হারানো শৈশব; কুড়ানো সেই সব!! (৫৯ তম পর্ব)
প্রকাশের সময় : 2019-07-11 18:22:46 | প্রকাশক : Administration
ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ সিনেমা হলে গামছা দিয়ে বাঁধে নাই ঠিকই; কিন্তু খুব একটা খাতিরও করে নাই। ওরা তো খাতির করার মানুষ না। বেইজ্জত করার মানুষ। হলের ভিতর লাইট ম্যানের যে পাওয়ার তা সিনেমার ভিলেনেরও নেই। ওরা যা বলে তাই করে; তাই আইন। আর তাই ওদের কথা শোনা ছাড়া গতি নেই। লাইটম্যানের টর্চলাইটের পাওয়ার কম হতে পারে। কিন্তু হাম্বিতাম্বির পাওয়ার মোটেই কম না। বিশাল পাওয়ার। ইচ্ছে মত যখন তখন সিটের যে কোন সারিতে ঢুকে যায়। যে কারো সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। কুটুত কুটুত করে অন্ধকার হলে লাইট মারে আর বসা দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে টিকিটে সিট নাম্বার দেখে।
দেখে তো দেখে; পেঁচার মত করে দেখে। দেখা আর শেষ হয় না। পেছনের এই আমরা পর্দায় ছবিটি ঠিকমত দেখতে পারছি কিনা সেদিকে দেখে না। আমরা লাইটম্যানের কোমরে হাত দিয়ে একবার ডানে আর একবার বামে কিছুটা সরিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে সামনের পর্দায় ছবি দেখতে চেষ্টা করি। ছবি, মানে চলচ্চিত্র বলতে কথা! চলমান। চলমান চিত্র। চলতেই থাকে। একেকটা সিন চলে গেলে কি আর আসে! জীবনেও আসে না! আহারে সিনেমা! বড় সাধের সিনেমা!!
সিনেমা হলগুলোও ছিলো সাধের। পুরানো ঢাকার দুই একটা সিনেমা হল ছাড়া ঢাকার এমন কোন হল নেই যেখানে আমার পা পড়েনি। মধুমিতা থেকে অভিসার; গুলিস্থান, নাজ হয়ে বলাকা। কিংবা ছন্দ, আনন্দ হয়ে শাহিন, সাগরিকা আর গ্যারিসন; সৈনিক ক্লাবই বা বাদ থাকবে কেন! যাইনি এমন জায়গা নেই। হলগুলোকে তখন সকল শান্তির উৎস মনে হতো। মনে হতো এরচেয়ে আকর্ষনীয় জায়গা আর হতে পারে না। ভিতরে না ঢুকতে পারলেও হয়; শুধু সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেই শান্তি।
পড়াশুনার পাশাপাশি শান্তির এতসব বিনোদন চললেও কার্তিক স্যারের কড়া আদেশ; শুধু ছবি দেখলেই হবে না। ছবি তো রিক্সাওয়ালাও দেখে। রিক্সাওয়ালারা পড়ে না। তুই ছাত্র; তোর পড়াশুনাও আছে। কী অকাট্য যুক্তি। মননশীলতা বিকাশের জন্য চলচ্চিত্র কিংবা খেলাধুলাই যথেষ্ট নয়। পড়াশুনার পাশাপাশি নিয়মিত রোজকার পত্রিকাও পড়তে হবে। পত্রিকা বানাতেও হবে । সাহিত্য চর্চা করতে হবে। এ আবার কেমন কথা! সাহিত্যচর্চা না হয় বুঝলাম। পত্রিকা বানানো তো বুঝলাম না। পত্রিকা আবার বানায় কিভাবে! মাথায় ঢুকছেনা কিছুতেই।
স্যার বললেন, “ঢুকবে কিভাবে? মাথায় তো শয়তানি ছাড়া আর কিচ্ছু নাই! এর চেয়ে শুধু গোবর থাকলেও ভালো ছিল। ভালো হইতে পয়সা লাগেনা। তুই ভালো হয়ে যা তাড়াতাড়ি! শয়তানি ছাড়। স্কুলের লাষ্ট বছর। মোষ্ট সিনিয়র স্টুডেন্ট। ক’দিন বাদেই তো বিদায় নিবি। খুব ভালো একটা কাজ করে বিদায় নে। দেখার মত একটা কাজ কর। যেন জুনিয়ররা তোকে ফলো করে; তোর কথা মনে রাখে। মনে রাখে তোর স্কুলও। মানুষের মত মানুষ হিসাবে গড়ার এই হাইস্কুল!”
নেমে পড়লাম। স্যারের কথামত মনে রাখার মত ভাল একটা কাজে নেমে পড়লাম। যেমন তেমন কাজ নয়; পত্রিকা বানাবার কাজ। যেই সেই পত্রিকা নয়; দেয়াল পত্রিকা। দেয়াল পত্রিকা নামে যে পত্রিকা আছে, কিংবা পত্রিকা যে দেয়ালেও থাকে তা জানতামই না। পত্রিকা থাকে মানুষের হাতে কিংবা ঘরের টেবিলে। দেয়ালে আবার থাকে কিভাবে! এসব ভাবি আর গোছগাছ করি। স্যারের কথামত গোছগাছ করি।
দেয়াল পত্রিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর আকার। বড় আকারের পোস্টার সাইজের মোটা কাগজের পত্রিকা। যেটাতে ডিজাইন করে গোটাগোটা অক্ষরে সব খবরাখবর লিখে দেয়ালে ঝুলাতে হয়। পাঠক দেয়ালের কাছে এসে মাথা উঁচিয়ে উঁচিয়ে পড়ে। মুশকিল হলো, ধলা বাজারে এমন কাগজ নেই। গেলাম গফরগাঁয়ে। পাবার আশাতেই গেলাম। ওখানেও নেই। মহা মুশকিল। ময়মনসিংহ যাওয়া ছাড়া বোধ হয় গতি নেই। পরদিন কাচারি ট্রেনে চড়ে তাই করলাম। এবং পেয়েও গেলাম।
মহা ক্ষমতাধর কার্তিক স্যার আমাকেই সম্পাদক বানিয়ে দিয়েছেন। না মেনে উপায় নেই। সাংঘাতিক সম্মোহনী ক্ষমতা তাঁর। যা বলেন, তাই শুনি। এবং শুনলামও। মন দিয়ে একাই সবদিক সামলাচ্ছি। কালি, কলম; সংবাদ, সাহিত্য। সবই আমি জোগাড় করছি। তবে অনেক কিছু পেলেও সাহিত্য পাই না। কবিতা পাই। আধা ছন্দ মিলানো ছড়া টাইপের কবিতা। আর পাই এরওর কাছ থেকে মশকরা এবং টিটকারী। সাংঘাতিক বিরক্তিকর টিটকারী।
সারা পৃথিবীতে এই হাই স্কুল লেভেলে যত টিটকারি প্র্যাকটিস হয়, অন্য কোথাও তার সিকিভাগও হয় না। শব্দ করে ভেঙানো, জোর করে কাশি দেয়া, শ্লেং কথায় টিজ করা, কথা বিকৃত করে বিদ্রুপ করা। কী করে না! কেউ কেউ একা একা করে। কেউ কেউ আবার দলবেঁধে। যার পেছেনে লাগে তার সাথেই করে। লেগে তার জীবনটা নাভিশ্বাস করে ছাড়ে। পেছন থেকে কথা বলে ফিসফিস করে; আর হাসে খিটখিট করে।
আমাকে নিয়েও কম হাসেনি; কম করেনি। টিটকারি মেরে বলতো “পরতিকার সাংঘাতিক” যায়। “পত্রিকার সাংবাদিক” কথাটাকে বিকৃত করেই বলতো। বেশী বলতো আমার ক্লাশের বন্ধুরাই। ওদের কখনো বেশী আপন হতে পারিনি। এমনকি আজো পারিনি। ওদের কথা আমি গায়ে মাখিনি। কাজ করে গেছি নিজের মনে। মোটামুটি সব কিছু জোগাড় করে লিখতে বসেছি। পত্রিকার মুদ্রাকর মানে লেখকও আমি। দলিল লেখকের মত মাটিতে বসে ঘাড় নীচু করে লেখা শুরু করলাম। প্রতিদিন লিখতে থাকলাম।
সমস্যা হলো কোমর নিয়ে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পরেই কোমর ধরে যায়। বসা থেকে আর উঠতে পারি না। তবুও ক্ষান্ত হইনা। “ভালো কাজে ক্ষান্ত দিতে হয় না”; কার্তিক স্যারের কথা! ওই সময়ে হাতের লেখার খুব সুনাম ছিল আমার। আমার চেয়েও সুন্দর ছিলো ফারুকের লেখা। ফারুক ফার্ষ্ট বয়; আমার এক ক্লাশ জুনিয়র। তবে রাজি হয়নি বিধায় সাহস করে আমিই শুরু করেছিলাম।
শুরুটা মন্দ হয়নি। পরিবেশটাও সুন্দর ছিল। ধলা বাজারের বিশাল বড় বটবৃক্ষের তলা; ছুটির দিন। দূপুরের পরে লিখতে বসলাম। হালকা বাতাসের পাতা নড়ার শব্দে পুরো বৃক্ষতলাটাই ঝরঝর করে উঠতো। কিছুটা দুঃখ ঝরে পড়তো মনে। সমবয়সী কেউ ছিলো না পাশে। বয়সে বেশ সিনিয়র আনোয়ার ভাই ছাড়া আর কাউকেই পাইনি। আনোয়ার ভাই; মনোয়ার হোমিও হলের ডাক্তার সাহেবের বড় ছেলে। এখন বাংলা একাডেমিতে আছেন।
খুবই ভালো আঁকেন। চমৎকার আঁকেন। তিনি পাশে বসে প্রেরণা দিতে লাগলেন। ডিজাইন এবং কনটেন্টের ব্যাপারেও পরামর্শ দিলেন। তাঁর পরামর্শে দেয়াল পত্রিকার মোটামুটি একটা ফরমেট দাঁড় করিয়ে ফেললাম। সিদ্ধান্ত নিলাম কার্টুনও যাবে। তখনকার সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম কলামেই থাকতো রনবী’র বিখ্যাত কার্টুন “টোকাই”। তারই আদলে ভাবনা আসলো মাথায়।
আনোয়ার ভাই আমার ভাবনায় সায় দিলেন এবং খুবই চমৎকারভাবে এঁকে দিলেন আমার চাহিদা মোতাবেক কার্টুন। আঁকাআঁকিতে অসম্ভব প্রতিভাময় এই মানুষটির কল্যাণে একটা ফাটাফাটি অবস্থা হতে চললো। এই একটা কার্টুনই পুরো পত্রিকার মানটা বদলে দিলো। সম্পাদক হিসাবে সম্পাদকীয়তে আমার আর কিচ্ছু বলার নেই। যা বলার এখানেই বলে দিয়েছি। যারা বোঝার এখান থেকেই বুঝে নেবে।
আগে থেকেই নির্ধারণ করা দিনে কার্তিক স্যারকে নিয়ে দেয়ালে টানিয়ে দিলাম স্বপ্নের দেয়াল পত্রিকা। কাগজের চার কোণায় চারটা পেরেক ঠুকে দিলাম। জায়গাও পূর্ব নির্ধারিত ছিলো। ক্লাশটেন এবং টিচার রুমের ঠিক মাঝ বরাবরের বারান্দার দেয়াল। দফতরী ‘জীতেন দা’ কাউকেই কাছে আসতে দিচ্ছেন না। হেডস্যার উদ্বোধন না করা পর্যন্ত কেউ দেখতেও পারবে না। স্কুলে থমথমে ভাব। আতংকের থমথম নয়; খুশীর থমথম।
তৈয়ব স্যার এলেন। ফিতা কেটে উদ্বোধন করলেন। একনজর পত্রিকায় চোখ বুলাতে যেয়ে চোখ আটকে গেলো কার্টুনের দিকে। স্যার একবার কার্টুন দেখছেন; একবার আমায়। মুচকী মুচকী হাসছেন। মুচকী হাসছেন কার্তিক স্যারও। বিজয়ের হাসি। ধলা হাইস্কুলের ইতিহাসে প্র্রথম দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের মূল পরিকল্পনাকারীর হাসি। পত্রিকার নামটিও তারই দেয়া; “আলোর মিছিল”!! চলবে...