; স্কুল ফিডিং

প্রকাশের সময় : 2019-04-25 17:19:29 | প্রকাশক : Admin
নীরব বিপ্লব; স্কুল ফিডিং

বিভাষ বাড়ৈঃ বাইরে বিষয়টির আলোচনা খুব একটা নেই। সচেতন নাগরিক বলতে মানুষ যাদের চেনেন তাদেরও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে শোনা যায় না। গণমাধ্যমে যেন বিষয়টি অনেকটা উপেক্ষিত। অথচ নীরবেই এক প্রকল্প রীতিমতো পাল্টে দিচ্ছে দেশের প্রাথমিক শিক্ষার চিত্র। যার নাম ‘স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম বা কর্মসূচী’।

যেটি শুরুর পর শিশুদের মাঝে এক ধরনের উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। প্রভাবও যুগান্তকারী। খাবারের বিশাল আয়োজন নেই সত্যি। তবে আগে অর্ধেকেরও বেশি শিশু স্কুলে ঠিকমতো আসত না, আবার এলেও দুপুরের পর থাকত না। কিন্তু স্কুল ফিডিং কার্যক্রম চালু হওয়ার পর আজ ঝরে পড়ার পরিবর্তে দেশজুড়ে শিশুদের ধরে রেখেছে প্রিয় বিদ্যালয়।

সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করা শিশুদের একটি বড় অংশই তুলনামূলকভাবে দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। খোদ রাজধানীর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করা শিশুদের একটি বড় অংশের বসবাস বস্তিতে। আছে সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিকদের সন্তান। যাদের অধিকাংশই সকালে সন্তানকে ভাল কিছু খেতেও দিতে পারেন না। বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবারসহ সন্তানকে পাঠানোর মতো অবস্থা নেই অনেকেরই। বিনা মূল্যের নতুন পাঠ্য বই এমন লাখ লাখ পরিবারকে আশার আলো দেখাচ্ছে বটে কিন্তু বিদ্যালয়ে খাবারও শিশুকে ধরে রাখছে বিদ্যালয়ে।

দুপুর সোয়া ১টা। রাজধানীর বিজি প্রেস সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভেতরে বসে কথা হচ্ছিল শিশু আলফা ও রুমার সঙ্গে। পাশে তখন তার ক্লাসের সকল সহপাঠীরা খাবার নিয়ে রীতিমতো আনন্দ করছে। আলফা ও রুমার সারাদেশের প্রায় ৩০ লাখ বেশি শিশু শিক্ষার্থীর দুজন যারা স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম (এসএফপি) থেকে উপকৃত হচ্ছে। আলফা ও রুমা দুজনের বসবাস বেগুনবাড়ী বস্তিতে। তাদের বাবা চালান রিক্সা। মা বুয়ার কাজ করেন বিভিন্ন বাড়িতে। নিয়মিক স্কুলে আসো তোমরা? এমন প্রশ্ন খাবার খেতে খেতে শিশুরা বলছিল, ‘হ স্কুল কামাই করি না। স্যারেরা আমাগো স্কুলে এক বাক্স বিস্কুট দেয়। ওইয়া খাইয়া জল খাইলে আর ক্ষিধা থাকে না’।

শিক্ষকরা বললেন, খাবারের বিশাল আয়োজন নেই তা সত্যি। তবে স্কুল ফিডিং কর্মসূচীর কারণে আজ দারিদ্র্যপীড়িত সব শিশুকেই নিয়মিত স্কুলে দেখা যায়। আগে অর্ধেকেরও বেশি শিশু স্কুলে ঠিকমতো আসত না, আবার এলেও দুপুরের পর থাকত না। স্কুল ফিডিং কার্যক্রম চালু হওয়ার পর শিশুরা ক্লাসে নিয়মিত হয়েছে। আমরা সন্তুষ্ট। একে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা ও সরকারের যৌথভাবে পরিচালিত সবচেয়ে সফল কর্মসূচী বলে অভিহিত করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেল, কেবল এ দুটি স্কুলই নয়। অনেকটা নীরবেই এক প্রকল্প রীতিমতো পাল্টে দিয়েছে দেশের প্রাথমিক শিক্ষার চিত্র। সংশোধিত আকারে ২০১০ সাল থেকে কার্যক্রম শুরুর পর থেকে স্কুল এলাকায় শিশুদের মাঝে এক ধরনের উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। যার ফলে শিশুরা দল বেঁধে প্রতিদিন স্কুলে আসছে। শিশু শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ, শিক্ষার হার ও গুণগত মান ঠিক রাখা, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি শতভাগ নিশ্চিত করার উদ্যোগকে সামনে রেখে সফলতার সঙ্গে কাজ চলছে দেশের ১০৪টি দারিদ্র্যপ্রবণ উপজেলার ১৫ হাজার ৮০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

১৫শ’ ৭৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয়ে দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচীর আওতায় প্রতিদিন উচ্চ পুষ্টিমানসমৃদ্ধ এক প্যাকেট বিস্কুট পাচ্ছে লাখ লাখ শিশু শিক্ষার্থী। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীসহ দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় রীতিমতো বিপ্ল−ব সাধিত হচ্ছে স্কুল ফিডিং কর্মসূচীর সফল বাস্তবায়নের কারণে। যার সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ। নিশ্চিত হয়েছে- শিক্ষার্থীর শতভাগ ভর্তি, উপস্থিতির হার বেড়েছে আগের তুলনায় ১৩ শতাংশ পর্যন্ত। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার কমেছে, শিক্ষার্থীদের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে, শিক্ষার গুণগতমান উন্নত হচ্ছে।

দেশের প্রাথমিক শিক্ষার চেহারা পাল্টে দেয়া এ কর্মসূচীর গোড়াপত্তন ও বর্তমান সরকারের মেয়াদে কর্মসূচীর ব্যাপকতা সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী তাদের ইমারজেন্সি প্রোগ্রামের আওতায় ২০০১ সালে যশোর জেলায় অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে স্কুলে ফিডিং কার্যক্রম চালু করে। পরে যশোর জেলার অভিজ্ঞতা ইতিবাচক হওয়ায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচীকে তাদের নিয়মিত কান্ট্রিপ্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত করে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর তত্ত্বাবধানে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পরামর্শক দ্বারা সম্পাদিত সমীক্ষা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, যে সকল উপজেলাতে ফিডিং কর্মসূচী চালু আছে সে সকল উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার্থী ভর্তির হার, উপস্থিতির হার, প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপনীর হার, নন ফিডিং উপজেলার তুলনায় উল্লে−খযোগ্য হারে বেশি। এছাড়া ফিডিং উপজেলায় ঝরে পড়ার হারও নন ফিডিং উপজেলার তুলনায় কম। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী পরিচালিত সমীক্ষা বিবেচনায় নিয়ে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে অপেক্ষাকৃত দারিদ্র্যপীড়িত উপজেলাগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্কুল ফিডিং প্রকল্প গ্রহণ করে ২০১০ থেকে বাস্তবায়ন শুরু হয়।

ফিডিং কর্মসূচী বাস্তবায়নে এনজিও নির্বাচন, বিস্কুট ফ্যাক্টরি নির্বাচন, বিস্কুটের মান যাচাই করার জন্য নির্বাচন, মনিটরিং, প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য কাজে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী সহায়তা প্রদান করছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে প্রতি স্কুল দিবসে এক প্যাকেট করে উচ্চ পুষ্টিমানসমৃদ্ধ বিস্কুট সরবরাহ করা হচ্ছে। শিশুদের এ বিস্কুটে আছে, গমের ময়দা, চিনি, উদ্ভিদ ফ্যাট/ভেজিটেবল ফ্যাট, সয়া ময়দা। এছাড়া আছে প্রয়োজনীয় আয়োডিন যুক্ত লবণ, জিংক, লৌহ, বেকিং সোডা এবং ১৩ রকমের ভিটামিন। প্রত্যেককে বিশুদ্ধ পানি দেয়া হচ্ছে।

প্রধান শিক্ষক পুরো বিষয়টি তত্ত্বাবধান করেন। অন্যদিকে মনিটরিংয়ের জন্য রয়েছে একাধিক স্তরবিশিষ্ট ব্যবস্থা। মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, প্রকল্প অফিস, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী যৌথভাবে পরিদর্শনের মাধ্যমে প্রকল্পের কার্যক্রম মনিটরিং করছে। এছাড়া প্রকল্প অফিস পৃথকভাবে প্রকল্পের কার্যক্রম মনিটরিং করে, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর পৃথকভাবে মনিটরিং করে, জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নিয়মিত পরিদর্শনের মাধ্যমে প্রকল্পের কার্যক্রম মনিটরিং করেন।

জানা গেছে, সরকারী অর্থায়নে ৯৩টি উপজেলায় ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর অর্থায়নে ১১টি উপজেলায় শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন স্কুলে খাবার পাচ্ছে। যেসব স্কুলে খাদ্য কর্মসূচী চলছে, সেখানকার প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারাসহ সংশ্লিষ্টরা ব্যতিক্রমী এ কর্মসূচীতে সন্তুষ্ট। আর সুফল পাওয়ায় সকলেরই দাবি যে, দেশের প্রতিটি উপজেলাকে যেন ক্রমান্বয়ে এ কর্মসূচীতে নিয়ে আসা হয়।

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com