ক্যাপ্টেন ডাঃ সিতারা বেগম: একাত্তরের রণাঙ্গনের সেবাদাত্রী

প্রকাশের সময় : 2022-11-23 14:40:46 | প্রকাশক : Administration ক্যাপ্টেন ডাঃ সিতারা বেগম: একাত্তরের রণাঙ্গনের সেবাদাত্রী

এ এক বঙ্গ নারীর গল্প। যিনি যুদ্ধ আর সেবাকে নিজ আত্মার অংশ করে নিয়ে দেশের সংকট সময়ে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। মনুষ্যত্ব আর সাহসিকতার অনন্য উদাহরণ এ নারীর নাম ডাঃ সিতারা বেগম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যাঁর নাম স্বর্ণখচিত হয়ে লেখা রয়েছে।

সিতারা বেগমের জন্ম ১৯৪৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলায়। বাবা মোঃ ইসমাইল পেশায় ছিলেন একজন উকিল এবং মা হাকিমুন নেসা পুরোদস্তুর একজন গৃহিণী। দুই ভাই এবং তিন বোনের মধ্যে সিতারা ছিলেন তৃতীয়। তার বড় ভাই মুক্তিযুদ্ধকালীন ২নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার বীর উত্তম এ টি এম হায়দার ও ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা এ টি এম সাফদার। সিতারা বেগম কিশোরগঞ্জ থেকে এসএসসি, হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। স্কুলে পড়াকালীন সময়ে সিতারা গার্লস গাইডের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এছাড়া ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হিসেবেও তার সুনাম ছিল।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ হলে সিতারা ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের আর্মি মেডিকেলে লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন। চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে দেশে যখন আন্দোলন সংগ্রাম চলছে, তখন তিনি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে দায়িত্বরত ছিলেন। ঐ সময় তার বড় ভাই হায়দারও সেখানে বদলি হোন এবং ৩নং কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের দায়িত্ব নেন।

যুদ্ধের মাত্র কয়েক দিন আগে ছুটিতে বাড়িতে আসেন সিতারা। এর কিছুদিন পর তাঁর ভাই ও ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসেন। ছুটি শেষ হলে ভাই যথারীতি ফিরে যান। কিন্তু কিছুদিন ছুটি বাকি থাকায় সিতারার আর ফেরা হয়নি। এসময় দেশে আনুষ্ঠানিক ভাবে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। কুমিল্লা কম্বাইন্ড মেডিকেল হসপিটাল থেকে বারবার সিতারাকে কর্মস্থলে যোগদান করার জন্য টেলিগ্রাম আসতে থাকে। এ সময় তাঁর বাবা মেয়েকে জয়েন করতে দিতে চাননি। তাই মেয়ের অসুস্থতার মিথ্যে খবর পাঠিয়ে দেন হসপিটালে। এদিকে কয়েক দিনের মধ্যেই এ টি এম হায়দার এবং তার কিছু বন্ধু মিলে কিশোরগঞ্জের মুসলিয়া সেতু উড়িয়ে দিলেন। এরপর কিছুদিন গ্রামেই ছিলেন মুক্তিসেনারা। তাঁরা গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার পরদিনই পাক বাহিনী ওই এলাকায় আকাশপথে হামলা শুরু করল।

যেহেতু হায়দার এবং সিতারা দুজনেই সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন, তাই তাঁদের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে পেতে পাক বাহিনীর খুব বেশি বেগ পেতে হতো না। আর একবার ঠিকানা পেয়ে গেলে পাক সেনাদের বাড়িতে হামলা করতে আর কতক্ষণ। এই ভয় থেকেই সিতারার পরিবার পার্শ্ববর্তী বড়বাগ গ্রামের এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সেখানে থাকাটাও ততটা নিরাপদ মনে হচ্ছিল না। তাই তাঁরা স্বপরিবারে পালিয়ে যায় নানা বাড়ি হোসেনপুর দরগা বাড়িতে। পাক হানাদারদের হামলার যে ভয়টা সিতারার পরিবার পেয়েছিল তা ভুল ছিল না। কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁদের ভয়কে সত্যি করে দিয়ে পাক সেনারা কিশোরগঞ্জে রেইড করে। শহরে লিফলেট ছড়িয়ে দেয় সিতারা ও তাঁর পরিবারকে ধরিয়ে দিলে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। এরপর নানা বাড়িতে থাকাটাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। কয়েকদিন আবদুল হামিদ সাহেবের (বাংলাদেশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট) বাসায় থেকে হায়দারের পরামর্শে পরিবারসহ ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সিতারা।

এ প্রসঙ্গে যুদ্ধ পরবর্তী এক সাক্ষাৎকারে সিতারা বেগম বলেন, “ভাইয়া দুটি ছেলের হাতে পেন্সিল দিয়ে লেখা একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠিতে তিনি আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য বলেন। বিশেষ করে আমাকে নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন-সেটাও উল্লেখ করেন। এ ছাড়া তাদের হাতে আমার জন্য একটা ছোট পিস্তলও পাঠিয়েছিলেন। নির্দেশ ছিল, যদি পথে কোথাও পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়ি, তাহলে যেন আমি সেই পিস্তল কাজে লাগাই। নিজেকে বাঁচাতে না পারি আত্মহত্যা তো করতে পারব। আমি ভাইয়ার পাঠানো সেই ছোট্ট পিস্তলটা ব্লাউজের ভিতর ঢুকিয়ে রাখতাম।”

এরপর যেই কথা সেই কাজ। পরদিনই অজানার পথে পাড়ি জমায় পরিবারটি। গুজাদিয়ার ঘাট থেকে সাত দিন, সাত রাত নৌকা পাড়ি দিয়ে সিলেট সীমান্ত দিয়ে টেকেরঘাট পৌঁছায় তাঁরা। সেখানে এ টি এম হায়দার তাঁদের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি তাঁর এক ভারতীয় বন্ধুর সহায়তায় একটি সিমেন্টের বস্তা ভর্তি পিকআপে পুরো পরিবারকে উঠিয়ে নেন। সেই পিকআপ তাদেরকে পৌঁছে দেয় বালাটে।

এরপরের গল্পটা আগরতলার বাংলাদেশ হাসপাতালের। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার উদ্দেশ্যে ২নং সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশারফ এবং ডাঃ জাফর উল্লাহ আগরতলার মেলাঘরে গড়ে তোলেন এ হাসপাতাল। মেডিকেলের শেষ বর্ষের কয়েকজন ছাত্র এবং ১০/১২ জন স্বেচ্ছাসেবী সেনাবাহিনীর সহায়তায় পরিচালিত হতো হাসপাতালটি। ডাঃ মবিন, ডাঃ ফারুক আহমেদ, ডাঃ জাফর উল্লাহ, ডাঃ নাজিমুদ্দিন প্রমুখ ব্যক্তিরা লন্ডন থেকে এ হাসপাতালে কাজ করেছেন। কাঠামোগত দিক দিয়ে হাসপাতালটির অবস্থা ছিল বেশ নাজুক। বাঁশের চারটি খুঁটির ওপর মাচা বেঁধে রোগীদের জন্য বিছানা তৈরি করা হতো। অপারেশন ঘরটি ছিল প্লাস্টিক দিয়ে ঘেরা। দিনের বেলাতেই কেবল সেখানে অপারেশন করা হতো। আর রাতে যদিও বা কখনো জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করা হতো সেখানে হারিকেন কিংবা টর্চলাইটই ছিল একমাত্র সহায়। তবুও যুদ্ধকালীন চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য আজ অবধি যে সকল হাসপাতাল গড়ে উঠেছে সেগুলোর মধ্যে ৭১’র মুক্তিযুদ্ধকালীন ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’ অন্যতম সফল একটি হাসপাতাল।

দুই নম্বর সেক্টরে আশ্রয় নেয়া কিছু মেডিকেলে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাত্রা শুরু করা এ হাসপাতাল পরবর্তীতে প্রায় ৪০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে পরিণত হয়। মূলত শরণার্থী শিবিরে থাকা মানুষ এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারাই ছিল এ হাসপাতালের প্রধান রোগী। এছাড়া ভারতীয় অনেক সেনা সদস্যও এখানে চিকিৎসার জন্য আসতেন।

চিকিৎসার সরঞ্জামাদি ও ঔষধপত্রের তীব্র সংকটের মুখে যখন হাসপাতালের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল সেই সময় ১৯৭১ সালের জুলাইয়ের শেষ দিকে হাসপাতালটির সিইও হিসেবে দায়িত্ব নেন সিতারা বেগম। তিনিই ছিলেন এ হাসপাতালের একমাত্র মহিলা চিকিৎসক। প্রায়ই রোগীদের ঔষধের জন্য আগরতলা ও উদয়পুরে যেতে হতো তাঁকে। নিজের অক্লান্ত পরিশ্রম, আন্তরিকতা ও ভালোবাসা দিয়ে যুদ্ধকালীন লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছিলেন এ নারী। তাঁর অসাধারণ নেতৃত্ব ও দায়িত্বশীলতা হাসপাতালটিকে অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এক আশ্রয় ঠিকানা করে তুলেছিল।

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। বাংলাদেশ হাসপাতালের রেডিওর মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয় ঘোষণা শুনতে পান সিতারা বেগম। দেশ স্বাধীন হলেও তাঁর দায়িত্ব যে তখনও শেষ হয়নি। তিনি তাঁর কয়েকজন অসুস্থ রোগীকে নিয়ে আসেন কুমিল্লা সিএমএইচে। সেখানকার লেডিস হোস্টেলে থেকে তাদের সেবা করেন। কিন্তু তাদের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হয়ে উঠে। তাই তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা সিএমএইচে তাদের ভর্তি করান।

স্বামী ও তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে সিতারা বেগম বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে বসবাস করছেন। তাঁর স্বামী ক্যাপ্টেন আবিদুর রহমানও একজন চিকিৎসক এবং তিনি ৩ নম্বর সেক্টরের হয়ে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার সিতারা বেগমকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করে।

এ কথা মনে হতেই পারে, যেই দেশের জন্য সিতারা বেগম এতটা আত্মত্যাগ করেছেন আজ কেনো তবে তিনি বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন? প্রত্যুত্তর হলো, দেশ মাতৃকার প্রতি তীব্র অভিমান। যে দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি ও তাঁর ভাই লড়াই করে গেছেন, সে দেশেরই কতিপয় পথভ্রষ্ট নরকীটের হাতে নির্মমভাবে তাঁর ভাই এ টি এম হায়দারকে ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর খুন হতে হয়েছিলো। সেই দুঃখবোধ আর তীব্র যন্ত্রণাকে সঙ্গী করেই সিতারা বেগম আজ পরদেশী হয়ে বেঁচে আছেন। - সূত্র: অনলাইন