আত্মমর্যাদাহীন ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ হোক

প্রকাশের সময় : 2023-05-31 11:48:02 | প্রকাশক : Administration আত্মমর্যাদাহীন ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ হোক

জুয়েল ত্রিপুরা: জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও আশীর্বাদে বিশ্ব আজ অভাবনীয় উন্নতির পথে চলেছে। প্রতিটি মুহূর্তে পৃথিবীর মানুষ হয়ে পড়েছে প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। তবে একদিকে যেমন উন্নতির চরম উৎকর্ষ ও সাফল্য দেখা যাচ্ছে, অন্যদিকে প্রতিনিয়ত মানবতার চরম অবক্ষয়ের রূপ দেখে চলেছে আধুনিক বিশ্ব।

একদিকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন, অন্যদিকে সেই প্রযুক্তির অপব্যবহারের দ্বারা মানবতার ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছে পুরো পৃথিবী। একদিকে ধনী যেমন আরো ধনবান হচ্ছে, অন্যদিকে দরিদ্র মানুষ ভিক্ষাবৃত্তির মতো পেশা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই চিত্র দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে। কেউ হয়তো মানবতার খাতিরে ভিক্ষা দেয়, কিন্তু ভিক্ষাবৃত্তি কোনো পেশা হওয়া উচিত নয়।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জন্য ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূল করা আবশ্যক। একজন ভিক্ষুককে দুই-পাঁচ টাকা নয়, বৃহৎ পরিকল্পনার আওতায় না আনলে মানবকল্যাণ সম্ভব নয়। বর্তমান সময়ে প্রচলিত হয়ে গেছে কাউকে এক মুষ্টি ভিক্ষা বা দান-খয়রাত করলে ভিক্ষাদানকারী মনে করে মানবকল্যাণ করেছি। কেননা, ভিক্ষা প্রদানকারী ব্যক্তি মানবকল্যাণকে পারলৌকিক মুক্তির উপায় হিসেবে মনে করে।

সাধারণত মানবকল্যাণ বা মানবতার স্বরূপ হিসেবে সবাই জানে দুস্থ, নিরন্ন, অবহেলিত, দুর্ঘটনায় বিপর্যস্ত মানুষকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। এই যে আমরা মানবকল্যাণ বলে জেনে এসেছি, তা কি যথার্থ মানবকল্যাণ? না, এসব মানবকল্যাণের নামে মানবতাকে স্রেফ অবমাননা করা। কারণ মনুষ্যত্ববোধ আর মানবীয় মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় এতে, যা বাস্তবে অনুগৃহীতের আত্মমর্যাদাকে অসম্মান করাই বোঝায়। কারণ যে ভিক্ষা করে, তার মধ্যে কখনো আত্মমর্যাদা গড়ে ওঠা সম্ভব নয়।

বস্তুত, ‘মানবকল্যাণ’ শব্দটিকে বৃহৎ অর্থেই বোঝানো হয়ে থাকে, যার মানে হলো পুরো বিশ্বের মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করা। অনুগ্রহপ্রার্থী বা ভিখারির সামাজিক মূল্যবোধকে স্বীকার করে কল্যাণকর্ম হিসেবে বৃহৎ কর্মসূচির দ্বারা ব্যক্তি কিংবা সামষ্টিক সমগ্র জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার আওতায় নিয়ে আসার মধ্যেই ‘মানবকল্যাণ’ শব্দের সার্থকতা।

শুধু গুটি কয়েকজনকে ভিক্ষাদান কিংবা সাহায্য প্রদান করাকে মানবকল্যাণ বলা যায় না। ‘জাতির বিবেক’ নামে খ্যাত আবুল ফজলের (১৯০৩-১৯৮৩) লেখা ‘মানবকল্যাণ’ প্রবন্ধে মানবকল্যাণ অর্থের ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন এভাবে, ‘মানবকল্যাণ অর্থে আমি দয়া বা করুণার বশবর্তী হয়ে দান-খয়রাতকে মনে করি না। মনুষ্যত্বের অবমাননা যে ক্রিয়াকর্মের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি, তাকে কিছুতেই মানবকল্যাণ নামে অভিহিত করা যায় না। মানবকল্যাণের উৎস মানুষের মর্যাদাবোধ বৃদ্ধি আর মানবিক চেতনা বিকাশের মধ্যেই নিহিত।’

প্রবন্ধটিতে তিনি মানবকল্যাণের যথার্থ ও সার্থক উদাহরণটা দিয়েছেন এভাবে ‘একদিন এক ব্যক্তি ইসলামের নবির কাছে ভিক্ষা চাইতে এসেছিল। নবীজি তাকে একখানা কুড়াল কিনে দিয়ে বলেছিলেন, এটি দিয়ে তুমি বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা রোজগার করো গে। এভাবে নবিজি লোকটিকে শুধু স্বাবলম্বনের পথ দেখাননি, সেই সঙ্গে দেখিয়ে দিয়েছিলেন মর্যাদাবান হওয়ার, মর্যাদার সঙ্গে জীবযাপনের উপায়ও।’

ভিক্ষাবৃত্তি ও ভিক্ষাদান প্রসঙ্গে নিরুৎসাহিত করার জন্য বাস্তবিক জীবনধারায় এসে মানবতার সেবার জন্য মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। তবে শুধু ব্যক্তি-মানুষ বাস্তব মানবকল্যাণে অংশগ্রহণ করলে ভিক্ষাবৃত্তি ও ভিক্ষাদান নিরসন হবে না। ভিক্ষাবৃত্তি রোধে সমাজ ও দেশকে এগিয়ে আসতে হবে। এ বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান রাখতে পারে রাষ্ট্র।

কেননা, আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক, যেখানে জনগণের মূল্য সর্বাধিক। জনগণকে সামনে রেখে যদি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দ্বারা নিজস্ব নীতিমালা, কর্মসূচি ও অর্থায়নের মাধ্যমে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা যায়, তাহলে ‘ভিক্ষাবৃত্তি’ নামক মানবকল্যাণ নামে অবমাননাকর শব্দটির ব্যবহার ও পেশাদারিত্ব কমে আসবে।

তাছাড়া জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম ও কর্মসূচির মাধ্যমে ভিক্ষাবৃত্তি ও ভিক্ষাদানে নিরুৎসাহিতকরণ সম্পর্কে জ্ঞান প্রদান এবং সচেতনতা তৈরিতে উদ্যোগ নিলে নিশ্চয়ই একদিন আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ ভিক্ষুকমুক্ত দেশ বলে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। - ইত্তেফাক