করোনা দিনের ডায়েরি...
প্রকাশের সময় : 2020-09-17 17:22:06 | প্রকাশক : Administration

২য় পর্ব
ঠিক দূপুরের আগে আগে। লম্বা নেট মিটিং শেষে বিশ্রামের সময়। চোখ বুঝে বিশ্রামের চেষ্টা করছি। বিছানায় গা এলিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্নভাবে বিশ্রাম নেয়া। হালকা তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘুম সবসময় খুব মজার হয়। গভীর ঘুমও সাধারণত এতটা মজার হয় না। বসে বসে কিংবা খাটে হেলান দিয়ে শর্ট টাইমে চমৎকার মজার একটা ঘুম দেয়া যায়। বিছানা বালিশ লাগে না। অবশ্য বালিশ হলে জমে ভাল। মজার মাত্রা পোক্ত হয়। তবে আজ মজাটা পোক্ত হয়নি। বেশীক্ষণ মজা নিতে পারিনি। আচমকা খুব কাছের একজনার ফোনে জেগে উঠি।
মানুষটা সচরাচর ফোন দেয় না। তবে টেক্সট চালায়। যোগাযোগটা সাধারণত ফোনে বা ভয়েজে হয় না। হয় নানান অ্যাপসের টেক্সট মেসেজেই। মেসেজ শুরুই করে অদ্ভুত ভাবে। জাইগ্যা থাকলে চুপ মাইরা থাইক্যেন না। জবাব দিয়েন। এটা তার কমন কথা। খুবই কমন কথা। আমি অনেকের জবাব না দিয়ে পারি। তারটা পারি না। জবাব আদায়ের কঠিন ক্ষমতা রাখে মানুষটা। আজ সেই মানুষটাই ফোন দিলো। হঠাৎ করেই ফোন। ফোনের ধরণটাও হন্তদন্তের মত। মানে, হাপাহাপির। কাঁপাকাঁপি গলায় হাপাহাপির ফোন।
আমরা তো শেষ ভাইজান!
শেষ হলে কথা বলছো কিভাবে?
কোমা থেকে বলছি। বলতে পারেন অবচেতন মনে।
কোমায় গেলে কিভাবে?
করোনা ঢুইক্যা পরছে ভাইজান। কয়েক হাজার মইরা শেষ। হাসপাতালে জায়গা নাই। আজিমপুরের কবরও ফুল।
সর্বনাশের কথা। বলো কি!!
না জানার ভান কইরেন না, ভাই। বাঁচোনের পথ বলেন। খালি “করেন তাই, করেন তাই” বইলেন না!
এটা আবার কী কথা?
এটাই এখন দেশের কথা। সরকারের কথা। সরকার তো খালি ঐ দুইটা কথাই কয়। “করেন তাই আর আইছো লোচন”!
দেখতে শুনতে মানুষটাকে মজার মানুষ মনে হয় না। তবে ভেতরে কঠিন মজার। অতীব কষ্টের মাঝেও হাসতে পারে, হাসাতে পারে। আজ হাসছে না একটুও। শুধু ঝাড়ছে। মনের মধ্যে পুষে রাখা কঠিন রাগ ঝাড়ছে। রাগটা পুরোপুরি সরকারের উপর। ইতালী থেকে আসা রেমিটেন্স যোদ্ধাদের ঢাকা এয়ারপোর্টে মিসহ্যান্ডেলিং করতে দেখে সে বেজায় ক্ষেপেছে। ক্ষেপারই কথা। কোয়ারেন্টাইন এবং আইসোলেশনের নামে আশকোনা হ হজ্জক্যাম্পে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে রেখেও যাঁরা এক বক্স খাবার দিতে পারে না; সামান্য পানি দেবার জন্যেও যাদের সচিব পর্যায়ের মিটিং বসাতে হয়, তাঁদের উপর ক্ষেপাটাই তো স্বাভাবিক।
তবে ক্ষেপলেও মজা করতে ছাড়ছে না। সদ্য চালু হওয়া নতুন শব্দ দুটো নিয়েই মজা করছে। করোনা ভাইরাস আসার পরে বাংলার মানুষ খুব ভাল করেই এই নতুন শব্দ দুটো শিখেছে; কোয়ারেন্টাইন এবং আইসোলেশন। মানুষের মুখে মুখে। টিভি মিডিয়া ভরে গেছে শব্দ দুটোতে। অর্থ বুঝুক বা না বুঝুক। মানুষের মুখে মুখে ফিরছে শব্দ দুটো। কোথায়ও বা সঠিক উচ্চারণে, কোথায়ও বা না বুঝে কিছুটা বিকৃতভাবে। তবে সে বুঝেশুনেই বিকৃত করছে। মশকরা করার জন্যেই করছে।
মশকরা করাটা দোষের নয়। প্যানিক সিচুয়েশনে হালকা মশকরা বরং প্যানিক রিলিজ করে; এনার্জি দেয়। কিন্তু গুজব তো কিছুই দেয় না। গুজব নিজেও ছড়ে এবং প্যানিকও ছড়ায়। করোনা যুগে গুজব মানুষের সব শান্তি আর ঘুম কেড়ে নিয়েছে। গুজবীয় রূপের প্রথমটা হলো, বাংলাদেশে হাজার হাজার করোনা রুগী আছে। হাসপাতালগুলো রুগীতে ভরে গেছে। কিন্তু সরকার স্বীকার করছে না। গোপন করছে। একজন আরেকজনকে এমনই তথ্য দিচ্ছে আর সবাই বিশ্বাস করে অন্যজনকে পাস দিচ্ছে। সত্য মিথ্যে যাচাই করছে না। এই মানুষটিও করেনি।
দেশে তো মানুষ মইরা সাফা হইয়া যাইতাছে!
ছাফা হয়ে যাচ্ছে? সংখ্যায় কেমন হবে?
রাখেন আপনার সংখ্যা! গোণার কায়দা আছে নাহি!
বলো কি?
হুনলাম! নিজের কানে হুনলাম। আমার নিকট আত্মীয় বললো। বড়ই নিকট আত্মীয়।
তোমার নিকটাত্মীয় নিজে দেখেছে কি? তুমি দেখেছো? মানে তোমার আশপাশে কেউ কি মারা গেছে!!
না, মানে আশপাশে না। তবে ভাই, গেছে। নিশ্চিত মারা গেছে। সরকার সব খবর ধামাচাপা দিতাছে। কেউ যাতে জানবার না পারে।
করোনা কি বেছে বেছে আওয়ামীলীগার ধরছে? মানে সব রুগীই কি আওয়ামী লীগ করা লোক? হাসিনা ভক্ত! সরকারকে বাঁচানোর জন্যে তথ্য গোপন করছে! করোনা কী বিএনপি জামাত করা লোকদের আক্রমণ করছে না? করার তো কথা। আবার তাদের হাতেও তো ফেসবুক আছে। তারা চেপে যাচ্ছে কেন? সারাদিনই তো তারা সরকার বিরোধী পোস্ট দেয়। করোনায় মৃত্যুপ্রমাণ দিয়ে পোস্ট দেয় না কেন?
মানুষটি সাধারণত দমার পাত্র না। এখন একটু দমলো মনে হলো। দমার লক্ষণটা পজিটিভ। মেজাজ নিম্নগামী। ঠান্ডা মেজাজে পরিশীলিত শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে। কথার ধরণই বলে দিচ্ছে তার মেজাজ এখন আর চড়ায় নেই। সরকারের উপর ক্ষোভ ততটা নেই। স্কুল কলেজ বন্ধের নোটিশে সে খুশী। এককেন্দ্রিক করোনা নিয়ন্ত্রণ কক্ষেও খুশী। প্রধানমন্ত্রীর তড়িৎ সিদ্ধান্ত তাকে বরাবরের মতই আপ্লুত করেছে।
কিন্তু সে মোমেন সাহেবকে কিছুতেই মানতে পারছে না। না মানার কারণ পরিস্কার। নিজে ৩২ বছর প্রবাসে থেকে প্রবাসীদেরকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন সাহেব এ কী বললেন! তিনি কেবিনেট মেম্বার। সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছেন। যার একটা কথায় দেশে লক্ষটা আউলা লাগতে পারে, তাঁর তো মেপে কথা বলা উচিত। মুখের তো একটা লাগাম থাকা দরকার। অদৃশ্য লাগাম।
লাগাম থাকলে তিনি ভুলেও বলতেন না যে, দেশে ফিরলেই প্রবাসীরা নবাবজাদা হয়ে যান। কী সাংঘাতিক এবং জঘন্য রকমের কথা। নবাবজাদা শব্দটা তো একটা জঘন্য রকমের গালি। প্রায় দুইকোটি প্রবাসীকে ঠাস করে সেই গালিটি দিয়ে দিলেন! নিজেকে নবাব মনোভাবাসম্পন্ন মানুষেরাই সাধারণত এমন গালিটা দেন। আমজনতাকে প্রজা ভেবে রাজাগিরী করা মানুষদের পক্ষেই এটা সম্ভব। তাদের কখনোই হিতাহিত জ্ঞান থাকে না।
এবং মনেও থাকে না যে, এ রকম হাজারো নবাবজাদার ঘাম, শ্রমের বিনিময়ে পাঠানো রেমিট্যান্স নিয়েই আমাদের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা রাজাগিরী করেন। এই নবাবজাদারা ২০১৯ সালে দেশে পাঠিয়েছে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। হাজারো কষ্ট লুকিয়ে এভাবে দেশের অর্থনীতি সচল রাখেন এই প্রবাসী ভাইগুলো। দেশে থেকে দেশকে দুর্নীতির আখড়া হিসেবে গড়ে তুলেন না। জীবন-যৌবনের বেশিরভাগ সময় বিদেশ বিভূঁইয়ে কাটিয়ে দেশকে গড়ে তুলেন। পরদেশে গিয়ে টাকা কামাই করে পরিবার চালান। সরকারি বেতন ভোগ করে সব ধরনের সুবিধা তারা নেন না। শুধু দেশকে দিয়েই যান; দেশকে বড় ভালবাসেন।
হয়ত এ জন্যেই বিশ্বে যখন মরণাতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে তখন হয় বাঁচার জন্যে, না হয় শেষ নিঃশ্বাসটা দেশের মাটিতে ত্যাগ করার জন্যে ছুটে আসেন দেশে। তারপরও ইতালি-ফেরত এক প্রবাসী যখন বলেন ‘ফাকিং বাংলাদেশ’, তখন তাকে ঘৃণা জানাই। একইসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, প্রবাসীরা দেশে এলে নবাবজাদা হয়ে যান, তখন সেটাও আমাদের বড়ই কষ্ট দেয়। প্রবাসীরা পরের পয়সায় ফুটানি করেন না; নবাবীও করেন না। দুই-তিন বছর পর দেশে এসে একমাস যদি নিজের পয়সায় নবাবী করেনও, তখন তাদের কটাক্ষ করার অধিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর থাকে না। বিরক্ত হবারও কিছু থাকে না।
কিন্তু এসবে আমাদের মন্ত্রী সাহেব বড়ই বিরক্ত তাদের উপর। তাদের দোষ তারা দেশে ফিরেছেন। দেশে তো তিনিও ফিরেছেন! তিনি ফিরেছেন মন্ত্রী হবার জন্যে। আর তারা ফিরেছেন জীবন বাঁচানোর জন্যে। তাঁদেরকে শুধু শুধু অপবাদ দিয়ে কী লাভ? তাঁরা ফাইভস্টারের খাবার খেতে আসেননি। চাইতেও আসেননি। কয়েক ঘন্টা কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্পে থাকার সময় শুধু এক বোতল পানি আর চারটা ডালভাত চেয়েছিলেন।
সেটা দিতে পারেননি, পেরেছেন দিতে গালি। তাঁরা খাবার না পেয়ে উত্তেজিত হয়েছে, মাথা গরম করেছে। কিন্তু আপনি মাথা গরম করলেন কেন? আপনি তো সারাক্ষণ এসিতে থাকেন। আপনার মাথা গরম হতে পারলে, মুখ দিয়ে বেফাস কথা বেরুতে পারলে, এসিবিহীন গরমে থেকে তাঁরা দু’একটা বেতাল কথা বলতেই পারেন। তারা মরণের দুয়ার থেকে দেশে ফিরেছেন। তবু তো ফিরেছেন।
কিন্তু আপনি ফিরবেন তো? কোন একদিন রাষ্ট্রীয় পদে না থাকলে যত বিপদেই পড়েন, বিদেশ থেকে আপনি দেশে ফিরবেন তো!! নাকি থেকে যাবেন প্রবাসের আদি ঠিকানায়!! আদি নবাবী হালে!!! চলবে...