কবরী নয়, করবী

প্রকাশের সময় : 2021-05-05 14:10:59 | প্রকাশক : Administration কবরী নয়, করবী

দাউদ হায়দার: স্কুলের চৌকাঠ পেরিয়ে কলেজের করিডোরে দাপিয়ে বেড়াই। পড়ি ঢাকা কলেজে। বন্ধুদের সঙ্গে হরেক গুলতানি। সাহিত্য শিল্প নাটক সংগীত, বইমায়রাজনীতি ও সিনেমাও। পাক-ভারত যুদ্ধের আগে, ১৯৬৪ সালে, কলকাতার শেষ বাংলা ছবি সত্যজিৎ রায়ের 'মহানগর' বলাকায় মুক্তি। দর্শকের ভিড়, হুড়োহুড়ি, পুলিশের লাঠিচার্জ। ব্ল্যাকেও টিকিট উধাও। 

টিকিট পাইনি। হাপিত্যেশ। না পেলেও উপরি পাওনা ফজলে লোহানী, গোলাম মুস্তাফা, খান আতাকে দূর থেকে দেখি। পুলিশের সহায়তায় হলে ঢুকছেন। তখন সাপ্তাহিক সিনে পত্রিকা 'চিত্রালী'। রমরমা বাজার। পরের সপ্তাহে 'মহানগরের সাদা কালো ছবি' (স্টিল), বিশাল প্রতিবেদন প্রকাশিত। পড়লুম। ঘোলে কি স্বাদ মেটে? ছবি না দেখে?

প্রশ্ন জাগে তৎকালীন পাকিস্তানে (পূর্ব ও পশ্চিম) বাংলা-উর্দু ছবির নায়ক-নায়িকা স্বনামে আড়াল কেন? রহস্য কী? নায়িকার নাম জেবা, রেশমা, সুচন্দা, কবরী, শাবানা প্রমুখ। সুমিতা দেবী, সুলতানা জামান স্বনামে, নাদিম, রহমান, রাজ্জাকের পুরো নাম নয় কেন? মোহাম্মদ আলী, গোলাম মুস্তাফা, হাসান ইমাম, আনোয়ার হোসেন এবং আরও দুইচার জন অনীহা নন নাম প্রকাশে।

কবরীর নাম মিনা পাল। মিনা বা মিনা পাল শুনতে খুব কি মন্দ? ওই নামে অভিনেত্রীর শিরোপায় ভূষিত নয় কেন? মিনা পালকে জিজ্ঞেস করেছিলুম একবার। কলকাতায়। দৈবাৎ সাক্ষাৎ, নিউমার্কেট। কেনাকাটি করতে গিয়েছেন। উঠেছেন হোটেলে। আশ্চর্য হলুম, কবরীকে কলকাতার কেউ চিনতে পারেননি। দিব্যি ঘুরছেন। আড্ডা দিলুম।

আড্ডায় বললেন, 'না চিনতে পারায় খুব ভালো লাগছে। ইচ্ছে মতন এখানে ওখানে যাচ্ছি। বাজার-সওদা করছি। ঢাকায় বা বাংলাদেশে অসম্ভব।' বলি, লাল টিপে বেশ মানিয়েছে। কবরীর বদলে 'করবী' বললে মানানসই। অবশ্য খোঁপাও নজর কাড়ানিয়া। শুনে স্মিত হাসি। একটি মজার ঘটনা বলতে চাই। মার্জনা করবেন। এই বয়সে কিছু মনে করবেন না হয়তো।

আমাদের তরুণ কালের কেচ্ছা। কলেজে পড়াকালীন। অসভ্য কিছু না হলে বলুন। 'সুতরাং' দেখে কয়েকজন প্রেমে পড়লুম আপনার। ইচ্ছে হয়েছিল এফডিসিতে গিয়ে আপনাকে দেখব। এবার সশব্দে হাসি। 'প্রেমে পড়লেন, প্রেমিক চোখে দেখলাম না, সাহস হয়নি প্রেম নিবেদনের। ভীরু প্রেমিক সব সময়ই আমার অপছন্দ। ভীরু প্রেমিক অপৌরুষ।

ছবি দেখে অনেকেই প্রেমের চিঠি লিখেছেন, নাম থাকলেও ঠিকানা নেই। আচ্ছা, এইসব প্রেমিক বৌকে ভালোবাসে কী করে?' (সব বয়ানই যে হুবহু, নিশ্চয় নয়। কানে গেঁথে আছে যতটুকু। স্মৃতি কথা বিটলেমি করছে না হয়তো)। কথায়-কথায় বাংলাদেশের সিনেমার প্রসঙ্গ। কবুল করলুম, বহু বছর বাংলাদেশের সিনেমা হয়নি।

বাধা দিয়ে বললেন, খুব কি মিস করেন? না দেখার কারণ কী, আপনার সম্পর্কে জানি। আর কতকাল দেশ ছেড়ে থাকবেন? ঠিক, আমরা আপনাকে দেশে নিয়ে যেতে পারিনা। দোষ আমাদেরও। জানেন অবশ্যই, মূলে রাজনীতি। ধর্মান্ধ, মৌলবাদিতার বাড়ন্তে ছেয়ে যাচ্ছে দেশ। একটি অনুরোধ করছি, কখনও এইসব লিখবেন না আমাকে উদ্ধৃতি দিয়ে।

কথার পিঠে আরও কথা। মনের খেদ প্রকাশ করলেন। 'অশনিসংকেত'-এ সত্যজিৎ রায় আমাকেই প্রথমে নির্বাচন করলেন। কেন করেন। কলকাতায় আসতে বলেন। গিয়ে দেখা করি। কাহিনি কী, চরিত্র কী, বিস্তারিত বলেন। ওর স্ত্রী বিজয়া রায়ের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেন। ঢাকায় ফেরার পরে সত্যজিৎ বাবুর আর কোনো ফোন নেই। আমি ফোন করলে ব্যস্ততার কথা বলেন।

কিছুদিন পরে শুনি ববিতাকে নির্বাচন করেছেন। মন ভেঙে যায়। কবরী কিয়ৎক্ষণ চুপ। ঋত্বিকদার 'তিতাস একটি নদীর নাম' ছবিতে অভিনয় করে ধন্য, গর্বিত। শুটিং চলা কালে ঋত্বিক দা আমাকে ধমক দিয়ে বলেন- 'ওই মেয়ে তুমি বাংলাদেশের? বাংলার গ্রাম সম্পর্কে কিচ্ছু জানোনা। গ্রামের মেয়ে দড়ি, সুতো পাকায় হাঁটুর ওপরে শাড়ি পরে? হাঁটুর ওপরে কাপড় তোলে।' ঠিকই তো, ঠিকই বলেছেন।

লজ্জার মাথা খেয়ে কাপড় তুললাম। আসলেই ন্যাচারাল দৃশ্য, গ্রামগঞ্জে। খুব শিক্ষা হলো।" "ঋত্বিক দা আমার অভিনয়ে খুশি, মন্তব্য করেন, 'তুমি কবরী নও, করবী'। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর নন্দিনী।" মৃণাল সেনের কথা, 'তিতাস একটি নদীর নাম' দেখে 'অভিনেত্রীর নাম কবরীর চেয়ে করবী হলেই জুতসই। কবরীকে বললুম, এরপর দেখা হলে করবী সম্বোধন করব। দেখা হলোনা। চলে গেলেন। আফসোস।