জাপান ঘুরে দাঁড়াতে চায়।
প্রকাশের সময় : 2019-05-23 19:28:20 | প্রকাশক : Administration
ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ চোখে রাজ্যের ঘুম। মজার ঘুম। বিমানবালা বুঝলো না। ডেকে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে গেল। ল্যান্ড করার আগে এমনই হয়। সবাই প্রস্তুতি নেয়। নামার প্রস্তুতি। আমায় ভীষন জেটল্যাগে পেয়েছে; চোখ খোলাই কঠিন। ইস্! যদি আর একটু ঘুমাতে পারতাম। চোখ মেলাই দায়। হালকা মেলে আড় চোখে জানালা দিয়ে দেখলাম বাইরের মেঘলা আকাশ। শো শো শব্দ ছাড়া নীচে তেমন কিছু দেখা যায় না। এক সময় প্লেনের চাকা খোলার শব্দও পেলাম। আর দেরী করলো না। দু’তিন মিনিটের মাঝেই শব্দ করে ভারী বিমানখানা রানওয়েতে অবতরণ করলো।
বসন্তের হালকা বাতাসের বিকেলে হানেদা এয়ারপোর্ট। খুব চেনা জায়গা, চেনা পরিবেশ আর বড় চেনা গন্ধ! মিষ্টি মিষ্টি প্রাকৃতিক গন্ধ। ট্রেন পেতে সময় লাগেনি। প্রশান্তের পাড় ঘেষে ট্রেন ছুটে চলছে টোকিও শহরের দিকে। ডান দিকে তাকালে সমুদ্র পরিষ্কার দেখা যায়। দেখা যায় বেশ খানিকটা দূরের ওদায়বা দ্বীপসিটির বড় বড় ইমারতসমূহ। এমনি প্রায় ২৩টি চমৎকার সুন্দর সিটি নিয়ে টোকিও মেগাসিটি। এই ওদায়বাতে বড় বড় টিভি চ্যানেলের স্টুডিওসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের অফিস। আছে বিশাল আয়তনের আন্তর্জাতিক এক্সিবিশন সেন্টার, বিনোদন পার্ক ইত্যাদি।
ওদায়বা ছোট কিন্তু অতি আধুনিক শহর; টোকিওর পাশ ঘেষে একেবারে সমুদ্রের মাঝে গিয়ে ঠেকেছে। ৩০ বছর আগে এই শহরের পুরো জায়গাটিও সমুদ্র ছিল। আধুনিক প্রযুক্তিতে টোকিও উপসাগরে বালু ফেলে গড়ে তোলা হয়েছে এই কৃত্রিম দ্বীপটি। এতে করে টোকিও মহানগরের আয়তন বেড়েছে। এবার আবারো এই শহরের পাশেই ওদায়বার সমপরিমান জায়গা নতুন করে বালু ফেলে ভরাট করা হয়েছে। সম্পন্ন হয়েছে নতুন আরো একটি দ্বীপ বানানোর কাজ। উদ্দেশ্য অলিম্পিক ভিলেজ বানাবে; নতুন দ্বীপে নতুন ভিলেজ। ২০২০ সনের টোকিও অলিম্পিকের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে টোকিও শহর।
১৯৬৪ সনে টোকিওতে প্রথম অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ৪৬ বছর পরে আবারো জাপানে অলিম্পিকের আসর বসবে। বিশ্ব দরবারে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অলিম্পিক আয়োজন হতে যাচ্ছে জাপানে। বিশ্বের সব দেশ কিংবা বড় সব শহরই অলিম্পিক আয়োজন করতে চায়। এটা প্রথমত বিশ্ব দরবারে একটা স্ট্যাটাস প্রদর্শন করার ব্যাপার। দ্বিতীয়ত এর সাথে বিশাল বানিজ্যও জড়িত। একদিকে কোটি কোটি ডলার খরচ করে শহরটিকে অধিকতর আধুনিক এবং উন্নত করা, অন্যদিকে মিডিয়ার কল্যাণে ৭০০ কোটি বিশ্ববাসীকে শহর তথা দেশটিকে নতুন করে চেনানো।
কোটি কোটি ডলার খরচ করে উন্নয়নমূলক কাজ করলে দেশের আভ্যন্তরীন অর্থনীতিও বেশ চাঙা হয়। অর্থ সঞ্চালনে গতি আসে, কর্মসংস্থান বাড়ে। এতে করে বেকারত্ব কমে আসে, রাষ্ট্রের অর্থনীতির ঝিমুনী ভাব কিছুটা হলেও দূর হয়। অনেকটা এই কারণেও জাপান গেল এক দশক ধরে বিশ^ দরবারে চেষ্টা করে আসছিল যেন অলিম্পিক আয়োজনটা দেশের কোন এক শহরে করতে পারে। প্রথমে চেষ্টা করেছিল জাপানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ওসাকাতে ২০১২ সালে করবে। অন্য রাষ্ট্রের সাথে প্রতিযোগীতায় তখন পেরে ওঠেনি। এরপর ২০২০ এর জন্যে চেষ্টা করেছে টোকিও অলিম্পিক নিয়ে এবং শেষমেষ সফল হয়েছে।
জাপান অলিম্পিকের আয়োজন করেছে ঘুরে দাঁড়াবার জন্যে। বিশাল আয়োজন, বিশাল পরিকল্পনা। ৫০ বিলিয়ন ডলার বা চার লক্ষ কোটি টাকা বাজেট দিয়েছে অলিম্পিক আয়োজনের অবকাঠামোসহ অন্যান্য ব্যয় মিটানোর জন্যে। বর্তমান বাংলাদেশের এক বছরের বাজেটের সমপরিমান এই অর্থ বরাদ্বই প্রমাণ করে কত বড় তাদের এই আয়োজন। টোকিও শহরের চারদিকের সার্কুলার ট্রেন লাইনের দুই পাশে গোটা বিশেক ৮০ তলা হাইরাইজ বিল্ডিং বানাবে। ৮০০ কিমিঃ দূরের ওসাকা সিটি থেকে টোকিও পর্যন্ত নতুন করে বুলেট ট্রেনের লাইন বসানো হবে। বর্তমানে আছে ঘন্টায় ৩২০ কিমিঃ গতিতে চলা বুলেট ট্রেনের লাইন। এর পাশে বসানো হবে ঘন্টায় ৬৫০ কিমিঃ গতির নতুন লাইন।
যতটুকু জেনেছি অনেকটাই বদলে যাবে বর্তমান টোকিওর চেহারা। অলিম্পিক সিটি হিসেবে কৃত্রিম দ্বীপ ওদায়বা সিটিতে গড়ে তোলা হবে অলিম্পিক ভিলেজ। এখানে ছোট বড় সব মিলিয়ে ৮০টি নতুন হোটেল বানানো হবে। কোনটিরই মান চার তারকার নীচে নয়। জাপান সম্পূর্ণ এক নতুন অলিম্পিক ভিলেজ উপহার দেবে বিশ্ববাসীকে। সবচেয়ে সুন্দর হবে এর উদ্বোধনী এবং সমাপনী অনুষ্ঠানের জন্যে প্রস্তাবিত স্টেডিয়ামটি। চারটি ৪০ তলা বিল্ডিং করা হবে চার কোণায়। আর এর মাথার উপর বানানো হবে লক্ষাধিক লোক বসার ক্ষমতাসম্পন্ন অত্যাধুনিক অলিম্পিক স্টেডিয়াম।
জাপানে ২০২০ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের পরের বছরই হবে প্যারাঅলিম্পিক। এর পরের বছর হবে শীতকালীন অলিম্পিক। ২০২২ সালে শেষ হবে অলিম্পিকের সর্বশেষ আয়োজন। এসব বিশাল বিশাল ইভেন্টের জন্যে ইতিমধ্যেই নানা আয়োজন শুরু হয়েছে। আয়োজন যেমনি বড়, সমস্যাও তেমনি কম নয়। অর্থ নিয়ে কোন সমস্যা না থাকলেও লোকবল নিয়ে জাপান কঠিন সমস্যায় আছে। এমনিতেই জাপানে কাজের লোকের সংখ্যা ফি বছরই হ্রাস পাচ্ছে। জন্মহার কমছে বলেই এর প্রভাব সব জায়গায় পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র কম, অফিস আদালতে লোকবল কম, এমনকি হাসপাতালেও রোগী কমে যাচ্ছে দিন দিনই। এটি এখন একটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে।
সবচেয়ে ক্রাইসিস হচ্ছে কনষ্ট্রাকশন শিল্পে। এর মধ্যে অলিম্পিক নিয়ে বিশাল কনষ্ট্রাকশন কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে বলে চারিদিকে নাই নাই রব উঠেছে। হিসেব করে দেখা গেছে মোট ১৪ লক্ষ লোকের ঘাটতি হবে পুরো প্রক্রিয়া সামাল দিতে। অন্য দেশ থেকে লোকবল এনে ঘাটতি মোকাবেলা ছাড়া সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। তাই সমস্যা সমাধান কল্পে প্রতি বছরে দুই লাখ করে ৭ বছরে মোট ১৪ লক্ষ শ্রমিক নিচ্ছে চারটি দেশ থেকে।
দুঃসংবাদ হলো প্রথমে বাংলাদেশসহ পাঁচটি দেশের নাম ঠিক হয়েছিল। এর মাঝে বাংলাদেশের নাম থাকলেও পরে বাদ যায়। গুলশান হলি আর্টিজানের সন্ত্রাসী ঘটনার পরে পাঁচ দেশের নামের তালিকায় বাংলাদেশের নাম রাখতে পারেনি জাপান সরকার। আমাদের সরকারের তরফ থেকে চেষ্টা হয়েছিল অনেক। কিন্তু শেষমেষ কুলিয়ে উঠতে পারেনি। পারলে একটা মহা সুযোগ তৈরী হতো বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্যে। কোটি কোটি টাকার বাৎসরিক রেমিটেন্সের প্রবাহ আসতো দেশে।
এসব দেখে শুনে এবং জেনে কিছুটা খুশী আর কিছুটা অখুশী ভাব নিয়ে সাত সকালে হোটেল চেকআউট করলাম। এবার ঢাকায় ফেরার পালা। আমার শোনিমকে ১৫দিন পরে কাছে পাবো এই খুশীতে আমি সাংঘাতিক রকমের একসাইটেড। টোকিও থেকে চীনের সাংহাই হয়ে কুনমিং এ আবার রাত্রি যাপন শেষে উড়োজাহাজে চেপে বসেছি। কুনমিং-ঢাকা মাত্র দু’ঘন্টার জার্নি। প্লেন ভর্তি যাত্রী। আমি কিছুটা ঝিমুনোর ভাব ধরে আছি আর শুনছি আশেপাশের যাত্রীদের কথোপকথন। প্রায় সকলেই ব্যবসায়ী। চীন থেকে মালামাল আমদানী করেন। চারদেশীয় সড়ক কিংবা রেলপথ চালু হলে এই সামান্য পথ প্লেনে করে যাবার দরকার হতো না। প্রয়োজন হতো না এত টাকার টিকেট কেনার। সবচেয়ে সুবিধে হতো মালামাল পরিবহনে। সময় এবং অর্থ দু’টোরই সাশ্রয় হতো। আন্তঃদেশীয় সহজ কানেকটিভিটির প্রয়োজনীয়তা সবাই উপলব্ধি করছিল। চীন, নেপাল, বাংলাদেশ এবং ভারত; চারদেশের মধ্যে তিনদেশ এ কাজ করতে এক পায়ে খাঁড়া।
বাকী কেবল বাংলাদেশ। ট্রানজিটের কথা উঠলেই বাংলাদেশে বেহুদা কথা শুরু হয়। রাজনৈতিক দল সমূহের কথা কী বলবো, পুরো বাঙালীর দেশপ্রেম উথলে উঠে। ট্রানজিট আসলে কী সেটা বুঝে হোক কিংবা না বুঝে হোক, বিশাল বিশাল বক্তৃতা কিংবা পরামর্শ দেয়া শুরু করে। দেশ গেল, দেশ গেল রব উঠিয়ে দেয়। সরকার আর কী করবে! তথাকথিত জনপ্রিয়তা রক্ষাকল্পে বিষয়টিকে ঝুলিয়ে দেয়। আর লোক দেখানো সিটিং, মিটিং এবং ইটিং করে সময় পার করে। দেখলে মনে হয় বাংলাদেশ ভাবছে; দেশের স্বার্থ নিয়ে সিরিয়াসলি কেবল ভাবছে আর ভাবছে!!
প্লেনে উঠার পর থেকে আমিও ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, কোনদিন কি চারদেশীয় সংযোগ সড়ক চালু হবে! কোনদিন কি উচ্চ আয়ের দেশ হবে! বাংলাদেশ কি পারবে কোনদিন অলিম্পিকের আয়োজন করতে! না পারুক, আশা করতে দোষ কি। অবশ্য বাংলাদেশে কোন কিছু আশা করাও ঠিক না। যে দেশে গরুর দুধ বিক্রি করতে হয় দ্বারে দ্বারে ঘুরে ঘুরে; অথচ মদ বিক্রি করতে ঘুরতে হয় না। এক জায়গায় বসে থাকলেই ক্রেতাগন চুপি চুপি কিনতে চলে আসে। সেই দেশে ভাল কোনকিছু আশা করা ভুল তো বটেই!!!